এবার জঙ্গি নাটকের পর্দা উঠুক
- মাহমুদুর রহমান
- ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৬:০০, আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৬:১৪
ভারত, আমেরিকা, মইন-ফখরুদ্দিনের এক-এগারো সরকার, ডিজিএফআই এবং সামশুল হুদা-ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত-ছহুলদের নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে ২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে অবিশ্বাস্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তার আত্মজীবনীতে সেসব ষড়যন্ত্রের ইতিহাস লিখে গেছেন। দিল্লির অধীনস্থ দানব সরকারকে অনন্তকাল ক্ষমতায় রাখার অভিপ্রায়েই উল্লিখিত শক্তিগুলো তখন একজোটে কাজ করেছে। সেই বিতর্কিত নির্বাচনের কুশীলবদের একজন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বিপ্লবী সরকারের মহাপ্রতাপশালী উপদেষ্টা হয়েছেন দেখে বিস্মিত হই।
এভাবেই সুবিধাবাদীরা পুনর্বাসিত হয়। আশা করতে চাই, তার চরিত্র এত দিনে শুধরে গেছে।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ৫ আগস্টের এক মহান বিপ্লবে উৎখাত হওয়া পর্যন্ত মূলত জঙ্গিতত্ত্ব ফেরি করেই প্রায় ১৬ বছর শেখ হাসিনা তার অবৈধ ফ্যাসিস্ট শাসন বজায় রাখতে পেরেছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW)-এর বুদ্ধিপরামর্শেই কিছু দিন পরপর দানবে রূপান্তরিত র্যাব ও পুলিশ জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করেছে এবং প্রধানত গ্রামের দরিদ্র, অসহায় মানুষদের ধরে এনে নারী-শিশুসহ বোমা মেরে উড়িয়ে হত্যা করেছে। ১০ মাসেরও অধিক সময় ধরে চলমান গাজার গণহত্যা থেকে সারা বিশ্বের মানুষ দেখছে, পশ্চিমা শাসকদের কাছে মুসলমানের জীবনের কোনো মূল্য নেই। ১৬ সহস্রাধিক শিশু হত্যাতেও তাদের বিবেক বিন্দুমাত্র জাগ্রত হয় না।
তাই ভুয়া ইসলামী জঙ্গি দমনের অজুহাতে বাংলাদেশে হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যা করেও নরপিশাচ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসমেত ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত তাবৎ পশ্চিমা সরকারগুলোর বাহবা কুড়াতে পারে। শাপলা চত্বরে আলেমদের ওপর হাসিনার পদলেহী খুনি বেনজীর, আজিজ, জিয়ারা গণহত্যা চালিয়েছে। একাত্তরের পাকিস্তানি গণহত্যার বিচারের নামে জামায়াত ও বিএনপির ইসলামপন্থী নেতাদের ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হতে হয়েছে। হাসিনার এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে দিল্লি তো মহাআনন্দিত হয়েছেই, পশ্চিমাবিশ্বও অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে রেখে মুসলমান নিধনে উৎসাহ জুগিয়েছে। কথিত ইসলামী জঙ্গি ও ইসলামপন্থীদের নির্মমভাবে দমনের পুরস্কারস্বরূপ ওয়াশিংটন শেখ হাসিনাকে ক্রমেই একবিংশ শতকের সবচেয়ে অত্যাচারী শাসক হয়ে উঠতে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে মুসলিম বিশ্বে ঐতিহাসিকভাবে হাসিনার মতো ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসকদেরই আশকারা দিয়েছে। এ কারণেই মুসলিম বিশ্বের ৫৭টি দেশের মধ্যে আধা-ডজন গণতান্ত্রিক সরকারও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বিকশিত গণতন্ত্রকেও ২০০৭ সালে এক-এগারোর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিনাশ করা হয়।
আবু সাঈদ, মুগ্ধ এবং হাজারো শহীদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। মহান বিপ্লবীর উদাহরণ হিসেবে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ কিউবা বিপ্লবের নায়ক চে গুয়েভারাকে চেনে। অনেক তরুণ তার ছবি অঙ্কিত টি-শার্ট গায়ে দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়। আমরাও তরুণ বয়সে চে গুয়েভারার জীবনী পড়েছি। কিন্তু, এখন থেকে আমাদের কাছে পুলিশের উদ্যত রাইফেলের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো শহীদ আবু সাঈদই সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। বাংলাদেশের তরুণরা আমাদের আবারো এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, যেখানে মানবাধিকার রক্ষিত হবে, কোনো নাগরিককে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের শিকার হতে হবে না। কিন্তু, সেই গণআকাক্সক্ষার বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে গত ১৬ বছরে জঙ্গিবাদ দমনের নামে দেশে যত বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম হয়েছে তার সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিকভাবে বহুল আলোচিত এবং সীমাহীন বর্বরতার হোলি আর্টিজানের কথা বলা যেতে পারে। ইসলামী জঙ্গিবাদের নামে ২০১৬ সালে গুলশানের অত্যন্ত ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁয় যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তার প্রকৃত সত্য আমরা কি জানতে পেরেছি? অনেকে হয়তো বলবেন, আদালতে বিচার তো হয়েছে। হাসিনার আমলে সব আদালতে বিচারের নামে যে কেবলই নিষ্ঠুর অবিচার হয়েছে সেটি কি আমাদের অজানা? হোলি আর্টিজানের ঘটনার আমরা তো এ যাবৎ কেবল চরম অত্যাচারী ও সর্বৈব মিথ্যাবাদী এক ফ্যাসিস্ট সরকারের একতরফা বয়ান শুনেছি। এ প্রসঙ্গে এখানে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই :
১. কথিত ইসলামী জঙ্গিদের একজনকেও জীবিত রাখা হয়নি কেন, যার কাছ থেকে আমরা সেই রাতের ঘটনার ভিন্ন ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা পেতাম?
২. প্রকৃত ঘটনার তদন্তের জন্য কেন জাতিসঙ্ঘ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার সাহায্য নেয়া হয়নি?
৩. সে রাতে রেস্তোরাঁয় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ আজ পর্যন্ত কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ জনসমক্ষে কেন তুলে ধরেননি?
৪. ভারতে হোলি আর্টিজান নিয়ে হিন্দি ভাষায় যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেখানে প্রধানত প্রথম আলো গ্রুপের মালিকপক্ষের সন্তানকে নায়ক সাজানোর বয়ান ব্যবহার করা হয়েছে। সে রাতের নৃশংসতার অন্য আরেক তরুণ ভিক্টিমের মা প্রথম আলোর সেই একতরফা বয়ানকে বানোয়াট দাবি করেছেন। তিনি ভারতে এবং বাংলাদেশে সেই বয়ানের বিরুদ্ধে সাধ্যমতো লড়াই করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ জানেন, এ দেশে ইসলামবিদ্বেষী এবং হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি ও বয়ান প্রসারে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার গ্রুপ সর্বদাই বিভীষণের ভূমিকা পালন করে। এই জাতীয় মিডিয়ার কর্মকাণ্ডের ফলেই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় হেজেমনি শিকড় গাড়তে পেরেছিল। এই পত্রিকা সবসময় চোখবুঁজে শেখ হাসিনার বানোয়াট ইসলামী জঙ্গি বয়ানে সমর্থন দিয়েছে। ইসলামবিদ্বেষের মাপকাঠিতে শেখ হাসিনা, ভারতের মোদি সরকার ও প্রথম আলো গ্রুপের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
আমাদের ভুললে চলবে না, প্রথম আলো শাপলা চত্বরে মাদরাসার দরিদ্র ছাত্র ও আলেমদের ওপর নির্মম গণহত্যার পক্ষে ছিল। সেই গণহত্যাকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এবং বর্তমান উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সব নিপীড়নকেও ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো সমর্থন করেছে, বৈধতা দিয়েছে। সুতরাং, ইসলাম ও মুসলমানের যেকোনো বিষয়ে প্রথম আলোর বয়ান বিনাবাক্যে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে।
নৃশংসতার বিবেচনায় হোলি আর্টিজান সবচেয়ে বীভৎস হলেও বিভিন্ন সময়ে আরো অনেক জঙ্গির গল্প ফাঁদা হয়েছে। যখনই সরকার কোনো বিপদে পড়েছে তখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য নতুন নতুন জঙ্গি আবিষ্কার করেছে হাসিনার দানব পুলিশ। স্মৃতি থেকে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি।
২০১৬ সালের ২৬ জুলাই খোদ ঢাকার কল্যাণপুরে জঙ্গি বানিয়ে ‘জাহাজবাড়িতে’ ৯ জন নিরপরাধকে হত্যা করা হয়। সে সময় আমি কারাবন্দী। সেখানেই আমাকে এক সোর্স জানিয়েছিল, হতভাগ্যদের সবাইকে ডিবি থেকে এনে শেখ হাসিনার নির্দেশে ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়।
২০১৭ সালের ২০ মার্চ চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানা নামে দুই বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। একই বছর ৩১ আগস্ট যশোরে একই রকম নাটক সাজিয়েছিল। ৯ জুন ২০২৪ নেত্রকোনায় কথিত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলে। ২০২৪ এর ২ জুলাই নারায়ণগঞ্জে সর্বশেষ জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ হয়। চলতি বছরের নাটক দু’টি করা হয়েছিল ৭ জানুয়ারির ‘ডামি নির্বাচন’ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য। অবশ্য এতে কাজ হয়নি, কারণ অতি ব্যবহারে জীর্ণ স্ক্রিপ্ট আর বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।
গত ১৬ বছরে অন্তত শ’খানেক এমন নাটক করা হয়েছে যাতে বহু নিরপরাধ, দরিদ্র মানুষকে হত্যা করেছে স্যাডিস্ট হাসিনা সরকার। এখন সময় হয়েছে সব হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে শেখ হাসিনাসহ সব অপরাধীকে সাজা দেয়ার। ড. ইউনূস এবং তার উপদেষ্টা পরিষদের কাছে সব জঙ্গি নাটকের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য জাতিসঙ্ঘকে সম্পৃক্ত করে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি। বর্তমান সরকারে আদিলুর রহমান খানের মতো মানবাধিকারকর্মী থাকায় আমরা আশা করছি, কোনোরকম কালক্ষেপণ ব্যতিরেকে এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লেখক : সম্পাদক, আমার দেশ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা