২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রাজাকার

রাজাকার - ছবি : নয়া দিগন্ত

(লেখাটি ১৯ জুলাই, ২০২৪ তারিখে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে)

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল পাঁচ কিংবা ছয় বছর। কিন্তু তারপরও আমি ১৯৭১ সালে আমাদের অঞ্চলে কী কী ঘটেছিল তার অনেক কিছুই মনে করতে পারি। আজকের দুনিয়ার বিশেষ করে পাঁচ-ছয় বছরের শিশুদের মতো সত্তরের দশকের শিশুরা ছিল না। আমরা ওই বয়সে সাঁতার কেটে বড় বড় খাল-বিল, নদী-নালা পার হতাম। নারিকেল-সুপারিসহ অন্যান্য ছোট-বড় গাছে ওঠার প্রতিযোগিতা করতাম। বাড়ি থেকে ১০-১২ মাইল দূরের বাজারে গিয়ে পরিবারের জন্য টুকটাক বাজার করে ফিরে আসতাম। আবার দূরে কোথাও জারি-সারি, যাত্রাপালা কিংবা সার্কাস হলে দল বেঁধে রাত-বিরেতে ২০ মাইল দূরেও চলে যেতাম। সেই দুরন্ত শৈশবে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো তখন ফরিদপুর জেলার সদরপুর, ভাঙ্গা এবং নগরকান্দা থানায় কী হচ্ছিল তার খবরাখবর একান-ওকান হয়ে আমাদের কাছে চলে আসত।

আমাদের গ্রামের শিশু-কিশোররা দল বেঁধে মিছিল করত আর বলত, দাড়ি ফ্যালাইয়া রাখছে মোচ, তারে বলে মুক্তিফৌজ! মোচ ফ্যালাইয়া রাখছে দাড়ি তারে বলে মিলিটারি। যেসব শিশু-কিশোর এসব সেøাগান দিতো তারাই আবার একটু পর বলত, ইলশা মাছের বিলসা কাটা, বোয়াল মাছের দাড়ি! আইয়ুব খান ভিক্ষা করে শেখ মুজিবের বাড়ি। আপনারা যদি উল্লিখিত দু’টি সেøাগান পর্যালোচনা করেন তবে দেখতে পাবেন, ওগুলো পরস্পরবিরোধী। প্রথমটি মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার জন্য, আবার দ্বিতীয়টি বঙ্গবন্ধুর গুরুত্ব এবং বিশালতা তুলে ধরার জন্য। এসব স্লোগান ছাড়াও নানা কল্পকথা, গল্প-গুজব এবং নাটক-থিয়েটারের মাধ্যমে আমাদের আজো পাড়াগাঁয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক প্রচারণা চালানো হতো। কিন্তু শিশু-কিশোরদের মনে কেবল সেগুলো গেঁথে যেত যেগুলো তাদের ভালো লাগত।

আমাদের বাড়ি থেকে থানা সদরের দূরত্ব দুই মাইলের মতো। আমরা খবর পেলাম ওখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। পোলাপানের দঙ্গল ছুটল সেই ট্রেনিং দেখার জন্য। কাঠের বন্দুক হাতে নিয়ে শ’খানেক লুঙ্গি পরা বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ট্রেনিং নিচ্ছে। একজন কমান্ডার হাফপ্যান্ট ও সামরিক টুপি পরে সবাইকে লেফ-রাইট শেখাচ্ছে। তিনি এত দ্রুত লেফট-রাইট বলছেন যা শেষমেশ এফ-আউট উচ্চারিত হচ্ছে এবং তা শুনে ছেলেপুলেরা হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কিছু অতি উৎসাহী মহিলাও ঘোমটায় মুখ ঢেকে এফ-আইট দেখছে এবং হাসছে। যারা ট্রেনিং নিচ্ছে তাদের নানান ত্রুটি-ভুলভাল এবং একটু দৌড় সামান্য বুক ডনে হাঁফিয়ে ওঠা এবং লেফট-রাইট ছন্দের সাথে পা মেলাতে না পারা এবং কমান্ডারের বকাঝকা খাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য তিন-চার শ’ লোক সদরপুর মাঠের চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকত।

প্রায় এক মাস ধরে ট্রেনিং চলল। যারা ট্রেনিং নিলো তারা এক সেট ড্রেস এবং একটি চামড়ার বেল্ট পেলো এবং বলা হলো, ভবিষ্যতে আনসার হিসেবে তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হবে। এভাবে ১৯৭১ সালের মে-জুন পার হলো। আমাদের এলাকায় কোনো যুদ্ধ হলো না, কোনো মিলিটারিও এলো না। গ্রামের লোকজন কাজকর্ম করে আর সময় পেলে রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের খবর শোনে। বিশেষ করে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেক গান তখন মানুষের মুখে মুখে বাজছিল। আমাদের এলাকায় পাশাপাশি দু’জন পীর ছিলেন। আটরশির পীরের বিরুদ্ধে লোকজন বলছিল যে, তারা মিলিটারির লোক। অন্যদিকে চরমুকুন্দিয়া পীরের বদনাম ছিল, তিনি মুক্তিফৌজের লোক। কথিত আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা চরমুকুন্দিয়া পীরের বাড়িতে ছিলেন বা গেছেন। কাদের মোল্লা স্থানীয় বাইশরশি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন এবং পীর সাহেবের ছেলেমেয়েদেরকে পড়াতেন। পীর সাহেবের এক মেয়ের সাথে ফরিদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গাফফার ইঞ্জিনিয়ারের বিয়ে হয় এবং সেই গাফফার সাহেব পরে এলজিআরডির অতিরিক্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন।

আমাদের সদরপুর আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। আটরশি হুজুরের মেয়ের জামাই আদিল উদ্দিন মুসলিম লীগ করতেন বলে শুনেছি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কোনো তৎপরতা ছিল না। ফলে আমার শৈশব এবং কৈশোরের যে সময়টি আমি সদরপুরে ছিলাম তখন রাজাকার, আলবদর, আল-শামস- এই শব্দগুলোই শুনিনি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর আমরা ফরিদপুর ছেড়ে পটুয়াখালীর গলাচিপায় বসতি গড়ি। গলাচিপার পানপট্টিতে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক মারাত্মক সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল এবং সেখানে পাকহানাদাররা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। পানপট্টি ছাড়াও চিকনিকান্দি গ্রামে হানাদাররা সংখ্যালঘু বহু হিন্দু পরিবারে পাশবিক নির্যাতন চালায়। ফলে গলাচিপাতে এসে আমি অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎ পেয়েছি এবং প্রথমবারের মতো রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের কথা শুনেছি।

গলাচিপায় যাদেরকে রাজাকার বলা হতো তারা প্রকৃতপক্ষে খারাপ লোক ছিল। এসব রাজাকারের ছেলেমেয়ে নাতি-পুতিরা বেশির ভাগই পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে এবং চেয়ারম্যান-মেম্বার পদে নির্বাচিত হয়েছে বটে কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষদের রাজাকারী চরিত্র ত্যাগ করতে পারেনি। এসব রাজাকার সন্তানদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ রাজনীতির জন্য কতটা ক্ষতিকর হয়েছে তা কেবল ভুক্তভোগী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই বলতে পারবেন।

গলাচিপা ছেড়ে যখন ঢাকা এলাম তখন রাজাকার শব্দটি অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আশির দশকের ছেলেমেয়েদের কাছে প্রতিধ্বনিত হতো তা আমার ক্ষেত্রে আরো বেশি করে হতে থাকল। কারণ রাজনীতিতে এসে আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার সাথে জড়িয়ে পড়লাম। ফলে আশির দশকের জীবন্ত কিংবদন্তি প্রকৃত সামরিক ব্যক্তিত্ব যারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, বিচারপতি যারা মোনায়েম খান, ইয়াহিয়া, টিক্কা খানদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং কবি-সাহিত্যিক দার্শনিক সাংবাদিক যারা পুরো পাকিস্তানি শাসকদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন তাদের অনেকের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলাম। ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকার শব্দের ত্রিমাত্রিক রসায়ন আমার যৌবনের প্রারম্ভে মন-মস্তিষ্কে এমনভাবে ঢুকেছিল- যার কারণে প্রকৃত ইতিহাস ছাড়া কেবল আবেগ দ্বারা আমি কোনো দিন তাড়িত হইনি।

রাজাকার শিরোনাম নিয়ে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই আমি যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন সারা দেশের ছাত্রসমাজ রাজাকার ইস্যু নিয়ে একটি নজিরবিহীন ঐতিহাসিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে উচ্চারিত রাজাকার, রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুতি সংক্রান্ত কিছু বাক্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ফলে তাদের আন্দোলন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর পর্যায়ে পৌঁছে এবং শাসকগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত করে তোলে। ফলে অতীতের স্বৈরাচারী শাসকদের মতোই বর্তমান শাসকরা নানা কূটকৌশল এবং শক্তি প্রয়োগের নানান হাতিয়ার দ্বারা রাজপথ ঠাণ্ডা করার মিশনে নেমে ১৬ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ৬টি তাজা প্রাণের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নির্মমতার এক নতুন মাইলফলক তৈরি করে।

উল্লিখিত অবস্থায় রাজাকার শব্দটি হঠাৎ করেই বাংলাদেশে তার জিনোম অর্থাৎ জন্মবৃত্তান্ত দ্বিতীয়বারের মতো পাল্টে ফেলে। কারণ মূল আরবিতে রাজাকার শব্দের অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। উর্দু ভাষায় এটি অপভ্রংশ হয়ে অনেক অর্থ ধারণ করেছে। অন্যদিকে বাংলা ভাষায় রাজাকার শব্দটির ব্যাকরণগত অর্থ- অর্থাৎ রাজার মতো আকৃতি যার তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে এটি একটি গালিতে পরিণত হয়েছে, যাকে ভাষাবিজ্ঞানের কনভেনশন বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস এবং পরবর্তীতে গল্প কবিতা উপন্যাসে রাজাকার শব্দটির উপস্থাপন হয়েছে বিশ্বাসঘাতক বা জুডাস হিসেবে। কাজেই রাজাকার শব্দের অতি ব্যবহার এবং অপব্যবহারের ফলে এটি ২০২৪ সালে এসে নতুন করে তার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন করে ফেলেছে। ফলে লাখ লাখ বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থী চিৎকার করে বলছে- ‘তুমি কে! আমি কে! রাজাকার! রাজাকার! চাইতে আসলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার!’

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement