২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জাতি গঠনে শিশু সংগঠন

জাতি গঠনে শিশু সংগঠন - নয়া দিগন্ত

আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক। এর আলোকে বিভিন্ন দেশ নিজস্ব আঙ্গীকে নিজ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বলয়ে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন বৈচিত্র্যধর্মী সৃজনমুখী কার্যক্রম নেয় শিশুদের জন্য। উদ্দেশ্য একটাই- দেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ধারা, নীতি-নৈতিকতা ধর্মীয় জীবনবোধ ও জীবনাচারের আলোকে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের গড়ে তোলা।

ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে জাতির যোগ্য কর্মধারা করে গড়ে তুলতে নানা দেশের বিভিন্ন জাতির রয়েছে নির্দিষ্ট কার্যক্রম। এর মধ্যে অন্যতম শিশু সংগঠন। এ সংগঠনগুলোর ব্যাপ্তি দেশের প্রত্যন্ত থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত। জাতীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত ভূমিকা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শিশু-কিশোর সংগঠনের। উদ্দেশ্য একটাই- পৃথিবীর পরিবেশ, প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ এসবের সাথে শৈশব থেকে শিশুমানসের পরিচিতিবোধ গড়ে তোলা। নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিক গুণাবলি পাঠ্যক্রমবহির্ভূত শিক্ষা-নেতৃত্ব-আনুগত্য, দলীয় শৃঙ্খলাবোধ, দেশপ্রেম নৈতিকতা, মানবিক গুণাবলি ও সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততা মূল উপজীব্য এ শিশু-কিশোর সংগঠনগুলোর। শিশুদের মনোদৈহিক কর্মক্ষমতার বিকাশে এসব সংগঠনের রয়েছে বিশেষ কার্যক্রম। রয়েছে সুনাগরিকের বৈশিষ্ট্য এবং কল্যাণধর্মী চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশ প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে পরিপুষ্ট করার প্রচেষ্টা। প্রায় প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শিশু প্রতিনিধিরা জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন। তাদের চিন্তাধারা পৃথিবীর ডাকসাইটে নেতাদের সামনে উপস্থাপন করছেন। এ ধরনের কার্যক্রম শিশুদের মনে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে, তৈরি করে ভবিষ্যত নেতৃত্বের গুণাবলি, বিকশিত করে দেশ এবং পৃথিবীর সমস্যা নিয়ে ভাবার মানসিকতা।

বিভিন্ন ধরনের শিশু-কিশোর সংগঠনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি, আনুগত্য, দেশপ্রেম শৃঙ্খলাবোধ এবং কল্যাণধর্মী মানসিকতা সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাস ও সহযোগিতার মনোভাব। এ ধরনের চেতনা সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর প্রতিষ্ঠান বয়স্কাউট, গার্লস গাইড; রোভার স্কাউট কাজ করে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এর বিস্তৃতি আমাদের দেশে খুব সীমিত। বর্তমানে এর কার্যক্রম সরকারি জেলা স্কুলগুলোতে সীমিত আকারে দেখা যায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এর অস্তিত্ব নেই বললে চলে। ফলে এর প্রভাব সমাজে অনুভূত হয় না। এছাড়াও শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কাব এবং ব্লুবার্ডের নাম এখন শোনা যায় না। প্রকৃতপক্ষে বয়স্কাউট ও গার্লস গাইডের মতো সুশৃঙ্খল শিশু-কিশোর সংগঠনের সৃষ্টিধর্মী ভূমিকা থেকে বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বলতে গেলে একরকম বঞ্চিত। এর বাইরে স্বাধীনতার আগে ও পরে শিশুদের কল্যাণধর্মী ভূমিকায় উৎসাহিত করার চেষ্টা যে একেবারে হয়নি তাও নয়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এর কোনো কোনোটি বন্ধ হয়ে গেছে, কোনো কোনোটি এখনো অতি কষ্টে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

দেশের নিবন্ধিত শিশু-কিশোর সংগঠন রয়েছে সহস্রাধিক। কিন্তু এগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ে না। কারণ, এসব শিশু-কিশোর সংগঠনের কার্যক্রমের সাথে খেলার মাঠ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা দেশে খেলার মাঠগুলো যেভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে এর প্রভাবে শিশু-কিশোররা খেলাধুলার কথা ভাবতে পারছে না। খেলার মাঠ প্রতিটি স্কুলের স্বীকৃতির অবিভাজ্য শর্ত। সারা দেশে কতগুলো স্কুলে খেলার মাঠ আছে? শহরের নামীদামি স্কুলগুলোর ক’টিতে রয়েছে খেলার মাঠ? স্বাধীনতা পূর্বকালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ, সাঁতার কাটার পুকুর থাকলেও ইদানীং এসব মাঠ এবং পুকুরে বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করে সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে। স্কুলে শিশুরা নিয়মিতভাবে শরীর চর্চার সুযোগ পাবে- খেলাধুলা করবে, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শারীরিক এবং মানসিক যোগ্যতা অর্জন করবে, ভবিষ্যতে সুস্থ জাতি এবং প্রাণবন্ত সৃষ্টিমুখী নেতৃত্ব তৈরি হবে- এ স্বপ্নে আজ গুড়েবালি। পাড়া এবং গ্রামের অবস্থা আরো করুণ। এখানকার মাঠগুলো হয় আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে নতুবা হাটবাজারে রূপান্তরিত হয়েছে।

বাস্তবে শিশু-কিশোরদের বিনোদনের ক্ষেত্রটি আমরা ক্রমে সঙ্কুুচিত করে ফেলেছি। স্কুল-কলেজে আগে আয়োজিত হতো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন উপলক্ষে বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, গল্প লিখন, বিতর্ক অনুষ্ঠান- এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানসিক প্রতিভার বিকাশের পথ আজ রুদ্ধ। এখন বিনোদন বলতে আকাশপথে আসা ভিনদেশী অনুষ্ঠান। এসবের মোহে পড়ে শিশুরা আজ নীল ছবির ভয়াল ছোবলে আক্রান্ত। অজান্তে তারা অনলাইন জুয়ার জড়িয়ে যাচ্ছে। আত্মকেন্দ্রিক এবং ভয়ঙ্করভাবে স্বার্থবাদী হয়ে উঠছে। নিজেরা তৈরি করছে কিশোর গ্যাং। এরা সমাজ, সামাজিক জীবনবোধ, পরিবার ও পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। এরা যেন আমাদের নিজ গৃহে ভিনদেশী আগন্তুক।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিশু-কিশোর সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা দিয়ে, সাহায্য দিয়ে সামনে আনতে হবে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুবিধা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। শিশু মন্ত্রণালয়, শিশু অধিদফতরকে শিশুবান্ধব করে ঢেলে সাজাতে হবে। শিশু-কিশোর সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার নয়, প্রকৃত দেশপ্রেমিক কর্মযোগী নাগরিক তৈরির পথে পরিচালিত করাটা এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement