২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সুশাসন

কৃষিজমি ও বনভূমিতে রিসোর্ট

কৃষিজমি ও বনভূমিতে রিসোর্ট - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরের পার্শ্বের বিভিন্ন স্থানসহ দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা শহরের সন্নিকটে রিসোর্ট স্থাপনের প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃষিজমি ও বনভূমিতে রিসোর্ট স্থাপন করা হয়েছে। বনভূমিতে রিসোর্ট স্থাপন করতে গিয়ে বন বিভাগের ভূমি দখলের অভিযোগ যেমন আছে; অনুরূপ কৃষিজমিতে স্থাপিত বড় ধরনের রিসোর্টের জন্য ভূমিদস্যুদের মতো নামমাত্র দামে গরিব-অসহায় কৃষকের জমি আত্মসাতের করুণ কাহিনী নিরীহ সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব রিসোর্টের কোনো কোনোটি সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয়ে স্বল্প আয়তন ভূমির ওপর স্থাপিত আবার কোনো কোনোটি বিশাল আয়তনের ভূমি সমন্বয়ে স্থাপিত।

সচরাচর ভ্রমণপিপাসুদের আনন্দ ভ্রমণ বা বিনোদনের উদ্দেশ্যে স্বল্পকালীন অবস্থানে শহর জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে নিবৃত্তে অবকাশের নিমিত্ত পরিবারের সদস্যদের সমভিব্যাহারে রিসোর্টে আগমন ঘটে। পৃথিবীর অন্যত্র দেখা যায়, রিসোর্টের অবস্থান হয় পাহাড়, সমুদ্রসৈকতের কাছে বা দ্বীপে। যেখানে গোসল, সাঁতার, মাছ ধরা, নৌকা ভ্রমণ, কায়াকিং, স্কুবা ডাইভিং, প্যারা-সেইলিংসহ নানা ধরনের জলক্রীড়া অন্তর্ভুক্ত থাকে।

হোটেল ও রিসোর্ট অতিথিদের স্বল্পকালীন অবস্থান স্থল হলেও এ দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। হোটেল সাধারণত বাড়ি থেকে দূরে কোনো জরুরি কাজ বা ভ্রমণে অস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হোটেলে থাকা ও খাবার সুবিধা থাকলেও এটি রিসোর্টের মতো অতিথিদের ব্যাপক সুবিধা দিতে পারে না। সব রিসোর্ট হোটেল না হলেও সব হোটেলকে রিসোর্ট বলা দোষের কিছু নয়। রিসোর্ট হোটেলের ন্যায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যা আবাসস্থান, খাবার এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা ও বিনোদন প্রদান করে। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে রিসোর্ট হলো হোটেল ও বিভিন্ন বিনোদনের যেমন খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান, ক্রীড়া, বিনোদন, স্পা, শপিং প্রভৃতির একটি সম্মিলিত ব্যবস্থা। এ বিবেচনায় রিসোর্টের ভেতরে একটি হোটেলের সব ধরনের সুবিধা বিদ্যমান থাকে।

অবস্থানগত দিক হতে হোটেল ও রিসোর্টের মধ্যে পার্থক্য হলো হোটেল সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশে হয় না। হোটেলের অবস্থান থাকে বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, নৌবন্দর, বাসস্টেশন এবং শহরের কেন্দ্রস্থল ও ব্যবসায়িক এলাকায়। রিসোর্টের অবস্থান প্রাকৃতিক পরিবেশে হলেও প্রকৃতিকে বিপন্ন করে অর্থাৎ কৃষিজমি ও বনভূমির পরিবর্তন ঘটিয়ে রিসোর্ট স্থাপনের নজির আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হলেও পৃথিবীর অন্যত্র বিরল।

বাংলাদেশ নদীবেষ্টিত একটি দেশ। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্র উপকূল বেষ্টিত। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ ভূমি পাহাড় দ্বারা আবৃত। তা ছাড়া শেরপুর ও নেত্রকোনার কয়েকটি উপজেলা সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে স্থিত হওয়ায় এসব অঞ্চলে ছোট পাহাড় ও টিলার উপস্থিতি লক্ষণীয়। বাংলাদেশে একটি সামুদ্রিক দ্বীপ ব্যতীত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপকূলীয় দ্বীপ রয়েছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে হিমালয় পর্বতমালা হতে উদ্ভূত ৫৪টি অভিন্ন নদী প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এসব নদীবাহিত পলি দ্বারা সাগর উপকূলে প্রতি বছর নতুন চরের আবির্ভাব ঘটেছে। অধিকাংশ নদীর পানির প্রবাহ বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে উজানে নির্মিত বাঁধের কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এগুলোর তলদেশে প্রতিনিয়ত পলি জমে এক দিকে নদীর নাব্যতা হারাচ্ছে। অন্য দিকে প্রশস্ত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর বিস্তীর্ণ ধানী জমি ও বিপুলসংখ্যক বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে একশ্রেণীর প্রান্তিক কৃষক ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে যমুনা, তিস্তা ও পদ্মা অন্যতম। এসব নদীর তলদেশে পলি জমায় এগুলোর মধ্যে বিপুলসংখ্যক চরের উদ্ভব ঘটেছে। এসব চরের বেশির ভাগ বালু দিয়ে আবৃত বিধায় ধান চাষের অনুপযোগী। সম্প্রতি দেখা গেছে, আমাদের পরিশ্রমী কৃষক এসব অনাবাদি ভূমিতে ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, আলু প্রভৃতির আবাদ করে এবং হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল লালনপালন করে নিজের ভাগ্যের চাকার পরিবর্তন করে বিভিন্ন পণ্যের জোগান দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সজীব করে তুলছে। তিনটি নদীর ভাঙন ব্যাপক। এ তিন নদীর খনন পরবর্তী দুইতীরে বাঁধ নির্মাণ করা গেলে নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুইপাশে ব্যাপক ভূমির উদ্ভব ঘটবে, যা কৃষিকাজ, শিল্প কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট প্রভৃতি স্থাপনে ব্যবহারে আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হবে।

তিস্তা নদীর ভাঙন রোধ ও নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশের অনুরোধে চীন একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে পৌঁছানোর পথ সুগম হবে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদীর দুইপাশে উদ্ধারকৃত ভূমিতে শিল্প কারখানাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট প্রভৃতি স্থাপনের ফলে যে জনমানুষের সমাবেশ ঘটবে তাতে এলাকাটিতে কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় উজানের যে দেশটির কারণে আমরা এসব নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত সে দেশটি প্রকল্পটির বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে এক শ্রেণীর মানুষের আয়-উপার্জন বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা বছরে দুয়েকবার পরিবারসমেত বিভিন্ন রিসোর্টে অবকাশ যাপনের আগ্রহ দেখায়। এ কারণে রিসোর্টের ব্যবসা লাভজনক ও দ্রুত প্রসারমান হয়ে উঠেছে। আর এ সুযোগে এক শ্রেণীর ব্যক্তি নিয়মনীতির ব্যত্যয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট ও জীববৈচিত্র্যের বিলোপ সাধন করে রিসোর্ট স্থাপনে আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত নয় এমন সব স্থানে বিশাল আয়তনের রিসোর্ট গড়ে তুলেছে এবং তোলার পথে রয়েছে। এদের এহেন অনৈতিক কাজ রোধ করা না গেলে অচিরে বাংলাদেশে কৃষিজ ও বনজ ভূমির একটি বড় অংশ বিলীন হয়ে দেশের জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। এমনও অভিযোগ পাওয়া যায়, অনেক রিসোর্ট অনৈতিক মিলন ও অসামাজিক কার্যকলাপের স্থান হিসেবে এক শ্রেণীর মানুষের নিকট অত্যন্ত প্রিয়। সরকারের পক্ষ হতে এদের বিরুদ্ধে আশু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক এমনটি প্রতিভাত।

রিসোর্ট স্থাপনে আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত এমন স্থান বাংলাদেশ জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও অপ্রতুল নয়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারব্যাপী শতাধিক মাইল দীর্ঘ যে সমুদ্র উপকূল রয়েছে এর বিভিন্ন স্থান একাধিক বড় আয়তনের রিসোর্ট স্থাপনে উপযোগী। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরেরসরাই উপজেলার উপকূলে সমুদ্র থেকে আহরিত ভূমির ওপর যে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে; এর পাশে এক বা একাধিক রিসোর্ট স্থাপনের সুযোগ রয়েছে যা বাণিজ্যিকভাবে সম্ভাবনাময়। তা ছাড়া বিভিন্ন উপকূলবর্তী জেলার তটভূমিতে যে ভূমি জেগে উঠেছে তাতে এবং তটের অদূরে সৃষ্ট চরভূমি রিসোর্ট স্থাপনে উপযোগী। বিভিন্ন পার্বত্য জেলার বিস্তীর্ণ পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশ এবং বিভিন্ন নদীর দুইতীর রিসোর্ট স্থাপনে উপযুক্ত ও আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত। এসব স্থানে রিসোর্ট স্থাপনে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে প্রকৃত উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসবেন এবং এ শিল্পের বিস্তৃতি ঘটবে এমনটি আশা করা যায়।

দেশের বিভিন্ন কৃষি ও বনভূমি বিনষ্ট করে ইতোমধ্যে যে একাধিক বিপুল আয়তনের রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে এবং গড়ে তোলার পথে অগ্রসরমান এর বিহিতসাধন জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব রিসোর্ট সরকারি খাসভূমি ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন অসংখ্য ভূমি মালিকের ভূমির ওপর গড়ে উঠেছে। একাধিক রিসোর্টের ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যায় প্রশাসনিক ও পেশিশক্তির অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ভূমি মালিকদের ভূমি জবরদখল করে হস্তান্তরে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাজার মূল্যের অনেক কম মূল্যে অনেকটা জোরজবরদস্তি করে ভূমি আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলেও প্রভাবশালী রিসোর্ট মালিকদের ক্ষমতা ও দম্ভের কাছে তারা অসহায় বিধায় এ যাবৎকাল পর্যন্ত প্রতিকার প্রাপ্তিতে বঞ্চিত।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যে অসংখ্য রিসোর্ট গড়ে উঠেছে এর মধ্যে কতগুলো কৃষিভূমি, বনজ ভূমি বিনষ্ট করে ও সরকারি খাসভূমি দখলের সাথে সংশ্লিষ্ট এর পরিসংখ্যান সরকারের কাছে না থাকলেও এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও গণমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি ও প্রচারে জনমানুষ কিঞ্চিত অবহিত। কৃষিভূমি ও বনজ ভূমি এবং সরকারের খাসভূমি সুরক্ষা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব থেকে সরকারের জন্য বর্তমানে আবশ্যিক হয়ে পড়েছে কৃষিভূমি, বনজ ভূমি এবং সরকারের খাসভূমিতে গড়ে ওঠা রিসোর্টের তালিকা প্রস্তুত করে তা থেকে এসব ভূমি উদ্ধারপূর্বক তার পূর্বের রূপ পুনরুদ্ধার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের ফেরত দিয়ে তাদের দুর্দশার লাঘব করা।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement