১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১, ৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
দেশ জাতি রাষ্ট্র

বঞ্চিতদের সুযোগে অবঞ্চিতদের ভাগ

বঞ্চিতদের সুযোগে অবঞ্চিতদের ভাগ - প্রতীকী ছবি

সিভিল সার্ভিস বা অন্যত্র পদোন্নতি, পদায়ন ও পদাবনতি একটি সাধারণ বিষয়। অসাধারণ হচ্ছে, এসব বিষয় যখন প্রাতিষ্ঠানিকতা বা বিভাগীয় নিয়ম-কানুন, রীতি-রেওয়াজ অগ্রাহ্য করে অসম্ভব কিছু ঘটে। এটি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বাংলাদেশ-জাতিরাষ্ট্র অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করার পরও সিভিল সার্ভিসটি পেশাদারিত্ব (Professionalism) অর্জন করেনি। সার্ভিস রুল বা চাকরির নিয়মাবলি আছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। তার ফলে যখন যেমন, তখন তেমন অবস্থা চলছে।

স্বাধীনতার পরপরই সুনির্দিষ্ট নিয়মরীতি অনুসরণ না করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের ইচ্ছেমতো সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ দেয়। তখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমর্যাদাপূর্ণ পদ পেতে তোফায়েল সাহেবের স্লিপ-ই যথেষ্ট ছিল। সে জন্য ‘তোফায়েল সার্ভিস’ নামে একটি ক্যাডার সৃষ্টি হলো। তবে জিয়াউর রহমানের শাসনকাল থেকেই সিভিল সার্ভিস একটি সুশৃঙ্খল ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে অগ্রসর হয়। জেনারেল এরশাদের সময় এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ থাকে। ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হলে এটি আরো প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে তারা এটিকে দলীয়করণের চেষ্টা করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরে এলে দলীয়করণ বন্ধ হয়। ২০০৬ সালে এক-এগারোর তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব কিছু যেমন ওলটপালট হয়ে যায়, সেখানেও বিপত্তি ঘটে। কিন্তু আসল সর্বনাশটি শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। তখন আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। সেই সাথে ফিরে আসে দলতন্ত্র। চৌকিদার থেকে রাষ্ট্রপতি- সবই তাদের চাই। রাষ্ট্র যেন ফিরে এলো আবার সেই ১৯৭২-এ।

বিগত দেড় দশক ধরে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিল। ক্ষীণ চাঁদ যেমন ক্রমেই ষোলকলায় পূর্ণ হয়, তেমনি ১৬ বছরে ক্রমবর্ধমানভাবে আওয়ামী দলীয়করণ পূর্ণতা অর্জন করে। যেমনটি বলেছি, চৌকিদার থেকে রাষ্ট্রপতি তেমনটি মানুষ লক্ষ করেছে গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত। তাদের লোক না হলে কেউই পিয়ন-দারোয়ানের চাকরিও পেতো না। সেই সাথে ছিল নিয়োগবাণিজ্য। অর্থকড়ি ব্যতীত কারো চাকরি হয়েছে এমন শুনিনি। সেই একই অবস্থা ছিল সিভিল সার্ভিসে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন নামে যে প্রতিষ্ঠানটিকে সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব দেয়া আছে সেখানে বিগত ১৬ বছরে একজনও ভিন্নমতের মানুষ নিয়োগ পায়নি। আর যারা সৌভাগ্যক্রমে সুপারিশ পেয়েছে তাদের প্রায় সবাই সেই দলতন্ত্রের পাহারাদার। যদি কোনোক্রমে ফাঁকফোকর দিয়ে মেধার জোরে বিসিএস পাস করে সুপারিশ লাভ করেছে কেউ, তাদের ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। অবশেষে ভেরিফিকেশনের নামে আটকে গেছে তাদের ভাগ্যলিপি। এটি একটি ওপেন-সিক্রেট বিষয় যে, পিএসসিতে সরকারি দলের তরফ থেকে তালিকা পাঠানো হতো। সেই তালিকা ধরে ধরে পিএসসির কর্তাব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চাকরির সুপারিশ করতেন। আর তা পাঠানো হতো তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে। শুধু পিএসসি নয়, সর্বত্রই এভাবে তালিকা পাঠানোটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল, Disorder became the order of the day. পরীক্ষায় পাস করেও আওয়ামী তালিকার কারণে চাকরি পায়নি এ রকম উদাহরণ সর্বত্র। এই তালিকায় ভালো-মন্দ, মেধাবী-অমেধাবী ও চরিত্রবান-চরিত্রহীন যাচাই করার কোনো সুযোগ ছিল না। তার ফলে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধী কিংবা সন্ত্রাসীদের নিয়ে বদমাশদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে ওঠে সিভিল সার্ভিস। এখনো তাদের কেউ কেউ দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করছে। তবে সর্বত্রই ভালো-মন্দ আছে। ব্যতিক্রম আছে।

এটি ছিল মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অভিশাপ। ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফলে যখন তালিকা পাঠানোর সুযোগ সীমিত হলো, তখন ছাত্রলীগের গাত্রদাহ শুরু হয়। তারা আওয়ামী লীগকে চাপ দেয়। আওয়ামী নেতৃত্বই তাদের বুদ্ধি দেয় ২০১৮-এর আদেশটি বাতিল করাতে। আওয়ামী হাইকোর্ট সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে সে আদেশটি বাতিল করে। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। কোটাবিরোধী আন্দোলনের আদলে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আওয়ামী দুঃশাসনের সাথে মেধাবীদের এই বঞ্চনার ক্রোধ লাভা অবশেষে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটাল। তার নাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কেউ আরব বসন্তের স্টাইলে বলে- বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লব। এক নদী রক্ত পেরিয়ে দেশ যেভাবে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। সন্দেহ নেই, বিগত ১৫ বছরে আর সব মানুষের মতো সিভিল সার্ভিসের লোকরাও নিপীড়িত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার পর বঞ্চিতদের প্রতি সুবিচার করার তাগিদ এসেছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে না হতেই বিভিন্ন কার্যালয়ে, প্রতিষ্ঠানে এমনকি সচিবালয়ে বঞ্চিতদের হাহাকার লক্ষ করা গেছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, বঞ্চনা অবসানের আদেশটি লিখিয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা ছিল। পরবর্তীকালে সরকারের তরফ থেকে বঞ্চিতদের প্রক্রিয়াকে আইনি রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়। অন্যান্য অফিসে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও সচিবালয়ের ঘটনাবলি নাগরিক সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেশি।

বিগত কয়েক দিনে একসাথে অনেক কর্মকর্তার পদোন্নতির খবর বেরিয়েছে সংবাদপত্রে। প্রথমত, উপসচিব পদে জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ ১১৭ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ এসব কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সচিবালয়ে পদ-পদোন্নতি থেকে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এসব নিয়ে প্রায় প্রতিদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সচিবালয়ে জড়ো হচ্ছিলেন তারা। এ রকম প্রেক্ষাপটে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়।

এরপর যুগ্মসচিব পদে ২০১ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। তারা এত দিন উপসচিব ও সমপর্যায়ের পদের দায়িত্বে ছিলেন। যে তারিখ থেকে এই কর্মকর্তাদের কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা তাদের ছাড়িয়ে যান, সেই তারিখ থেকে তাদের পদোন্নতি কার্যকর হবে। এর আগে ১৩ আগস্ট উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছিল সরকার। উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পরবর্তীতে আরো ২২ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পুলিশ প্রশাসনেও কয়েকটি ধাপে বঞ্চিতদের পদোন্নতি ঘটেছে। একটি দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পর বঞ্চিতদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এটি ছিল নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

যখন জোয়ার আসে তার সাথে শুধু বিশুদ্ধ পানিই আসে না, আবর্জনাও আসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুবাদে আজ বঞ্চিতরা সুবিচার পেলেন। সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ে, প্রতিষ্ঠানে বিশেষত সচিবালয়ে পদোন্নতির যে দীর্ঘ তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু অভিযোগও আছে। বিগত ১৫ বছরে যারা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা তাদের বিশ্বাসের জন্য, নিরপেক্ষতার জন্য ও পেশাদারিত্বের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের একান্ত বশংবদ না হলে কাউকেই পদোন্নতি ও ভালো পদায়ন করা হয়নি। অনেকগুলো চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। তাদের যারা একান্তই অনুগত ভৃত্য নন তাদের বানোয়াট অভিযোগে হয়রানি করা হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে শুধু সিভিল সার্ভিসে ওএসডি করা হয়েছে হাজার খানেক কর্মকর্তাকে। তার বিপরীতে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে অযোগ্য, অকর্মণ্য ও অপদার্থ অনেককে। প্রশাসনকে খুশি রাখার জন্য পদোন্নতি ছিল পাইকারি।

সেখানে দেখা গেছে, দুর্নীতিবাজ ও তেলবাজরা শনৈঃশনৈঃ পদোন্নতি পেয়েছেন। আর সৎ, যোগ্য ও ন্যায়বান কর্মকর্তারা বঞ্চিত হয়েছেন। এবারো বঞ্চিতদের নামে কিছু দুর্নীতিবাজ ও অপরাধী কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু মানুষ আছে যারা সহজেই ভোল পাল্টাতে পারে। সে সময় ক্ষমতাধর ছিল দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে পদাবনতি অথবা পদচ্যুতি ঘটেছে, তারাও কেউ কেউ বঞ্চিতদের সুযোগ নিয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। তবে ওই পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ আছে- পরে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনোরকম বিরূপ বা ভিন্নরূপ তথ্য পাওয়া গেলে তার ক্ষেত্রে এই আদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধন বা বাতিল করার অধিকার কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মহাব্যস্ততার মধ্যেও বঞ্চিতরা প্রতিকার পেয়েছেন- এটি আনন্দের কথা। তবে সেখানে যদি কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকে সেটি সংশোধনের অধিকার সরকার সংরক্ষণ করে।

প্রশাসনে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সে সরকারকে বিশ্বস্ততার সাথে সেবা দেয়াই কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। সরকার যদি হয় ন্যায়নিষ্ঠ-পেশাদারিত্বের পক্ষের তাহলে কর্মচারীদের তথা সিভিল সার্ভিসের অসুবিধা ঘটার কথা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের মতো যে দল শুধু দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে সব কিছু বিচার করে সেখানে দুর্নীতিবাজ ও প্রতারণা কৌশলে অভ্যস্ত আমলারা সুবিধা আদায় করেন। অপর দিকে যে সরকার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, জবাবদিহি হতে বাধ্য করে এবং জনগণের অংশীদারিত্ব নিয়ে প্রশাসন পরিচালনা করে তাদের দ্বারা পেশাদারিত্ব সমাজ-রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয়।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement