চুরি-পাচার হাসিনার : দায় শোধের ভার অন্তর্বর্তী সরকারের!
- রিন্টু আনোয়ার
- ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০৬:০৪
পতিত সরকারের দুর্নীতি-অনিয়ম ও অর্থপাচারে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক, রাজস্ব আহরণ, রফতানি বাণিজ্য, ডলার সঙ্কট ও রিজার্ভ পরিস্থিতি ভয়াবহ। ঋণের পর্বত, লুটপাটের ক্ষত, দুর্নীতির বোঝা, পাচারের তেজ, রিজার্ভ বিপর্যয়সহ নানা ঘা রেখে কেবল ছোটবোনকে নিয়ে পালিয়ে জানে বেঁচেছেন শেখ হাসিনা। পরিবারের বাদবাকিদের পাঠিয়ে দিয়েছেন আরো আগে। তার কাছে পরিবারই আওয়ামী লীগ, তারাই বাংলাদেশ। যা বিশ্বের ইতিহাসে রেকর্ড। ছলে বলে অপজিশনকে নিপীড়ন, দলীয় নেতাকর্মীদের উচ্ছিষ্ট খাইয়ে টানা ১৫ বছরে অবিরাম ঠগবাজির চাতুরিতে দেশের যত সর্বনাশ করা যায়, তার একটিও বাদ দেনটি তিনি। উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্পে চলেছে মেগা লুটপাট। নানা ঘটনায় আরো স্পষ্ট ছিল উন্নয়নে নয়, প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছিল লুটপাটের উদ্দেশ্যে।
অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ঋণের টাকার বড় অংশ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নানা প্রক্রিয়ায় একটি চক্রকে দিয়ে চালানো হয়েছে পাচারের কাজটি। শেখ হাসিনা সরকারের টপ টু বটম কমবেশি এই কর্মে লিপ্ত ছিল। বিদেশী একটি গণমাধ্যমে এসেছে, লুটপাট-দুর্নীতি অনিয়মের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। স্বয়ং শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আত্মসাতের অঙ্কই প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা।
পালানোর সময় তিনি বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ে রেখে গেছেন ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এখন তা সামলানোর সরাসরি দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। বড়জোর একটু সময় নেয়া যাবে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণের সময় দেশী-বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ১৫ বছরে তা ১৫ লাখ ৬০ হাজার কোটিতে এনে ভেগেছেন। সুদ-আসলে এ ঋণ শোধের দায় এখন বর্তাবে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব অর্থনীতির এক বরেণ্যজন। তার সোস্যাল বিজনেসে ধন্য সুদূরের যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিকট দেশ ভারত পর্যন্ত। তার থিওরি কাজে লাগিয়ে তারা নিজ নিজ দেশে বেনিফিশিয়ারি। সেই ব্যক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হয়ে এখন কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিগত সরকারের কুকীর্তির ভার তার ওপর।
দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয়। এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমেছে। ডলার-সঙ্কটে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পাশাপাশি চলেছে বিতর্কিত আট-১০টি বণিকগোষ্ঠীর হরদম লুটপাট। ব্যাংক খাতে যারা ‘থাবা বাবা’ নামে পরিচিত। এদের কুকর্মের জেরে বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংক বেঁচে আছে বিশেষ ব্যবস্থায়। প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ঋণের টাকা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পাচারের ঘটনাও ছিল পরিকল্পিত। আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তায় বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয়। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি পৌঁছে ১০০ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বেশ ক’বছর ধরে ক্রমে বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের মধ্যে একটি উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আরেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থ হচ্ছে টাকা ছাপানো। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়, যা উসকে দেয় মূল্যস্ফীতি। দেশী ও বিদেশী দুই ধরনের ঋণের প্রতি ঝুঁকেছিল সদ্য পতিত স্বৈরাচার সরকার। শেষ ছয়-সাত বছরে দ্রুত হারে উভয় ধরনের ঋণ নেয়া বেড়েছে। বেশি বেড়েছে দেশী ঋণ। নিজস্ব অর্থায়নে বলে প্রচার চালানো হলেও পদ্মা সেতুও বিদেশী ঋণ নিয়ে হয়েছে। সামনে আসছে ঋণ পরিশোধের চাপ।
আগামী বছরের পর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুদ দেয়া শুরু করতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছরে বিদেশী ঋণের বোঝা বেড়েছে তিনগুণের বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৮৫ কোটি ডলার। আওয়ামী লীগ সরকার কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি রেল ও বিদ্যুৎ খাতে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তের ঋণ নেয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে অর্থাৎ গত জুন মাস শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত বিদেশী ঋণ দাঁড়ায় ছয় হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে। সে হিসাবে বর্তমানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মাথার ওপর গড়ে ৪০০ ডলারের মতো বিদেশী ঋণের বোঝা।
আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তায় বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১.১৪ বিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সাথে সাথে এর সুদ এবং আসল পরিশোধের পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। এর কী ভয়ানক জেরে পড়তে পারে, এ সম্পর্কে শেখ হাসিনার সরকারকে বারবার সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু সরকারের দিক থেকে তাদের বিএনপি-জামায়াতের চর চিহ্ন দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। তাদের দমানো গেলেও তথ্য চাপা রাখা যায়নি। বাংলাদেশ কার কাছে কতটা ঋণ রয়েছে সেই বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ডাটা পাওয়া যায়।
এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণের অর্ধেকের বেশি ৫৭ শতাংশ হলো বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে। আর দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে ঋণ করেছে তার মধ্যে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত- এ চারটি দেশ প্রধান। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বেলায় বাংলাদেশের দেনা সবচেয়ে বেশি জাপানের কাছে।
পরিমাণ ৯.২১ বিলিয়ন ডলার। এরপরই রাশিয়ার কাছে ৫.০৯ বিলিয়ন, চীনের কাছে ৪.৭৬ বিলিয়ন এবং ভারতের কাছে ১.০২ বিলিয়ন ডলার ঋণী বাংলাদেশ। বর্তমানে এ ঋণ আরো অনেক বেশি। কারণ ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ২০২৩-এর জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এডিবি থেকে ১৪০ কোটি এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ৯৬ কোটি ডলার নিয়েছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান থেকে ১৩৫ কোটি, রাশিয়া থেকে ৮০ কোটি, চীন থেকে ৩৬ কোটি, ভারত থেকে ১৯ কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে। এসবের পুরো চাপ এখন ইউনূস সরকারের ঘাড়ে। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের দেনার দায় এখন দেশকে, দেশের প্রতিটি নাগরিককে, বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে। প্রকারান্তরে বিদেশী ঋণের সমস্ত দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধে পড়ে। জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় করে সরকারের আয় বাড়াতে হবে। এখন মাথাপিছু ঋণ দেড় লাখ টাকার মতো। কিছুদিন আগে এটি এক লাখ টাকার মতো ছিল। সরকারকে কোনো না কোনোভাবে প্রত্যকের কাছ থেকে তা আদায় করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি অন্যতম বড় কাজ হলো রাষ্ট্রের ভেতর থাকা দুর্বৃত্ত চক্র ও দুর্নীতিবাজদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। অতীতে সব সরকার দুর্নীতিকে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কখনো দুর্নীতির নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। সবসময় বিরোধী মতকে চাপে ফেলতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করেছে। এবার অবশ্য দেশবাসীর প্রত্যাশা পক্ষকাল আগে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতিবাজদের ধরবে।
জুলাই বিপ্লবের পর নতুন সরকার হত্যার বিচারে এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগী। আশা করা যায়, কিছু দিনের মধ্যেই দুর্নীতির ব্যাপারেও কঠোর পদক্ষেপ নেবে সরকার। যদিও এখন পর্যন্ত গত ১৫ বছরে লুণ্ঠনের জন্য কোনো কমিশন হয়নি। হয়নি শ্বেতপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত! পুনর্গঠন করা হয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন। অচিরে এসব গঠনে মনোযোগ দেবে সরকার এটা সবার প্রত্যাশা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিকল্প নেই।
মনে রাখতে হবে, জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং ১০ বছরের দুর্নীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এভাবে পৈশাচিক কায়দায় দমনের অপচেষ্টা করেছিল পতিত সরকার? কারণ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। জনগণের ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনা সরকারের কাছে পৌঁছানোর সব দরজা ছিল বন্ধ। সরকার কেন জনবিচ্ছিন্ন হলো? কারণ গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার দেশ শাসন করেছিল বৈধ ম্যান্ডেট ছাড়া, ভোট ছাড়া। বিভিন্নভাবে কূটকৌশলে তারা ‘ক্ষমতা’ চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল। ক্ষমতায় আজীবন থাকার সর্বগ্রাসী এই মানসিকতায় কেন আচ্ছন্ন হয়েছিল পতিত সরকার? কারণ দুর্নীতি।
দুর্নীতির জন্য সরকার ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। অনেক লেখায় লিখেছি, দুর্নীতি ঢাকার জন্য সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার কাজে লিপ্ত ছিল। অবাধে লুণ্ঠনের জন্য সরকার একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছিল। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিল। দুর্নীতি আসলে সরকারকে স্বৈরাচার করেছিল, করে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। দুর্নীতির কারণে তারা রীতিমতো দানবে পরিণত হয়েছিল। আমরা যদি বিগত সরকার কাঠামোয় সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব। রীতিমতো দুর্নীতিবাজদের পুরস্কৃত করার এক রীতি চালু হয়েছিল দেশে।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন কিভাবে বিষয়গুলো সমাধানের পথে আগাবেন- তা দেখতে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা