২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সুশাসন

অসাংবিধানিক শাসন বৈধতায় অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানের চ্যালেঞ্জ

অসাংবিধানিক শাসন বৈধতায় অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানের চ্যালেঞ্জ - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। সংবিধান কার্যকর পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির আদেশে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হতো। সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার বিধান ছিল। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধন আইন যা ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে কার্যকর হয়, এর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা রহিতক্রমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে মোহাম্মদউল্লাহ রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিসংক্রান্ত বিশেষ বিধান প্রবর্তন করে বলা হয়, সংশোধনীটি প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে; শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করবেন এবং ওই প্রবর্তন হতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন যেন তিনি এ আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তনকালীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন ছিল। সংসদে দলটির সংবিধান সংশোধনে আবশ্যক দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রে জাতীয় দল নামে অভিহিত শুধু একটি দল থাকবে মর্মে বিধান করা হয়, যা বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) নামে অভিহিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অসাংবিধানিক সামরিক শাসনে পতিত হয় এবং সামরিক ফরমানের মাধ্যমে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হতে থাকে। এ সামরিক শাসনটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল অবধি বহাল থাকে। উল্লিখিত সময়ে সামরিক সরকারের সব কাজ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলিরূপে অনুমোদিত হয়। একই সাথে তা সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ১৮ অনুচ্ছেদরূপে সংযোজিত হয়।

জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং নিহত হন। সে সময় তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) ক্ষমতাসীন ছিল। সংসদে দলটির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীটি রদ, রহিত ও বাতিল হয়।

সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো অসাংবিধানিক সামরিক শাসনের আওতায় আসে। এ সামরিক শাসন ১১ নভেম্বর ১৯৮৬ সালে আনীত সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে অনুমোদিত হয় এবং সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ১৯ অনুচ্ছেদরূপে সংযোজিত হয়।

সামরিক শাসক এরশাদ প্রবর্তিত সামরিক শাসন বহাল থাকাকালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে সামরিক শাসক এরশাদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেলে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক শাসনকালে করা কাজগুলো অনুমোদনে আবশ্যক দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ঘাটতি দেখা দেয়, যদিও আ স ম আব্দুর রব সমর্থিত জাসদ এবং আরো কিছু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন নিয়ে এরশাদ সংবিধান সংশোধনে সমর্থ হন।

প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় সামরিক শাসন প্রবর্তনকালীন সংবিধান স্থগিত করা হয়। উভয় সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে সংবিধান আংশিক কার্যকরের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে চূড়ান্ত পর্যায়ে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সংবিধান সম্পূর্ণরূপে পুনর্বহাল করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হলেও সে সময়কার করা কর্মসমূহ বৈধতা দেয়া হয়; যদিও প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারকের স্বপঠিত শপথের সাথে এ ধরনের রায় সাংঘর্ষিক কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে।

গণ-অভ্যুত্থানে সামরিক শাসক এরশাদের পতন ঘটলে ‘তিন জোট’ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলের অন্তর্ভুক্ত যথাক্রমে ৮, ৭ ও ৫ দলের রূপরেখা অনুযায়ী কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও অস্থায়ী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বেসামরিক অসাংবিধানিক শাসনের সূত্রপাত। কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১০ আগস্ট ১৯৯১ সালে সংবিধানের একাদশ সংশোধনী প্রবর্তন অবধি ওই অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
অস্থায়ী সরকারপ্রধান সাহাবুদ্দীন আহমদ দায়িত্বে থাকাকালে বাংলাদেশে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী এ নির্বাচনটি সর্বপ্রথম দলীয় সরকারবহির্ভূত নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ইতোপূর্বেকার ও পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনায় পরিলক্ষিত হয়- এ নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ মানের হিসেবে দেশ ও বিদেশে স্বীকৃত হয়। নির্বাচনটিতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী যথাক্রমে ১৪০, ৮৮, ৩৫ ও ১৮টি আসন পায়।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলেও জামায়াতে ইসলামী সরকারের মন্ত্রিত্বে অংশগ্রহণ করেনি; যদিও দলটি সমর্থনের বিনিময়ে দু’টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য পদ লাভ করেছিল। কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের আগমনের আগে গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন এরশাদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এরশাদ ঘোষিত জরুরি অবস্থা অস্থায়ী সরকারের আগমন-পরবর্তী বেশ কিছুকাল বহাল থাকায় সে সময় সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিত ছিল।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সংসদ গঠিত হলে তিন জোটের রূপরেখার আলোকে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমর্থনে কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের সব কাজকর্ম সংবিধানের ১০ আগস্ট ১৯৯১ সালে প্রবর্তিত একাদশ সংশোধন আইন দ্বারা অনুমোদিত হয়। একই সাথে সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী চতুর্থ তফসিলে ২১ অনুচ্ছেদরূপে সংযোজিত হয়।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী-পরবর্তী ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল তা সংবিধানের ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ সালে প্রবর্তিত দ্বাদশ সংশোধনী আইন দ্বারা অবলুপ্ত হয়। ওই তারিখ থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা কার্যকর হয়, যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।
রাষ্ট্রপতি শাসিত ও সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার অবস্থান ভিন্নতর হওয়ায় সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ২২ অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা করা হয়।

পঞ্চম সংসদ বহাল থাকাকালীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলে। একপর্যায়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে মেয়াদ অবসানের আগে চার বছর আট মাসের মাথায় সংসদটি ভেঙে দিয়ে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনটি বর্জন করে। একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ২৮৯টি আসন পায়।

নির্বাচন-পরবর্তী সংসদ গঠিত হলে বিএনপি বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উত্থাপনের মধ্য দিয়ে তা ২৮ মার্চ ১৯৯৬ সালে আনীত সংবিধান ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে প্রবর্তন করে। অতঃপর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রথমোক্তটিতে আওয়ামী লীগ ও দ্বিতীয়টিতে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।

অষ্টম সংসদে বিএনপি ১৭ মে ২০০৪ সালে সংবিধানে চতুর্দশ সংশোধনী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে উচ্চাদালতের বিচারকদের অবসরের বয়স ৬৫ হতে ৬৭-তে উন্নীত করলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়া বিষয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এর ফলে দেখা যায় অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসানের পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠন বিষয়ক সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে কর্মরত রাষ্ট্রপতি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানরূপে আবির্ভূত হন। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবসান ঘটলে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন ঘটে। উভয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনোটি সংবিধানসম্মত পন্থায় গঠিত হয়নি। শেষোক্ত ২০০৭-০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অদ্যাবধি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়নি।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বিষয়ক রিট মামলার আপিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার অবতারণায় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস নেন; যদিও সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে এ ধরনের বৈধতা প্রদানের প্রয়াস কোনোভাবে আইনসম্মত ও বৈধ নয়।

সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো অসাংবিধানিক বেসামরিক সরকারের সূচনা হয়। এ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়ায় সরকারটির কার্যকলাপ এবং এর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য এবং এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে দলীয় সরকারের অধীন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে হওয়ায় গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আগমন ঘটেছিল। বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ কর্তৃক একতরফাভাবে আদালতের দোহাই দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বাতিল জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে হওয়ায় একটি স্বীকৃত মীমাংসিত বিষয় বিতর্কের আবর্তে পতিত হয়।

’৭২-এর সংবিধানে ১৫০ অনুচ্ছেদে বিবৃত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলিতে উল্লেখ ছিল- এ সংবিধানের অন্য কোনো বিধান সত্ত্বেও চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি কার্যকর হবে। এ বিধানাবলির আলোকে সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সংশোধনী অনুমোদিত হয়।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি বিষয়ক ১৫০ অনুচ্ছেদ সংশোধনকরত বলা হয়- ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রবর্তনকালে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলি ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে কার্যকর থাকবে। এর ফলে যে কোনো অসাংবিধানিক সরকারের আগমন-পরবর্তী সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের বিধানের আলোকে চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে বৈধতা দেয়ার বা অনুমোদন করার পথ রুদ্ধ হয়।

কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও জনআন্দোলনে বিগত ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি তৎপরবর্তী ৬ আগস্ট ২০২৪ সালে সংসদ অবলুপ্ত ঘোষণা করেন। এরপর ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং অপর ১৪ জন উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন; যদিও বিদ্যমান সংবিধানে এ ধরনের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও উপদেষ্টা পরিষদের শপথ গ্রহণের কোনো বিধান নেই। শপথ গ্রহণ করাকালীন প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি স্পষ্টত ব্যক্ত করেছেন, তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ছাত্র ও জনবিপ্লব পরবর্তী জনআকাক্সক্ষায় গঠিত হওয়ায় সংবিধানে কি আছে বা কি নেই তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ জনমানুষের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন। সংবিধান বহাল রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হওয়ায় ভবিষ্যতে এর সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার আবশ্যকতা দেখা দেবে। সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থায় বৈধতা দেয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ায় ছাত্র ও জনবিপ্লবের প্রতি যেসব রাজনৈতিক দলের সমর্থন রয়েছে, সেসব দলের সাথে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। সে উত্তরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দল বা দলগুলোর সমর্থন ব্যতীত সংবিধান সংশোধনের পথ রুদ্ধ। প্রসঙ্গত, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭ক অনুচ্ছেদের সন্নিবেশন ঘটিয়ে বলা হয়েছে- যদি কেউ শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এ সংবিধান রদ, রহিত, বাতিল বা স্থগিত করে বা এ সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করে তবে তাদের এ কার্য রাষ্ট্রদ্রোহসম অপরাধ হবে এবং দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে নির্ধারিত দণ্ডের সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

স্মৃর্তব্য যে, প্রথম ও দ্বিতীয় অসাংবিধানিক সামরিক শাসনকালীন শাসকদ্বয় ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং নির্বাচনের আয়োজন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিতে সংসদের মাধ্যমে অসাংবিধানিক শাসনকে বৈধতা দান করেন। অপর দিকে ২০০৭-০৮ সালের দ্বিতীয় অসাংবিধানিক বেসামরিক শাসনের সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সে সরকারটিকে তাদের আন্দোলনের ফসল এবং এর কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়ার অঙ্গীকার করলেও দুরভিসন্ধিমূলকভাবে সে সরকারটিকে সংসদের মাধ্যমে বৈধতা না দেয়ায় এর কুশীলব মঈনউদ্দিন ও ফখরুদ্দীনকে দেশছাড়া হতে হয়।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তন পূর্ববর্তী গণভোটের বিধান বহাল ছিল। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোটের বিধান সন্নিবেশিত হয় এবং দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে সীমিত করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও দ্বাদশ সংশোধনী এখনো বহাল রয়েছে। সংবিধানে গণভোটের বিধান বহাল থাকাকালীন গণভোটের আয়োজন না করে পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রবর্তন সংশোধনীটির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের শাসনকালের বৈধতা বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। ছাত্র ও জনআকাক্সক্ষায় সঙ্ঘটিত বিপ্লব-পরবর্তী গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকলাপ অনুমোদনের বিষয়ে গণভোট সে বিবেচনায় একটি রক্ষাকবচ।

এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশ যখন ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে এমন সময় ছাত্র ও জনবিপ্লবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পতন ঘটলে জনআকাক্সক্ষায় নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আওয়ামী লীগ ব্যতীত দেশের অপর সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনবিদিত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার খ্যাতি আকাশচুম্বী। তার বিষয়ে দেশবাসী আশান্বিত যে, তিনি তুলনামূলক স্বল্প সময়ে দেশ ও জাতির জন্য উচ্চ শিখরে আরোহণের সোপান তৈরি করে দিতে সক্ষম। সময়ের ব্যাপ্তি বিষয়ে বাস্তবতার নিরিখে তার সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই প্রত্যাশিত।

এমতাবস্থায়, সংবিধান বহাল রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনায় শপথবদ্ধ হওয়ায়, তাদের জন্য আশু করণীয় জাতির সামনে তাদের রোডম্যাপ উপস্থাপনপূর্বক সংস্কারমূলক পদক্ষেপের বিস্তারিত তুলে ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ-পরবর্তী অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন। এর ব্যত্যয় বিপর্যয়ের বার্তাবহ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement