২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে’

‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে’ - নয়া দিগন্ত

৫ আগস্ট অকুতোভয় ছাত্র-জনতার ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার কাছে পরাজিত হলো ভয়ঙ্কর এক দানব। শত শত শিশু-যুবক, ছাত্র-জনতার লাশের মিছিল বেয়ে এলো এ বিজয়। হাজারো ছাত্র-জনতার শাহাদত, আহত ও পঙ্গুত্ববরণে দেশের সবুজ প্রান্তর আবারো রক্তে লাল হলো।

দেশী হায়েনাদের হাতে এত হত্যা, অত্যাচার, রক্তক্ষরণ ও নৃশংসতা আগে আর ঘটেনি। এ দিক থেকে ব্যতিক্রমী এবারের বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালারা জলে-স্থলে, আকাশপথে ত্রিমুখী হামলা চালিয়েছিল নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, গুলি, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, গরম পানি নিক্ষেপ, সাউন্ড গ্রেনেড হামলা- কোনোটা বাদ যায়নি। তার পরও পার পায়নি। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার লৌহকঠিন একতার কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের বিস্মিত করে ‘চাচা আপন জান বাঁচা’ নীতিতে পালিয়ে বেঁচেছে শতাব্দীর সবচেয়ে হিংস্র স্বৈরশাসক। পেছনে রেখে গেছে অজস্র মায়ের আহাজারি, পঙ্গুত্বের হাহাকার এবং অনেক স্ত্রীর বৈধব্যের যন্ত্রণা- ধ্বংসের স্মৃতি।

এর আগে আমাদের দেশের কোনো সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। বারবার দেশের জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবন দেয়ার বুলি আওড়ানো-স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে জীবন বাঁচিয়ে প্রমাণ করলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেয়ে জীবন বাঁচানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে দল ও দেশ মূল্যহীন। তিনি পালিয়ে গেলেন; পেছনে রেখে গেলেন আয়নাঘর নামক কুখ্যাত বেদনাময় স্মৃতি। জাতিকে উপহার দিয়ে গেলেন গুম, খুন, দখলদারি, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিষবাষ্প। রেখে গেলেন ঘৃণা ও বিভাজিত জাতিসত্তা। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে যারা আজ নতুন আশার আলো ছড়াচ্ছেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নতুন দেশ গড়ার, তাদের হাজার সালাম।

এ বিজয় সোপান রচনায় যে তরুণরা তাদের তাজা রক্তে দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিয়েছেন, তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি । তারা সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্র্ধ্বে। পুরো জাতি তাদের রক্তের উত্তরসূরি। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের হত্যার দ্রুত বিচার হোক- এটি জাতির ঐকান্তিক কামনা। এই সংগ্রামে আহত লড়াকু সৈনিকদের যথাযথ মূল্যায়ন সময়ের দাবি। তারা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। জাতির মুক্তি ছিল তাদের দ্রোহের মূল কারণ। আজীবন তারা বয়ে বেড়াবেন নির্যাতনের এই চিহ্ন। এদের শুধু চিকিৎসার ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। সমাজে যথাযথ পুনর্বাসন জরুরি। সমাজে যেন তারা যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা আজ জাতির দায়িত্ব। তাদের সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা গেলে তারা হয়তো এক দিন এ আঘাত ভুলে যাবেন- কিন্তু ক্ষতের চিহ্ন বয়ে বেড়াবেন আজীবন। এর বাইরে আরো একধরনের আঘাতের শিকার হয়েছেন হাজারখানেক ছাত্র-জনতা। এরা আঘাত পেয়েছেন চোখে। বেশির ভাগ দুই চোখে।

বন্দুকের গুলিতে দৃষ্টি হারিয়েছেন। শুধু জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ও লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে চোখের আঘাতের চিকিৎসা নিয়েছেন ছয় শতাধিক। এর বাইরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে চোখে আঘাত পেয়ে চিকিৎসার জন্য যারা এসেছেন- হিসাব করলে তাদের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি।

লক্ষণীয়, এর আগে কখনো একসাথে এত তরুণ অন্ধ হয়ে যাননি। এবার কেন এত প্রাণক্ষয়ের সাথে সাথে দৃষ্টিক্ষয় হলো তা খুঁজে দেখা দরকার। এটি কি নিতান্ত ঘটনাক্রম নাকি অন্য কিছু! এ প্রশ্নের জবাব মেলা দরকার। কারণ এদের জীবনে এখন শুধু অন্ধকার। কয়েক মিনিট আগেও যে তরুণটি পৃথিবীর সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন, দেখেছেন বাবা-মা, ভাইবোনদের হাসিমুখ, বন্ধুদের সাথে নিষ্প্রাণ রসিকতায় হেসেছেন প্রাণখুলে- মাত্র মিনিটের ব্যবধানে তার চোখে শুধু অন্ধকার। হাজারো সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন তার কাছে হারিয়ে গেছে চিরতরে। তিনি আজ নিজের কাছে দায়, দায় পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে। যত দিন বাঁচবেন, সমাজের কাছে অনুগৃহীত হয়ে থাকতে হবে। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।

দেশের প্রয়োজনে জাতির প্রয়োজনে লড়তে এসে তার আজ এ অবস্থা। পৃথিবীর সৌন্দর্য, মায়ের হাসিমুখ, বোনের আদুরে চাহনি- সব আজ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়। এদের সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন। সাথে সাথে সামনের জীবনকে আবারো স্বপ্নের ঝলকানিতে উদ্ভাসিত করতে তাদের জন্য দরকার নতুন শিক্ষার আয়োজন। যেন তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায় হয়ে না থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে উৎপাদনের খাতায় নাম লেখাতে পারেন। নতুন জীবনের এ যাত্রা খুবই কঠিন। তবুও তাদের ঋণ পরিশোধে কর্তৃপক্ষকে এ যাত্রা শুরু করতে হবে। দৃষ্টিহীনতার অন্ধকারে ফুটিয়ে তুলতে হবে আলোর ভুবন। একই সাথে খুঁজে বের করতে হবে অপরাধীকে।

সম্ভব হলে অপরাধীর সম্পদ থেকে এদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। একটি বিকাশমান প্রতিভাকে আজীবন অন্ধকার জগতে ঠেলে দিয়ে অপরাধী আলোর জগতে জীবন উপভোগ করবে- এটি হতে পারে না।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement