৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ২৯ রজব ১৪৪৬
`

বৈষম্যের ব্যবচ্ছেদ

বৈষম্যের ব্যবচ্ছেদ - ফাইল ছবি

কারো কারো অধিকতর ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে দেশ ও অঞ্চল সেরা হওয়ায় আনন্দ সর্বনাশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ অবশ্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনয়নে, নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও অধিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিশ্র“ত ও দৃঢ়চিত্ততার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটিও সাথে সাথে এসে যায়। নিজেদের অধিক্ষেত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আদিষ্ট হয়ে যদি তাদের কর্মধারা পরিচালিত হয় সে ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে জবাবদিহিমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার ও স্বচ্ছতার অভাবে আকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, স্বেচ্ছচারিতার অজুহাত যৌক্তিকতা এমনকি স্বজনপ্রীতির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা। পাবলিক সার্ভিসে প্রতিটি কর্মকর্তার নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ পরিপালনে একটি স্বচ্ছ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ থাকা দরকার। যারা নীতি প্রণয়ন করেন, নীতি উপস্থাপন করেন তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব দৃঢ়চিত্ততা ও নীতিনিয়ম পদ্ধতির প্রতি দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। এর পরিবর্তে তার যদি চাকরি যাওয়ার বা পদোন্নতি আটকে যাওয়ার ভয় থাকলে কোনো বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠা পায় না, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির নিশ্চয়তা আসে না।

সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির প্রয়োজন সবার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে। কারণ এটি পরস্পরের পরিপূরক। আরেকটি বিষয়- নীতিনির্ধারকরা বাস্তবায়নকারীদের দিয়ে, তাদের ভুল বা ব্যত্যয়ধর্মী নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করিয়ে নিতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারেন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ষড়যন্ত্রের টোপে ফেলে বিব্রতও করতে পারেন। ক্ষমতায় থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে এমন রাজনৈতিক উৎকোচ কিংবা নিপীড়নের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে কমবেশি ছিল বা আছে তা মাত্রা অতিক্রমণে সেটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল থেকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে আছে এমন দেশ বা অর্থনীতিতে কতিপয়ের অস্বাভাবিক অর্থপ্রাপ্তি বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম উপসর্গ।

নানা আঙ্গিকে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এমনকি চাকরীজীবীদের বাঞ্ছিতভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। অতিমাত্রায় কোটারি, সিন্ডিকেট বা দলীয় বা রাজনীতিকীকরণে পেশাজীবী, সংস্থা সংগঠন এবং এমনকি সুশীল সেবকরা প্রজাতন্ত্রের হয়ে দলনিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে তাদের হিমশিম খেতে হয়, গলদঘর্ম হতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়; যার ছত্রছায়ায় নানাভাবে অবৈধ অর্জন চলতে এর পথ সুগম হতে পারে। সেবক প্রভুতে পরিণত হলে সম্পদ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বারা অর্জিত অর্থ দখলের লড়াইয়ে অর্থায়িত হয়ে এভাবে একটি ঘূর্ণায়মান দুষ্টচক্র বলয় হয়ে থাকে; অর্থাৎ সুশাসনের অভাবে স্বচ্ছতার-অস্বচ্ছতায় ঘুরেফিরে পুরো প্রক্রিয়া বিষিয়ে তোলে। সুতরাং সব ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উচিত স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এটি প্রয়োজন গণতন্ত্র ও সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুশাসন স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে সত্যিকার উন্নয়ন হবে না। এটি পরস্পরের পরিপূরক।

স্বচ্ছতার-অস্বচ্ছতায় যে উন্নয়ন হয় তাতে জনগণের সুফল নিশ্চিত হয় না। এ উন্নয়নের কোনো উপযোগিতা বা রিটার্ন নেই। এটি একধরনের আত্মঘাতী ভেল্কিবাজি। ধরা যাক, একটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। সেটি নির্দিষ্ট তিন বছর সময়ের মধ্যে করার কথা এবং বরাদ্দ সেভাবে দেয়া আছে। কিন্তু সেটি শেষ করতে যদি ১০ বছর লেগে যায় এবং ৪০০ কোটি টাকা খরচের জায়গায় দ্রব্যমূল্য ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিজনিত অজুহাতে বা কারণে যদি প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করতে হয় সেটি সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দুর্বল পরিস্থিতির পরিচায়ক। আলোচ্য অর্থ দিয়ে একই সময়ে হয়তো আরো দু’টি একই প্রকৃতির অবকাঠামো সড়ক উন্নয়ন করা যেত। সময়ানুগ না হওয়া এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তিনটি সড়কের অর্থ খরচ করে একটি সড়ক নির্মিত হয়েছে। আরেকটি বিবেচ্য বিষয়- সড়কটি যথাসময়ে নির্মিত হলে (তিন বছর) পরিবহন খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উপযোগিতা সৃষ্টি হয়ে জিডিপিতে অবদান রাখতে পারত। যথাসময়ে নির্মাণ-উত্তর প্রাপ্য সেবা ও উপযোগিতার আকাক্সক্ষা হাওয়া হয়ে যাওয়ায় প্রাপ্তব্য উপযোগিতা মেলেনি যথাসময়ে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল কথা হলো, যে অর্থ ব্যয় করা হোক না কেন, সেই আয়-ব্যয় বা ব্যবহারের দ্বারা অবশ্যই পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হতে হবে। পণ্য ও সেবা উৎপাদনের লক্ষ্যে যে অর্থ আয় বা ব্যয় হবে সেটিই বৈধ। আর যে আয়-ব্যয় কোনো পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে না সেটি অবৈধ, অপব্যয়, অপচয়। জিডিপিতে তার থাকে না কোনো ভূমিকা। আরো খোলাসা করে বলা যায়, যে আয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনের মাধ্যমে অর্জিত হয় না এবং যে ব্যয়ের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয় না সে আয়-ব্যয় জিডিপিতে কোনো অবদান রাখে না। কোনো প্রকার শ্রম বা পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়া মওকা যে আয় তা সম্পদ বণ্টন বৈষম্য সৃষ্টিই শুধু করে না, সেভাবে অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ধার ধারা হয় না। ফলে তা সৃষ্টি করে আর্থিক বিচ্যুতি। এভাবে যে অর্থ আয় বা খরচ করা হয়, তা প্রকারান্তরে অর্থনীতিকে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে।

সবাই জানে টাকা সব সময় রঙিন। তবে যে টাকার আয় এবং আয়ের উৎস ঘোষণা না দিয়ে রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেয়া হয় বা যায়, যে টাকা অবৈধভাবে অর্জিত, সে টাকা কালো টাকা। মূলত এবং মুখ্যত এ কালো টাকা যেকোনো অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য, প্রতারণা-বঞ্চনার , অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যত্যয়ের প্রমাণক, অব্যবস্থাপনা দুর্নীতি ও ন্যায়নীতি-নির্ভরতাবিহীনতার সূচক এবং অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বিচ্যুতির মাধ্যমে সমূহ ক্ষতিসাধনের প্রভাবক ভূমিকা পালন করে এই কালো টাকা। কালো টাকা সাদা করার পদ্ধতি প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মতভেদ যাই-ই থাকুক না কেন, এর যথা বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার, সরকার পরিচালিত রাজনৈতিক অর্থনীতির নয়; কেননা কালো টাকা তো সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি, স্বচ্ছতা জবাবদিহি ও ন্যায়-ন্যায্যতা নীতি-নির্ভরতায় ব্যর্থতার প্রতিফল।

সাম্প্রতিক নজির থেকে দেখা যায়, তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার পর হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পেরেছে। এসব দেশ প্রথমপর্বে কালো টাকাকে প্রযতœ দিতে সাদা করাকে গুরুত্ব দিত, পরবর্তীকালে শক্ত হাতে কালো টাকার সৃষ্টির উৎস বন্ধ করার রাষ্ট্রীয় প্রতিবিধান জোরদার করায় সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতিসঞ্চার হয়েছে। আরো খোলাসা করে বলা যায়, যেমন- সুহার্তের ১৯৬৫-৯৮ সালের ৩৩ বছরের শাসনকে ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নতত্ত্বে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আখ্যায়িত হতো, গত বেশ কয়েক দশকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হওয়ায় সেখানে এখন অর্থবহ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে।

১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত কর আহরণ পদ্ধতি সংস্কার কর্মসূচির আওতায় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত অর্থনীতি থেকে কালো টাকা সাফ করার উদ্যোগ নিয়েছিল, দুর্নীতি দমনের ঘোষণা দিয়ে আসা সামরিক সরকার তা লেজেগোবরে করে ফেলে। সেখানে উদ্দেশ্য বিধেয়র মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ১৯৯৭ সালে ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনকাম স্কিম (ভিডিআইএস) এবং ২০১৫ সালে আনডিসক্লোজড ফরেন ইনকাম অ্যান্ড অ্যাসেটস (ইউএফ আইএ) অ্যান্ড ইমপোজিশন অব ট্যাক্স অ্যাক্ট জারি করে।

কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার অবস্থান নেয়াকে বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচনা হচ্ছে। সংবিধানের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’ সংবিধানের এ বিধানমতে ‘অনুপার্জিত আয়’ যদি কালো টাকা হয় তাহলে কালো টাকার সংজ্ঞা ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ এবং এ সংজ্ঞা দুর্নীতির সাথে কালো টাকার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে সেটিকে অনেকটাই গৌণ বা লঘু করে দিয়ে অর্থনীতিতে টাকা ও মেধা পাচার, করোনা ক্রেমলিন যুদ্ধকালেও কতিপয় (?) কোটিপতির আর্থিক নাশকতার তৎপরতা ও ক্ষমতা বেড়ে চলছিল।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement