২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

এ কোন বাংলাদেশ

এ কোন বাংলাদেশ - ছবি : সংগৃহীত

এক.
গত ক’দিনের ঘটনা দেখে ব্যথায় কষ্টে কঁকিয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে এটি আমাদের চিরচেনা বাংলাদেশ নয়। মুক্তিযুদ্ধের আলোয় আলোকিত শ্যামল কোমল কোনো মানবিক জনপদ নয়। এক হাজার ৩০০ নদীর এই পাললিক ভূমি যেন গা হিম করা কোনো বীভৎস মৃত্যুপুরী।
চারদিকে শুধু রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের উৎকট বিভীষিকা। ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত আর্ত, আহত মানুষের গোঙানি। হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে ভয়াবহতার চাপ সামলাতে। যেন নিজের মানুষের প্রাণ ও রক্তের নেশায়, এই লালন, হাসান, আব্বাস উদ্দীনের দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা। মনে হচ্ছে ইসরাইল আক্রান্ত গাজায় বাস করছি।

মাথার উপর ঘন ঘন চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার। সমবেত জনতার উপড় ছোড়া হচ্ছে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, বুলেট। রাজপথে, অলিতে-গলিতে, মাঠে-ময়দানে যেখানেই আন্দোলনকারী, সেখানেই পুলিশ নির্বিচারে চালাচ্ছে গুলি। স্নাইপাররা টার্গেট করে হত্যা করছে মানুষ। রক্তে ভাসছে দেশ। রাজধানী ঢাকাসহ সবখানেই পড়ছে লাশ। কারফিউ সর্বত্র। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন। সরকারি বয়ান ছাড়া আর কিছুই শোনা বা জানার উপায় নেই।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ বিস্মিত, স্তম্ভিত। বাক্যরহিত।

দেশের ভবিষ্যৎকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সন্তানদের বুক ঝাঁঝরা করছে বুলেট। এক শ্রেণীর দালাল মিডিয়া আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারী, বিএনপি-জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছে। যেন এই ট্যাগ লাগালেই হত্যা জায়েজ হয়ে যায়। তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিক্রিয়ার উপর সবার মনোযোগ আদায় করতে চাচ্ছে। আর ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে ক্রিয়ার প্রসঙ্গ। ফলে পর্দায় শুধু জ্বালাও পোড়াওয়ের কাহিনী। হত্যা খুনের কোনো কথাই নেই। যেন মানুষ হত্যা খুবই মামুলি ব্যাপার।

জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে বেশুমার। এই ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে কত দিন লাগবে কে জানে। দেশের মানুষ তিনি যেই হোন, তাকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা যেমন গর্হিত পাপ, তেমনই জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করা মেনে নেয়া যায় না।

কিন্তু কথা হলো, কেন এমন হলো? বিষয়ের শুরু কোত্থেকে? ২০১৮ সালে ‘বিরক্ত হয়ে’ কোটাপ্রথা বাতিল করে নির্বাহী বিভাগ। হঠাৎ করে সেই কোটা চলে যায় হাইকোর্টে। হাইকোর্ট সরকারি প্রজ্ঞাপন বাতিল করে আবার প্রবর্তন করে কোটাপ্রথা। যেখানে মেধার স্থান মাত্র ৪৪ শতাংশ। সঙ্গত কারণেই রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা।

মনে রাখা জরুরি, ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু কোটা বাতিল চায়নি। তারা চেয়েছিল যুক্তিসঙ্গত সংস্কার। তাদের আন্দোলন চলছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে। তখনই তাদের সাথে কথা বলার বদলে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই ছেলেমেয়েদের প্রতি দেখানো হয় অশোভন তুচ্ছতাচ্ছিল্য। তাদের গায়ে লাগিয়ে দেয়া হয় ‘রাজাকার’-এর সিল, যা আন্দোলন প্রশমনের পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীদের ব্যথিত করে তোলে। সরকারের দু-একজন মন্ত্রীর আচরণ, উচ্চারণও ছিল দায়িত্বহীন। এর মধ্যে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, এই আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ঘোষণার পরপরই ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পোষ্য পেটুয়ারা শিক্ষাঙ্গনগুলোতে হামলা চালায়। চেষ্টা করে গায়ের জোরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কণ্ঠ রোধের। পাশাপাশি মারমুখী অবস্থান নেয় সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ।

এবার যেন আগুনে ঘি পড়ল। আন্দোলন আর শান্তিপূর্ণ অহিংস থাকল না। একদিকে হামলা অন্যদিকে চলল প্রতিরোধ। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি-জামায়াত ও গণতন্ত্রমঞ্চসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল এই আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাও দেশের মানুষকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানায়। সে কারণে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পুরো আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

আগাগোড়াই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। খুব সহজেই যে সমস্যার সমাধান করা যেত, সেটিকে গায়ের জোরে ঠাণ্ডা করতে চেয়েছে। সরকারের অনুগত বাহিনীগুলোও এ ক্ষেত্রে মমত্বশীল ও দায়িত্বশীল না থেকে বেছে নেয় বেপরোয়া পথ। পরিস্থিতি এখন দাঁড়াল, একদিকে সরকারের সশস্ত্র অনুগত লস্কর বাহিনী, অন্যদিকে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। মাঝখান থেকে ঝরে গেল শত শত তরতাজা তরুণের প্রাণ। বিনষ্ট হলো অনেক জাতীয় সম্পত্তি।... শেষ পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে সরকার তার নথ খসালো বটে কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দুই.
একই ভুল করেছিল পাকিস্তান সরকার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে এ দেশের মানুষের আত্মার দাবি ছিল তা অনুধাবনে অপারগ হয় তারা। গোয়ার্তুমি, দম্ভ, অহমিকা ও ঔদ্ধত্য দিয়ে পিষে ফেলতে চেয়েছিল সব কিছু। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ঝরে গেল অনেকগুলো নিষ্প্রাণ নিরপরাধ প্রাণ। আর এর ফলে ধ্বংস হয়ে গেল নূরুল আমিনের রাজনৈতিক জীবন। চিরকালের জন্য কবরে ঠাঁই নিলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের দাবিদার মুসলিম লীগ। অন্তর থেকে ভেঙে গেল জিন্নাহর সাধের পাকিস্তান।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মোকাবেলায়ও একই ভুল করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রধান কারণ ছিল গণতন্ত্রহীনতা, বৈষম্য, নির্যাতন ও আইয়ুুব খানের হামবড়া অহঙ্কার। ছাত্রনেতা আসাদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল আইয়ুব খানের তখত তাউস। তিনি নিক্ষিপ্ত হন ইতিহাসের ডাস্টবিনে।

শঠতা, ধূর্ততা, প্রতারণা, অনুগত বাহিনী ও রাজনীতিবিদদের কেনাবেচা করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ। কিন্তু পরিণামে ফুঁসে ওঠে জনগণ। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান তাকে উৎখাত করে ক্ষমতা থেকে। আর নূর হোসেন হয়ে ওঠেন গণঅভ্যুত্থানের মানব পোস্টার।

গণআন্দোলনের সেই ধারাবাহিকতা মনে রাখলে আওয়ামী লীগ সরকার সেই একই পথে পা বাড়াত না। গায়ের জোরে কোনো কিছুর সমাধান হয় না। হলেও তা হয় অত্যন্ত সাময়িক। যেমন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে আন্দোলন থামাতে পারলেও, মাত্র বছর খানিক টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন পাকিস্তানকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। আর বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

তিন.
‘কুকুরটিকে এখনই খারাপ নাম দাও’ এই বিশ^বিশ্রুত প্রবাদের পথে হেঁটে, সরকার এত কিছুর পরও ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে মহাসমারোহে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্ত্রাসী, দুষ্কৃতকারী, দুর্বৃত্ত, জঙ্গি আখ্যা দিয়ে, নিজেদের অন্যায়-অত্যাচার আড়াল করার বিপজ্জনক ও হাস্যকর প্রয়াস চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ও অনুগত মিডিয়া পালন করছে দুর্ভাগ্যজনক ভূমিকা। যা বিদ্বেষ, বিভেদ ও হানাহানিকেই শুধু বৃদ্ধি করবে। সঙ্ঘাতকেই রসদ জোগাবে।
ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে, সরকারসহ সবার কাছেই জাতি দায়িত্বশীল, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ আচরণ প্রত্যাশা করে। আশা করে নিখাদ দেশপ্রেমিকের অবস্থান। সব রকম অহমিকা, ক্রোধ ও ঘৃণাবিদ্বেষ সংবরণ করে বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য পরিষ্কার চোখ মেলে তাকান। দেখুন কী ভয়ানক সর্বনাশ হয়ে গেছে। গোরস্থানে গোরস্থানে আমাদের সন্তানদের লাশ। ঘরে ঘরে সন্তানহারা পিতা-মাতা, ভাইবোনদের বুকফাটা আহাজারি। হাজার হাজার আহত মানুষের কাতরানিতে ভারী হয়ে গেছে বাতাস।

এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও কি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে শুভবুদ্ধি, শ্রেয়বোধ, মানবতা, দেশপ্রেম, কর্তব্যজ্ঞান জেগে উঠবে না? নাকি সেই অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যাওয়া চেনা কৌশল, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’-এর ঘাড়ে গছিয়ে, নিজেরা সাধু সেজে কেষ্ট বেটাকেই চোর সাব্যস্ত করে কেল্লাফতে করবেন? আবারো বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দিতে থাকবেন মামলার পর মামলা? শুরু করবেন গ্রেফতার বাণিজ্য। এতে সরকারের গায়ের ঝাল হয়তো কিছুটা কমবে। কিন্তু উপসংহারে প্রাপ্তির কোটায় থাকবে কেবলই গ্লানি। আত্মপ্রতারণার পাপ।
তাহলে রাজধর্মের কী হবে? যে রাজধর্মের কথা গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। মোদি রাজধর্ম মানেননি। সে জন্যই এখনো গুজরাটের রক্ত তাকে প্রেতাত্মার মতো তাড়া করে ফেরে। আমাদের শাসকরা কি সেই রাজধর্ম মানবেন? এ মাটি কিন্তু বাংলার মাটি।

হাইস্কুলের ছাত্র হয়েও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধেও দেশের জন্য যৎকিঞ্চিৎ কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। নব্বইয়ের ঘটনা তো এই সে দিনের। ... অভিজ্ঞতা থেকে হলফ করে বলতে পারি (মুক্তযুদ্ধ ছাড়া) এ রকম ভয়ঙ্কর অবস্থা আমি আর কোনোদিন দেখিনি।
আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এই রক্তস্রোত, এই অশ্রুধারা বৃথা যেতে পারে না। বৃথা যায়নি কোথাও। এর ভেতর দিয়েই হয়তো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে বিদ্বেষ, বিভেদ, ঘৃণা, জিঘাংসা, গণতন্ত্রহীনতা, নীতি-নৈতিকতাহীনতা, আইনের শাসনহীনতার বিষমুক্ত, প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনের উজ্জীবিত সঞ্জীবিত এক নতুন বাংলাদেশের।

যারা ন্যায়ের পক্ষে, কল্যাণের পক্ষে, যারা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সিনা টান করে দাঁড়ায়, তাদের জন্যই তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমিয় বাণী-
‘সত্য পথের তীর্থ-পথিক ভয় নাই, নাহি ভয়,
শান্তি যাদের লক্ষ, তাদের নাই নাই পরাজয়।
অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে,
অবশেষে চির-লাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে।’

একুশের রক্ত চিরকালের জন্য জেগে আছে শহীদ মিনারে। ’৬৯-কে অমর করেছে আসাদ। নব্বই মানেই তো নূর হোসেন। আর ২০২৪-এর আবু সাইদ ইতোমধ্যেই তো হয়ে উঠেছেন লাঞ্ছিত অপমানিত মানবতার প্রাণের পতাকা। হাজার বছরের ইতিহাসে গুলির সামনে বুক বাড়িয়ে দেয়া দুঃসাহসী আবু সাঈদের মতো কাউকে তো আর পাওয়া যায়নি।

অত্যন্ত স্পর্শকাতর, অগ্নিগর্ভ সময়ে বাংলাদেশের সামান্য একজন কবিতাকর্মী হিসেবে, সবাইকে বলব- আর কোনো হত্যা নয়, গণহত্যা নয়, রক্ত নয়। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা দেশে আর এক ফোঁটা রক্তও কেউ ঝরাবেন না। বাংলাদেশ এত রক্ত সহ্য করতে পারছে না।
সবাই স্থির হোন। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা পরিহার করুন। দেশ মানে শুধু মাটি, নদী, গাছপালা, খালবিল নয়, দেশ মানে দেশের মানুষ। সেই মানুষ আজ বিপন্ন। আসুন, বসুন, কথা বলুন, দেশটাকে বাঁচান।


আরো সংবাদ



premium cement