২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মুসলিম যৌথবাহিনী গঠনে বিড়ম্বনা

মুসলিম যৌথবাহিনী গঠনে বিড়ম্বনা - ছবি : সংগৃহীত

গাজা যুদ্ধের নির্মমতা, গণহত্যা ও ভয়াবহতায় ক্ষুব্ধ তুরস্ক আবারো মুসলিম যৌথবাহিনী গঠনের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে। এমনো বলেছে যে, মুসলিম যৌথবাহিনী বা আর্মি অব ইসলাম গঠিত না হলে সে আর অপেক্ষা করবে না। এককভাবে ইসরাইলে হামলা চালাবে।
তুরস্ক ২০১৮ সালে মুসলিম দেশগুলোকে আর্মি অব ইসলাম গঠনের আহ্বান জানায়। ২০২৪ সালেও জানাল। তুরস্কের প্রস্তাবে যা আছে :

এই সেনাবাহিনীতে পাঁচ মিলিয়ন বা ৫২ লাখ ছয় হাজার ১০০ সেনা থাকবে। ওআইসিভুক্ত ৫৭টি দেশ এতে অংশ নেবে। সব দেশ থেকে প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করা হবে। প্রথম আড়াই লাখ সৈন্য গাজা অপারেশনে অংশ নেবে। মুসলিম দেশগুলোর কৌশলগত বিমান ও নৌঘাঁটি যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। অতি দ্রুত নতুন যৌথ সামরিক বেস, বিমান ঘাঁটি ও নৌবন্দর তৈরি করা হবে এবং ইসরাইল পর্যন্ত যোগাযোগ রুট তৈরি করা হবে। এরদোগান অনেক আগেই বলেছিলেন, ‘আমরা জেরুসালেমকে রক্ষা করতে না পারলে মক্কা-মদিনাও রক্ষা করতে পারব না।’ মুসলিম বাহিনী গঠিত হলে এটিই হবে বিশ্বে সবচেয়ে বড়। ন্যাটোর আদলে এই বাহিনীকে আধুনিকায়ন করে সাজানো হলে এটি শত্রুদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।

ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে আল-আকসায় আগুন লাগানোর ঘটনায়। তাই জেরুসালেমের পবিত্রতা রক্ষা, ফিলিস্তিনিদের রাজধানী করা ওআইসির দায়িত্ব। প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে, প্রথম আঘাতের জন্য এক হাজার ট্যাঙ্ক ও অস্ত্রসজ্জিত সামরিক যান, ১০০ বিমান ও ৫০০ অ্যাটাক হেলিকপ্টার, কয়েক হাজার মিসাইল, সমপরিমাণ ড্রোন এবং ৫০টি যুদ্ধজাহাজ প্রয়োজন হবে। মুসলিম দেশগুলোর যৌথভাবে এসব সরবরাহ করা কোনো সমস্যা নয়। একা তুরস্কেরই পাঁচ হাজারের উপর ট্যাঙ্ক রয়েছে। দু’টি দেশ পরমাণু শক্তিধর।

গাজায় যদি আদৌ একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতি বা শান্তিচুক্তি হয়, তাহলে যুদ্ধপরবর্তী গাজায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় একটি আরব নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে সম্মত হয় মিসর। চলতি বছরের জুনে বাহরাইনে আরব শীর্ষ সম্মেলন বসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে আলোচনা চলাকালে মিসর গাজা উপত্যকায় আরব নিরাপত্তা বাহিনীতে অংশ নিতে সম্মত হয় এই শর্তে যে, গাজা থেকে ইসরাইলী বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে। অর্থাৎ মিসর ইসরাইলের সাথে কোনো ধরনের যুদ্ধে যেতে রাজি নয়। গাজা থেকে ইসরাইলী সেনার সম্পূর্ণ প্রত্যাহার অনেকটা দুরাশা। নেতানিয়াহু কোনোভাবেই গাজা ছাড়তে নারাজ। প্রয়োজনে গাজাকে বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে চান তিনি। যার বেশিটা ইতোমধ্যে করেছেন। ইসরাইল আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে সচেতন এবং আমিরাত, জর্দান, বাহরাইন, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি নেতাদের সাথে দেশটি এ বিষয়ে আলোচনা করেছে।

মিসরের শার্ম আল-শেখে ২৮ মার্চ ২০১৫ সালে আরব শীর্ষ সম্মেলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফলাফল ছিল ‘দ্রুত সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য যৌথ আরববাহিনী’ গঠনে সম্মতি। মিসরই এই প্রস্তাব করে। এই বাহিনীকে প্রাথমিকভাবে দ্রুত সামরিক মিশনে পাঠানো হবে, যাতে প্রশ্নবিদ্ধ দেশগুলোর অনুরোধে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি ও সদস্য দেশগুলোর সুরক্ষা এবং সাধারণভাবে আরব জাতীয় সুরক্ষার হুমকি মোকাবেলা করা যায়। মিসর এই প্যান-আরব ফাইটিং ফোর্স ধারণার পথিকৃৎ।

এই জাতীয় সামরিক জোটের প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত দিক রয়েছে এবং সদর দফতর, নেতৃত্ব, সদস্য, বাজেট এবং ভৌগোলিক পরিধি উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টর। দুই মাস ধরে মিসরের আল-সিসি এই ধারণাটি এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। প্রাথমিকভাবে সিসির প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো হয়নি এবং বেশ কয়েকটি মিত্রসহ অনেক আরব দেশ এটি প্রত্যাখ্যান করে।

ইয়েমেনের সঙ্কট এবং ইরান সমর্থিত হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে, একটি যৌথ আরববাহিনীর ধারণা ভিত্তি পায় এবং শেষ পর্যন্ত আরব লিগও সেটি অনুমোদন করে। আরব শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী, আরব দেশগুলোর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য যেকোনো হুমকি মোকাবেলা করবে এই বাহিনী। এখানে একটি যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, ইসরাইল কি লক্ষ্যবস্তুর আওতার মধ্যে পড়ে, নাকি অন্য কোনো দেশ? সদস্য দেশগুলো যদি টার্গেট ও শত্রুদের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে তাহলে কী হবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কী হবে যদি কোনো সদস্য রাষ্ট্রই হুমকির উৎস হয়ে ওঠে? অথবা কোনো দেশে যদি অভ্যুত্থান হয়, সেখানে কি কাজ করবে? যৌথ আরববাহিনী কি কোনো অভ্যুত্থান দমন করবে, নাকি জনগণের পক্ষ নেবে? কে এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব দেবে, মিসর, সৌদি আরব বা অন্য কোনো দেশ? কীভাবে বাছাই হবে এই দেশ? মিসর বা সৌদি আরবের সাথে মতবিরোধ আছে এমন আরব দেশগুলো কি এটি মেনে নেবে?

নেতৃত্ব ঘিরে এই অস্পষ্টতা সদর দফতর সম্পর্কেও প্রশ্নের জন্ম দেয়। বাহিনীগুলোকে আশ্রয়দাতা দেশ কীভাবে বেছে নেয়া হবে? কিসের ভিত্তিতে? সদর দফতর কি প্রতিটি দেশের অংশগ্রহণের আকারের উপর ভিত্তি করে বা এটি যে হুমকি এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তার মাত্রার উপর ভিত্তি করে তৈরি হবে?

এমন আরো অনেক গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট যে, বিষয়টি খুব সহজ নয়। এই যৌথবাহিনীর ভৌগোলিক ও কৌশলগত পরিধি নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে এবং এর পদক্ষেপ কি কেবল আরব অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি আরো প্রসারিত হবে-যেমন ইরান পর্যন্ত! কোন কর্তৃপক্ষ বাহিনীর কাজের ধরন ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করবে?

শীর্ষ সম্মেলনের রেজ্যুলেশনে উদ্ধৃত করা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো’। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক প্রক্সি বাহিনী কাজ করে, এখানে সন্ত্রাসী কারা? সন্ত্রাসী তকমার রাজনীতিকরণ করা হবে না এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হবে না তার গ্যারান্টি কি? এসব প্রশ্ন থেকে বোঝা যায়, বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়নি।

সৌদি আরব ও মিসরের মধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে আরব বাহিনী গঠন ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে থেকে গেছে। এর আগেও অনুরূপ বাহিনী গঠনের চেষ্টা নিষ্ফল হয়েছিল। এমন প্রেক্ষাপটে তুরস্কের নেতৃত্বে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ফিলিস্তিনে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করতে চায় অনেক মুসলিম দেশ। আরব দেশগুলো গাজা ও পশ্চিম তীরে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাবে একমত। অন্যদিকে, গাজা ইস্যুতে তুরস্কের প্রভাব নিয়ে আরব দেশগুলো উদ্বিগ্ন। তুরস্ক যুদ্ধের প্রথম দুই মাসে আরবদের কাছে গাজার জন্য একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটি যুদ্ধের ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও সেলফে পড়ে আছে।

আরব দেশগুলো মনে করে, আঙ্কারা গাজার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, নিজেকে কেন্দ্রীয় খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু গাজায় শান্তির অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই এরদোগান বিষয়টি উঠিয়ে এনেছেন। এরদোগান জানান, ইস্তাম্বুল সব পক্ষের আলোচনার জন্য প্রস্তুত। ইরান এতে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ আরব দেশ এরদোগানের চেষ্টা নিয়ে সন্দিহান। ফলে আরববাহিনী বা মুসলিম যৌথবাহিনী, কোনোটিই সফল হয়নি। ইসরাইলকে প্রতিহত করতে তুরস্ক একাই রণাঙ্গনে আছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement