২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

১৬ বছরের স্বৈরশাসনের মূলমন্ত্র

শেখ হাসিনা - ফাইল ছবি

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২০ বছর পর বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পার হয়ে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদ পতন হয়। এরপর ১৯৯১ সালে দেশে প্রথম গঠিত হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। পরবর্তীতে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। একবার অন্তর্বর্তী এবং দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেতে যাচ্ছিল। প্রশ্ন হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনব্যবস্থা সাংবিধানিক ভিত্তি পাওয়ার পরও দেশে স্বৈরশাসক ক্ষমতায় এলো কিভাবে? কিভাবে একছত্র ক্ষমতা নিয়ে সরকার গঠন করল, কিভাবে হিটলারি কায়দায় ১৬ বছর স্বৈরশাসন চালাল, কী তার মিশন ছিল এবং কী ছিল তার মূলমন্ত্র? এ নিয়েই আজকের লেখা।

যেভাবে স্বৈরশাসক হলেন
গণতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত্তি পাওয়া দেশে তখনকার সরকার যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে যাচ্ছে ঠিক সে সময় আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হাসিনার লগিবৈঠা নিয়ে দলীয় সন্ত্রাসীদের মাঠে নামান। ২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর দলীয় সভায় আক্রমণ করে অনেক নেতাকর্মীকে রাজপথে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের স্বৈরশাসনের প্লট তৈরি হয়। রক্তক্ষয়ী ওই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে পর্দার আড়াল থেকে ইন্ধন জোগায় বাইরের শক্তি। ক্ষমতায় আসে ভারত ও আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গড়া মইন-ফখরুদ্দীন এক-এগারো সরকার।

স্মরণ করা যেতে পারে, শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালেও ক্ষমতায় ছিল কিন্তু তখন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকায় ওই স্বৈরাচারী, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধপরায়ণ হাসিনার আসল চরিত্র কেউ টের পায়নি। মইন-ফখরুদ্দীন দেশের ডিজিএফআই, নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে ২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে। দিল্লির অধীনস্থ দানব সরকারকে অনন্তকাল ক্ষমতায় রাখার অভিপ্রায়েই উল্লিখিত শক্তিগুলো তখন একজোট হয়ে কাজ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার প্রক্রিয়া শুরু করে হাসিনা সরকার। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এভাবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার নীল-নকশা তৈরি করে।

স্বৈরশাসনের মূলমন্ত্র
বিনাভোটে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে মূলত দলীয় ক্যাডার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ভারতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে এবং গুম, খুন, অত্যাচার, নিপীড়ন, দুর্নীতি, লুটতরাজ ও অর্থপাচারের মাধ্যমে স্বৈরশাসন কায়েম করে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে তাদের প্রথম আঘাত ছিল ২০০৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে হত্যার ঘটনা। পরে প্রতিবাদী আরো অনেক সেনাকর্মকর্তা এবং ঘটনার সাক্ষী অনেক বিডিআর সদস্যকে হত্যা ও চাকরিচ্যুত করা হয়। ধারণা করা হয়, ওই সেনা কিলিং মিশনে সরাসরি ভূমিকা রাখে ভারতের কমান্ডো বাহিনী। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ওই ঘটনার মাধ্যমে বিডিআর এবং তার কমান্ডার সেনাবাহিনীর পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাসে ফাটল সৃষ্টি করা। শেষ পর্যন্ত এই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়ে সীমান্ত অরক্ষিত করে ফেলে এই স্বৈরশাসক। তরা স্বৈরশাসন রক্ষার কাজেও লাগায় বিজিবিকে। পুরো ছকটি ছিল ভারতের পরিকল্পনার অংশ; উদ্দেশ্য ছিল রৌমারীর বিএসএফ হত্যার প্রতিশোধ এবং বর্ডার উন্মুক্ত করে বাংলাদেশকে তাঁবেদার বানানো।

শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের দু’টি অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল জঙ্গি নাটক এবং স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি। তবে ভিশন ছিল পিতা ও পরিবারের সব সদস্য হত্যার বিচার যা হাসিনা দেশে আসার আগে ব্রিটিশে বাংলাদেশী সাংবাদিক সিরাজুর রহমানকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন। শেখ হাসিনা তার পরিবারের কথিত হত্যাকারীদের হত্যা করেই শান্ত হননি; বরং দেশের আপামর জনতার ওপর শাস্তি দিতে দেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে বিকিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।

১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল জঙ্গি, জঙ্গিতত্ত্বের মাধ্যমে অবৈধ ফ্যাসিস্ট শাসন বজায় রাখা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বুদ্ধিপরামর্শেই দানবে রূপান্তরিত র্যাব এবং পুলিশ জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। ইসলামী জঙ্গি দমনের অজুহাতে বাংলাদেশে হাজারো মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করে নরপিশাচ হাসিনা ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত পশ্চিমা সরকারগুলোর বাহবা কুড়াতে পেরেছিল। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালে হেফাজতের আলেমদের হত্যা, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় ফাঁসির রায় ঘিরে বহু মানুষের হত্যা এবং জঙ্গিবাদ দমনের নামে বিরোধী মত দমন করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। শেখ হাসিনার ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দিল্লি ও পশ্চিমা বিশ্বও মুসলমান নিধনে উৎসাহ জুগিয়েছে। কথিত ইসলামী জঙ্গিদের নির্মমভাবে দমনের পুরস্কারস্বরূপ পশ্চিমা বিশ্ব শেখ হাসিনাকে একবিংশ শতকের সবচেয়ে অত্যাচারী শাসক বানাতে পেরেছে। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে মুসলিম বিশ্বে ঐতিহাসিকভাবে হাসিনার মতো ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসকদেরই আশকারা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিকশিত গণতন্ত্রকেও ২০০৭ সালে এক-এগারোর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিনাশ করেছিল।

আন্তর্জাতিকভাবে সীমাহীন বর্বরতার প্রথম নাটক ছিল ২০১৬ সালে গুলশানের হোলে আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এর প্রকৃত রহস্য এবং সত্য আজো জাতি জানতে পারেনি। সে রাতে রেস্তোরাঁয় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কেউ আজ পর্যন্ত কোন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ জনসমক্ষে কেন তুলে ধরেননি? স্বৈরশাসক হাসিনার অন্যতম সফলতা প্রশাসনযন্ত্রের তিনটি মূল স্তম্ভ নিজস্বভাবে দলীয় লোকদের নিয়োগ দিয়ে, অবৈধ সুবিধা দিয়ে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে, আইন, নির্বাহী ও বিচারব্যবস্থাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারা। আদালতে বিচারের নামে যে কেবলই নিষ্ঠুর অবিচার হয়েছে সেটি জাতির অজানা নয়।

দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের দ্বিতীয় বৃহত্তম মূলমন্ত্র ছিল মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার নাটক। একাত্তরের পাকিস্তানি গণহত্যার বিচারের নামে জামায়াত এবং বিএনপি নেতাদের ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হতে হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার ইস্যু নিয়ে দেশকে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পদ্ধতিতে দেশ শাসন করে; দমন করে। অথচ দেখা যায়, শেখ হাসিনার মেয়ের শ্বশুর একজন নামকরা রাজাকার এবং তার সাথে তার দলে রয়েছে অনেক রাজাকার। পরিশেষে, এই রাজাকার ইস্যুই তার জন্য বুমেরাং হয়েছে এবং স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে।

এই সমস্ত জঙ্গি নাটক এবং মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার ইস্যুতে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত মিডিয়ার মধ্যে যারা ইসলামবিদ্বেষী তারা বিভীষণের ভূমিকা পালন করেছে। এই মিডিয়ার কর্মকাণ্ডের ফলেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সরকারের হেজিমনি শিকড় গাড়তে পেরেছিল। শাপলা চত্বরে নির্মম গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ইসলামবিদ্বেষী প্রচারমাধ্যম। সেই ঘটনার প্রকৃত তথ্য প্রচার করার কারণে দিগন্ত এবং ইসলামী টেলিভিশনের প্রচার বন্ধ করে দেয়, যা আজো প্রচারের অনুমতি পায়নি। সেই গণহত্যাকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বিভিন্নভাবে নিপীড়ন করে।

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের জনগণ বিনাভোটের জনসমর্থনহীন লেডি হিটলার শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করলেও র্যাব ও পুলিশের অনেক সুবিধাভোগী এবং ইতিহাসের অন্যতম অনুগত বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে নিষ্ঠুরতমভাবে ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন করে।
হাসিনা সংসদকে দুর্নীতিবাজদের ক্লাবে পরিণত করেছেন। তার গুরুত্বহীন সংসদ সদস্য আনারুল হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনে কলকাতায় নির্মমভাবে নিহত হলেও তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। আর্মির প্রধান জেনারেল আজিজ, পুলিশপ্রধান বেনজীর গংদের দুর্নীতি ধরা পড়ার পরও নিরাপদে দেশ থেকে পালানোর সুযোগ দিয়েছে। অথচ ন্যায্য অধিকার চাওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, তাদের বুকে চালিয়েছেন নির্বিচারে গুলি।

চূড়ান্তভাবে, স্বৈরাচারী হাসিনা দেশকে শেষ করলেন, দেশের মানুষকে ঋণে জর্জরিত করলেন, তার দলকে শেষ করলেন। দেশের বিচার, প্রশাসন, অর্থনীতিকে পঙ্গু করে একা দেশ থেকে নিরাপদে ভারতে পালিয়ে গেলেন। অথচ তার দলের নেতা ও কর্মী, যারা তার স্বৈরশাসন আগলে রাখলেন তাদের কথা একবারের জন্যও ভাবলেন না।

উপসংহারে বলা যায়, অন্য অনেক গণ-আন্দোলনের মতোই বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, আবু সাঈদ, মুগ্ধের মতো সাহসী নেতা এবারের আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন। সাথে হাজারো শহীদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগী জনতা, কোটা সংস্কারের মতো ক্ষুদ্র ইস্যুতে আন্দোলনের তোড়ে স্বৈরশাসকের মসনদ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। জাতি পেলো দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার স্বাদ, রক্ষা পেল দেশের সার্বভৌমত্ব। ‘অত্যাচারী শাসক’ তকমাসহই হাসিনাকে মনে রাখবে ইতিহাস।
তরুণরা আবারো এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, যেখানে মানবাধিকার রক্ষিত হবে, কোনো নাগরিককে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের শিকার হতে হবে না। কিন্তু সেই গণ-আকাক্সক্ষার দেশ নির্মাণ করতে হলে আমাদের সব জঙ্গিবাদ, স্বাধীনতার বিতর্কিত ইস্যুকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। বিচারবহির্ভূত সব হত্যা ও গুমের স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচার করতে হবে। পাশাপাশি এই ১৬ বছরে ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বৈরাচারকে টিকিয়ে রাখতে যেসব অবৈধ চুক্তি করেছে তা বাতিল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারত কখনোই আমাদের বন্ধু ছিল না বরং প্রভুর মতো আচরণ করেছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল