কোথায় যাচ্ছি, কী হচ্ছে, কিছুই বুঝছি না
- গোলাম মাওলা রনি
- ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০৬:১৮
আগস্ট মাসের ৭ তারিখ বিকেলে এই নিবন্ধ লিখছি। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ঘটনাপুঞ্জ আমাকে কতটা বিপর্যস্ত করে তুলেছে তা আমি আপনাদেরকে বলে বা লিখে বোঝাতে পারব না। গত কয়েক দিন ধরে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। গত এক মাসেরও অধিক সময় ধরে নির্ঘুম রজনী। প্রতিদিন শত শত কেন, সবারই পরামর্শ- পালিয়ে থাকুন, বাইরে যাবেন না, কথা বলবেন না, কোনো কিছু লেখার দরকার নেই। ওরা আপনাকে টার্গেট করেছে। তুলে নিয়ে যাবে। মেরে ফেলবে, গুম করবে, আয়না ঘরে ঢুকিয়ে দেবে- ইত্যাদি আরো কত কী।
উল্লিখিত নেতিবাচক কথাগুলো শুনেছি আর স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে দৈনিক ১৮-২০ ঘণ্টা শ্রম করতে গিয়ে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে গেছি। সকালে অফিসে এসে সারা দিন কাজ। তার পর রোজ রাতে একাধিক টকশো শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে কোনো রাতে ১২টা বেজে যেত এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ১টা থেকে দেড়টা অবধি সময় লেগে যেত। হাত-মুখ ধোওয়া, খাওয়া শেষে বিছানায় যেতে যেতে রাত ৩টা বাজত। এভাবে ৫ আগস্ট রাত অবধি কাজ করে শরীরের অবস্থা এতটা বেহাল করে ফেলেছি, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
গত এক মাসে শরীর-মন-মস্তিষ্কের মধ্যে ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ চলেছে। যা দেখেছি তা ভাবতে পারিনি- যা করেছি তার সাথে ভাবনা এবং চোখের দেখা ঘটনাবলির মিল ছিল না। সাহস-দুঃসাহস কিংবা নির্বুদ্ধিতা যে যাই বলুন না কেন, স্রোতের বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে রাত-বিরাতে একা চলাফেরা যে মানুষের ঘুম কিভাবে কেড়ে নেয় এবং কিভাবে মানুষের বুদ্ধি চিন্তা-সিদ্ধান্ত ও কর্মকে প্রভাবিত করে তা চলমান সঙ্কটের মধ্যে না পড়লে বুঝতে পারতাম না।
আমার কর্মের অধিক্ষেত্র-পরিচিতি এবং জানা-শোনার কারণে প্রতি মুহূর্তে পরস্পরবিরোধী খবর পাচ্ছি। পরস্পরবিরোধী ঘটনা দেখছি এবং আলোর পেছনে অন্ধকার ও অন্ধকারের পেছনে আলোর ঝলকানি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আওয়ামী লীগের হাঁড়ির খবর, বিএনপি-জামায়াতের অভ্যন্তরীণ ঘটনা ছাড়াও সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সুশীলসমাজ এবং আম-জনতার নিত্যদিনের আবেগ-অনুভূতি, দুঃখ, কষ্ট ও দুর্দশার বাস্তব চিত্র জানার পর নিজস্ব কথা ও কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে অভীষ্ট লক্ষ্যে আগানোর চেষ্টা করতে গিয়ে যখন দেখছি, বেশির ভাগ মানুষ বিশেষত কর্তাব্যক্তিরা কেবল ভুলের পাহাড় রচনা করে চলেছে, তখন অসহায়ের মতো চেয়ে দেখার বাইরে কি-ই বা করার আছে।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিন খুব সকালে বাসা থেকে বের হলাম। সারা দেশে কারফিউ। ঢাকার আকাশে মুষলধারে বৃষ্টি। ছাতা মাথায় একাকী হাঁটছি। শুধু মাথা ছাড়া সারা শরীর বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে একাকার। নিউমার্কেটের সামনে দেখলাম একটি রিকশাও চলছে না। আরো কিছুদূর হাঁটার পর এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাকে পেলাম এবং অভয় দিয়ে তাকে রাজি করালাম। একের পর এক সামরিক যান ছুটছে আর কৌতূহল নিয়ে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা এবং যাত্রীর দুঃসাহস দেখেছে। নীলক্ষেত মোড়ে এসে দেখলাম সব পথ বন্ধ। আমার কথায় রিকশাওয়ালা মুরুব্বি একটি ব্যারিকেড সরিয়ে সামনে এগোতে চেষ্টা করলেন। অদূরে দাঁড়ানো শত পুলিশের দল বন্দুক লাঠি উঁচু করল এবং সমস্বরে চিৎকার শুরু করল। রিকশাওয়ালা জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা।
আকাশ ফেটে বৃষ্টি ঝরছে। আমার রিকশা এবং নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় গেটের দূরত্ব কয়েক ফুট। পুলিশের দল যাত্রীকে চিনতে পারছে না। আমার চিৎকারও সে দিনের দূরত্ব ও বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে পুলিশের কানে পৌঁছাচ্ছে না। আমি হাত নেড়ে যতই আত্মসমর্পণের চেষ্টা করছি ততই পুলিশ ক্ষেপে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল ওরা এই বুঝি গুলি করে দেয়। এমতাবস্থায় কয়েকটি সামরিক যান পলাশী থেকে কাঁটাবনের দিকে যাচ্ছিল। আমি সুযোগ বুঝে নিজেকে আড়াল করার কয়েক সেকেন্ড সময় পেলাম এবং দ্রুত পলাশীর দিকে রিকশার গতি বাড়িয়ে দিলাম। এভাবে প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের দুর্বিষহ যুদ্ধযাত্রা শেষ করে তোপখানা মোড়ের অফিসে এসে পৌঁছালাম।
অফিসে এসে দেখি ইন্টারনেট বন্ধ। এমনকি আমার ফোন নম্বরটিও জ্যাম করে দেয়া হয়েছে। বারবার কল ড্রপ হচ্ছে। বিকল্প অন্য একটি নম্বর দিয়ে কর্তাব্যক্তিদের কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা, তখনো শেখ হাসিনা পালিয়ে যাননি। তবে বেলা ২টায় সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন- এমন খবর টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে। আমি তাদের বললাম, ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে কেউ সেনাপ্রধানের কথা শুনবে না। প্রথমত, সরকার নিয়ন্ত্রিত টিভি কেউ দেখে না, বিশ্বাস করে না। দ্বিতীয়ত, বেশির ভাগ টিভি বিশেষত অভিজাত এলাকার বাসিন্দারা পুরোনো কেবল পদ্ধতির পরিবর্তে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিভি দেখে। ফেসবুক-ইউটিউবের খবর ছাড়া কেউ এখন আর সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে পারে না।
আমার উল্লিখিত কথোপকথন টনিকের মতো কাজ করল। দুপুর পৌনে ১টার দিকে ইন্টারনেট এবং সামাজিকমাধ্যম চালু হয়ে গেল। দুপুর ১টার মধ্যে আমি একটি ভিডিওর মাধ্যমে দেশবাসীকে সরকারের পদত্যাগের কথা জানালাম। দুুপুর ২টায় শেখ হাসিনা পলায়ন করলেন। ৩টার দিকে পালানো গুঞ্জন চাউর হলো। এরপর গণভবনের দরজা খুলল আর তৈরি হলো গণঅভ্যুত্থানের নতুন ইতিহাস। রাত ৯টার সময় হেঁটে বাসার দিকে রওনা হলাম। রাস্তায় শত শত মানুষের উচ্ছ্বাস। আমাকে দেখে লোকজনের সে-কি আনন্দ। মানুষের ভিড়ে আমার তখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তরুণরা দৌড়ে একটি রিকশা ডেকে এনে আমাকে তুলে দিলো। কিন্তু ছবি তুলতে আগ্রহী জনতা রিকশার পেছনে ছুটল। অনেক মোটরসাইকেল পাহারা দিয়ে আমাকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। আমি রিকশার হুড তুলে নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পেতে পেতে এগোতে থাকলাম এবং সকাল ১০টায় যখন অফিসে আসছিলাম সেই স্মৃতি মনে করতে থাকলাম।
উল্লিখিত ঘটনার পর বাসায় ফিরে দেখি সেখানে ঈদের আনন্দ চলছে। সবাই খুব খুশি। কিন্তু কেন জানি আমি খুশি হতে পারলাম না। সে রাতেও ঘুম হলো না। একটু পরপর বিভিন্ন মহল থেকে ফোন পাচ্ছিলাম এবং সারা দেশে ঘটমান বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, অগ্নিকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ডসহ নানা অঘটনের খবর ও সচিত্র প্রতিবেদন দেখার জন্য বারবার সামাজিকমাধ্যমে উঁকি দিচ্ছিলাম এবং প্রচণ্ড অস্থিরতা ও অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। ৬ আগস্ট সারা দিন অফিস করলাম এবং আজকের দিনে এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত এমন একটি সুসংবাদ পেলাম না, যা কি না নাগরিক হিসেবে আমার অস্থিরতা দূর করতে পারে।
নিবন্ধ লিখতে লিখতে জানলাম ড. ইউনূসের শ্রম আদালতের মামলাটির আপিল গ্রহণ করে তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরে নতুন আইজি এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকের গোপন খবর জানলাম। সচিবালয়, বিচারালয় এবং ক্যান্টনমেন্টের অনেক গোপন খবর জানলাম। রাজপথে তরুণদের দায়িত্ব পালন, বিএনপির সমাবেশ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে তোড়জোড়ের সাথে দিল্লি-ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক তৎপরতার কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। ফলে বিজয় অর্জন করার পরও আমার অস্থিরতা থামছে না, আতঙ্ক কাটছে না এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশা দূর হচ্ছে না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা