দেশ জাতি রাষ্ট্র
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৬:১২
জাতি হিসেবে আমরা দীন বলে কখনো কখনো অভিযুক্ত হয়েছি বটে, কিন্তু দ্বৈধতার অভিযোগ সবসময় আমাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আমাদের বদনাম এরকম যে, ‘We don’t act, but react’. জনগোষ্ঠী সম্পর্কে যদি এরকম মন্তব্য হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রতিভূ, সরকার সম্পর্কে বিপরীত ধারণা হবে কিভাবে? ১৯৫২ সালে উর্দু চাপিয়ে দেয়ার পর আমরা বলেছি, মানি না, মানব না। এ দেশে যত শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়েছে, প্রতিবারই আমরা বলেছি, ‘মানি না মানব না’। গণতন্ত্রের জন্য আমরা আকাশ বিদীর্ণ করি কিন্তু আমাদের হৃদয়ে গণতন্ত্র নেই। এই জাতির পিতৃপুরুষ গণতন্ত্রের জন্য জীবন বাজি রেখেছেন।
অবশেষে সেই গণতন্ত্র বাকশালে বিলীন হয়েছে। আমরা সামরিকতন্ত্রের গুরুতর বিরোধী। সেই সামরিকতন্ত্র আমাদেরই কারণে আরোপিত হয়েছে। কখনো কখনো আমরা সামরিকতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়েছি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গণ অভ্যুত্থান হয়েছে। সেই গণতান্ত্রিক শাসনামলে গণতন্ত্র সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে। এক-এগারোর অবসানে নিজ নিজ ম্যানিফেস্টোতে রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আর কাজ করেছি ঠিক তার উল্টো। আমরা যা করি, তা বলি না। আর যা বলি, তা করি না- এরকম কথা সততই আমাদের জনচিত্তে স্বীকৃত আছে। এই সামান্য সূচনা কথা আমাদের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য।
ঘটনার পটভূমি দেখা যাক। ২০১৮ সালে যখন কোটা আন্দোলন বেগবান হয়, তখন সরকারপ্রধান কোনোরকম জনমত যাচাই-বাছাই, গবেষণা-সমীক্ষা ও পরিকল্পনা-পরিবিশ্লেষণ বাদেই একক ঘোষণায় তা বাতিল করেন। চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল ঘোষিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধান স্বীকৃত অনগ্রসর কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা ও নারী কোটা। আরো রয়েছে সংবেদনশীল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। মুক্তিযোদ্ধা বা পরবর্তী প্রজন্ম অনগ্রসর না হলেও জাতির সম্মান, সমীহ পাওয়ার যোগ্য। অবশ্য অনেক মহৎ মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন, সুখ-সুবিধার জন্য তারা জীবনপাত করেননি। তবে প্রথম থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা শুরু করায় সেটি একটি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ৫০ বছর পরে অনেকেই বেঁচে নেই। কিন্তু ৩০ শতাংশ কোটা রয়েই যায়।
’১৮ সালের আন্দোলনকারীরা কোটা প্রথার বাতিল চাননি, সংস্কার চেয়েছিলেন। ক্ষোভ দেখা দিলো তখনই যখন আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটার যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করে। তারা নাতি-পুতি-ছাতি পর্যন্ত কোটা সম্প্রসারণ করে। আসলে মুক্তিযোদ্ধার নামে ওই কোটা আওয়ামী কোটায় পরিণত হয়। বদনাম এই যে, আওয়ামী লীগের তরফ থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে দীর্ঘ তালিকা প্রেরিত হতো পিএসসিতে। কোটা আন্দোলনের পর যখন এর সুযোগ উবে গেল, তখন ছাত্রলীগ তথা প্রজন্ম লীগে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিলো। কোটা বাতিলের যে মামলাটি নিয়ে তারা হাইকোর্টে রিট করেছিল, তা ছিল শাসকদলের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত। তারা একদিকে সব কোটা বাতিল করল, এখন লোকদের খুশি করার জন্য নিজেদের সিদ্ধান্তকেই চ্যালেঞ্জ করল।
সব কোটাই তো তাদের। সুতরাং রায় এলো প্রত্যাশা মাফিক। তখন তারা হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানাল। এখন যখন কোটা আন্দোলনে বেসামাল অবস্থা, তখন তারাই এখন বলছে, হাইকোর্টের আদেশটি নাকি এখতিয়ারবহির্ভূত ছিল। সরকারি নীতিগত সিদ্ধান্তে আদালত কোনো মতামত দিতে পারে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা কোটা আন্দোলন যখন তীব্রতা অর্জন করল, তখন তারা কোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করল।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের তারিখ বেশ দূরে নির্ধারিত হলো। আন্দোলনটি যখন আরো তীব্রতা অর্জন করল তখন আওয়ামী লীগ সরকার ভোল পাল্টে ফেললো। আন্দোলনের শুরুতে যারা অনমনীয় অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন, কটুকাটব্য করেছিলেন তারা এখন ছাত্রদের জয়গান গাইলেন। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। যারা নিহত হয়েছে তাদের সহানুভূতি জানালেন। বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দিলেন। উচ্চ আদালতের রায়ে কোটা আন্দোলনকারীদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করলেন। (এতে অবশ্য কোর্টের সরকারি আদেশ মেনে চলার ইঙ্গিত মেলে) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যারা কোটা আন্দোলন নিয়ে ইতঃপূর্বে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, তারা এখন ৯৩ শতাংশ কোটা অবাধ রাখার সুপারিশ করলেন।
গ্রাম দেশে বলে ‘মাইরের নাম বাবাজি, ভূত পালায় যার ডরে’। সুপ্রিম কোর্টের শুনানির তারিখ রকেট গতিতে ঘনিয়ে এলো। কারফিউর মধ্যে সমস্ত অফিস-আদালত বন্ধ রেখে আদালতের রায় ঘোষিত হলো। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যাদের উপলব্ধির মানদণ্ড হলো ক্ষমতা, তাদের কাছে নীতি বা নৈতিকতার আবেদন পরিহাস বৈ কিছু নয়। প্রথম দিকে অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্দোলন দমনে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে বেআইনি শক্তি প্রয়োগ আন্দোলনকে শক্ত ভিত্তি দেয়। উল্লেখ্য, ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, কোটা আন্দোলনকারীদের দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যখন প্রকারান্তরে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিলেন তখন আন্দোলনটি আর সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকেনি।
এক দিন-দু’দিন যেতে না যেতেই ক্ষমতাসীন সরকারের আসল চেহারার প্রকাশ ঘটে। যখন তারা দেখলেন কোটা আন্দোলন গণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, তারা পালানোর পথ পাবেন না, তখন তারা দুদিন আগের অবস্থানের বিপরীত মেরুতে ঘুরে দাঁড়ালেন। তাদের নরম নরম কথাবার্তা তখন এত গরম হয়ে গেল যে, সে আগুনে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটল। শাসকদলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন, প্রধানমন্ত্রী কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগে গুলির আদেশটি ছিল সীমিত আকারের। এখন সেটি পাইকারি আদেশে পরিণত হলো। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত দুই সপ্তাহের সহিংসতায় এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে অন্তত ২০৮ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে বিবিসি বাংলা। আহত হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। ঢাকাসহ যেসব জেলায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেসব এলাকার দুই ডজনেরও বেশি হাসপাতাল এবং নিহতদের স্বজনদের সাথে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষমতার জন্য এত নির্মমতা, এত রক্ত সমসাময়িক পৃথিবী দেখেনি। এরপর কোটা আন্দোলন দমনের জন্য গণগ্রেফতার চালানো হচ্ছে। গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা ১৭ জুলাই থেকে দেশের মহানগর, জেলা এবং থানা-পুলিশ সূত্র থেকে মামলা ও গ্রেফতারের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সোমবার (২৯ জুলাই) পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১০ হাজার ২৮ জন গ্রেফতারের তথ্য পাওয়া গেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আন্দোলনের তীব্রতায় ঘরে উঠে যায়। এখন অবশ্য তাদের এ নিয়ে গৃহবিবাদ চলছে। তাদের পুলিশ বাহিনী পালিয়ে যায়। বিজিবি, র্যাব অকার্যকর হয়ে পড়ে। একটি সফল গণ আন্দোলনের মুখে একটি জনবিচ্ছিন্ন সরকার কিরকম অসহায় হয়ে পড়ে- দেশ ও পুরো বিশ্ব অবলোকন করেছে। অবশেষে তারা দেশ রক্ষায় নিয়োজিত থাকার কথা যাদের তাদের ক্ষমতা রক্ষার বাহনে পরিণত করেছে। অবশ্য সেনাবাহিনী আইনত ও সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক সরকারের অধীন। Aid to civil program বা সরকারের প্রতি সামরিক বাহিনীর বেসামরিক সহযোগিতা নতুন নয়। গোটা বিশ্বে দেশের জরুরি অবস্থায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য ডাকা হয়। দুঃখের বিষয়- এখন এদের এখানে ডাকা হয়েছে ক্ষমতা রক্ষার শেষ কৌশল হিসেবে। অবশ্য সেনাবাহিনীর সরকারি আদেশ মান্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ক্ষমতাসীন যে দলটি দর্প করে সব কিছুকে অগ্রাহ্য করত, এখন তাদের দর্প চূর্ণ হয়েছে।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, গত এক মাসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিগত সিদ্ধান্তের বারবার ওলট-পালট দেখা গেছে। এসব বিষয় যে আকস্মিকভাবে হয়েছে এমন বলার উপায় নেই। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, সিদ্ধান্তগুলো কেবল ক্ষমতানির্ভর, লক্ষ করা গেছে। প্রথমদিকে অনমনীয়তা, দ্বিতীয় ধাপে নমনীয়তা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলন দমনে চরম নির্মমতা তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ রাখে। এখন তারা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে সমবেদনা জানাচ্ছেন। চিকিৎসার সুবন্দোবস্তের কথা বলছেন। দেশের কাছে, দেশের মানুষের কাছে বিচার চাইছেন। আহতদেরও যদি জিজ্ঞাসা করে, কে তাদের গুলি করেছে? তিনি কী জবাব দেবেন! আনসার বাহিনী গুলি করেনি। পুলিশ গুলি করেনি। র্যাব গুলি করেনি। বিজিবি গুলি করেনি। তাহলে তাদের গুলি করল কে? বিএনপি-জামায়াত? তারা কি পুলিশ চালায়? হ্যাঁ, বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক লক্ষ্যের সাথে কোটা আন্দোলনের সমতা ছিল। একজন রাজনীতির দর্শক হিসেবে দেখেছি, সে লক্ষ্য অর্জনে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার দায় সমস্ত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের দায় এখন তাদের ওপর বর্তাচ্ছে সরকার।
খুব মজার মজার কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন- রংপুরে যে আবু সাঈদ গুলি খেয়েছে, সে শিবিরের লোক ছিল। সরকার তদন্ত করে বলছে, যে গুলি করেছে সে-ও নাকি শিবিরের লোক। তাহলে পুলিশ বলে কেউ নেই, র্যাব বলে কেউ নেই- সবই বিএনপি-জামায়াত! তাহলে তারা তো নিজের সরকারের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করছে। এখন তারা শোক দিবস পালন করছে। কার বিরুদ্ধে এই শোক দিবস! নিজেদের বিরুদ্ধে নয় কি?
ইতোমধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগের এই ক্ষমতানির্ভর নীতিভঙ্গিকে দীনতা ও দ্বৈধতা বলে সমালোচনা করেছেন। কেউ বা আরেকটু এগিয়ে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বিমুখী নীতি-কৌশলের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন। যে আওয়ামী লীগ ঔপনিবেশিক আমলে জনগণের জীবন ও অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছে, তাদের থেকে এই আচরণ দুর্ভাগ্যজনক। বিগত ১৭ বছর ধরে ক্ষমতাসীন রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তারা যেমন জনগণের কাছে জবাবদিহির সুযোগ রাখেনি, তেমনি জনগণও তাদেরকে বাধ্য করে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে পারেনি। বহমান আন্দোলন তাদের জন্য ছিল একটি টেস্ট কেস। তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তবে জনগণ যে পরাজিত হয়েছে তা ভাবারও অবকাশ নেই। নির্মম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাময়িকভাবে গণদাবি বা গণরোষ দাবিয়ে রাখা যায়, কিন্তু চিরকালের জন্য নয়।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা