২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি’

‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি’ - ছবি : নয়া দিগন্ত

(লেখাটি দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রিন্ট সংস্করণে ২২ জুলাই, ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল)

কিছুকাল আগে শাসক দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে দেশের মানুষ তখন কিছু পায়। কেউ কেউ হাস্যোচ্ছলে বলেন, অল্প কিছু নয়, বরং অনেক বেশি কিছুই পেয়ে থাকে। ঠাট্টা মশকরা করার দরকার নেই। তার চেয়ে বরং গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে জনগণ ও পক্ষান্তরে শাসক দলের বিশেষ স্নেহভাজনরা বা তাদের আশীর্বাদপুষ্টদের মধ্যে কে কতটুকু পেয়েছে তার একটা ‘রাফ’ বা খসড়া শুমারি করে দেখা যেতে পারে। প্রকৃত সত্যটি আসলে কী, তখন সেটি হয়তো কিছুটা স্বচ্ছ হতে পারে। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে, আদার ব্যাপারির পক্ষে জাহাজের খবর রাখার দরকার পড়ে না। সেটি কষ্টেরও ব্যাপার, সে জন্য বরং প্রথমে খুব ছোটখাটো ব্যক্তিরা কী পেয়েছেন। সেখান থেকেই শুমারি শুরু করা যেতে পারে।

ক্ষমা করবেন, কেবল কথার পিঠেই কথা বলা। আর কিছু নয়, কাউকে লজ্জায় ফেলারও ব্যাপার নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, তার অফিস সহকারীও ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে। বিষয়টি হতভম্ব হওয়ার মতো, নাকি মারহাবা বলার মতো- ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। ২০২৪ সালের শুরুতে যে নির্বাচনী খেলা অনুষ্ঠিত হয়, যাকে আবার অনেকে ‘মামা ভাগনের’ নির্বাচন বলে অভিহিত করেছে- সেখানে যারা প্রার্থী ছিলেন, প্রকৃত অর্থে তাদের সবাই শাসক দলেরই লোক। তাদের সবাইকে নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের আয় রোজগারের হিসাবটা পেশ করতে হয়েছিল। সেখানে সবাই নিজেকে কোটিপতি হিসেবে প্রমাণপত্র জমা দিয়েছিলেন। কেউই সেটিকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করতে চায়নি। এই ‘সন্দেহবাদীদের’ অভিমত, হলফনামায় পেশকৃত অঙ্কের চেয়ে প্রকৃত হিসাব কয়েকগুণ বেশি বৈ কম নয়। আর এই বিত্তবৈভব একেবারে ক্ষণকালের মধ্যেই করায়ত্তের কারিশমা তাদের ছিল। আঙুল ফুলে কলা গাছ নয়; বরং তালগাছেরই মতো।

এসব হিসাব নিয়ে দেশে কোনো হইচইও হয়নি। কারণ সবার জানা শাসক দলের মানুষজন সব ভাগ্যের বরপুত্র। তাদের সম্পর্কে মানুষ বহুদিন থেকে হাঁড়ির খবরটা রাখত। এটি কোনোভাবে গণতান্ত্রিক সমাজের স্বচ্ছতার কোনো নজির নয়; বরং তাদের পুকুর নয়- দীঘি চুরির খবরটা সবার কাছে দিবালোকের মতোই ফর্সা। এরপর যাদের কথাটা সমীহ করে উচ্চারণ করব, তারা হচ্ছেন শাসক দলের পক্ষে পায়রবি করে তাদের বারবার নির্বাচনী খেলায় প্যালান্টি শট করে গোল দেয়ার জন্য বল সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে শুধু বেনজীর, আজিজ, মতি মিয়াই নয়, আরো মিয়া রয়েছে। সে তালিকা হবে অনেক দীর্ঘ। তারাও যাতে আখেরে দুটো ডাল-ভাত খেয়ে তাজা অন্দুজ থাকতে পারে সেই সাথে ছেলেপেলে নিয়ে দিন গুজরান করতে পারে, তার জন্য বহু লাখো কোটি টাকা শাসক দলের কাছ থেকে তারা ‘উপহার’ পেয়েছেন। তার হিসাব কষতে হলে অবশ্যই সুপার কম্পিউটারের প্রয়োজন হবে। এখন বলুন, কী করে অস্বীকার করবেন শাসক দল ক্ষমতায় থাকলে কেউ কিছু পায় না!
তবে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, মুদ্রার আবার অপর পিঠও থাকে। সরকারি হিসাব থেকেই জেনেছি, দেশের অসংখ্য মানুষ এখন দু’বেলা খেতে পায় না। জঠরজ্বালায় তাদের নিদ্রাহীন রাত কাটে। তাহলে এটিও হয়তো পরিষ্কার হচ্ছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কারা পোয়াবারো আর অসংখ্য লোক কিছুই পায় না বা ভুখানাঙ্গা থাকে।

এবার একটু ভিন্ন দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। শাসক দল ইদানীং দেশবাসীকে এক ‘অকৃত্রিম’ বন্ধুর সন্ধান দিয়েছে। আগে সেই দেশের মানুষ ‘বন্ধুদের’ জানত পড়শি হিসাবে। বন্ধনহীন এক সম্পর্ক। শাসক শ্রেণী হয়তো ভাবেন, এই ‘অকৃত্রিম’ বন্ধুর সিদ্ধান্ত দিয়ে সবাইকে তারা কৃতার্থ করেছে। এই অকৃত্রিম বন্ধুর নেচার একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের। তারা শুধু পেতেই চায়। আর এমন পাওয়া খুব সহজলভ্য করাও হয়েছে। সেই বন্ধুর অভিধানে প্রতিদান বলে কোনো শব্দ নেই। তারা একটার পর একটা পেতেই অধীর। তাদের পাওয়ার তালিকা দিন দিন শুধু স্ফীতই হচ্ছে। অনেকে ভয় করছে শেষে তারা না আবার গায়ের বস্ত্রটা চেয়ে বসে। এ দেশের যারা কর্তৃপক্ষ তারা সেই অকৃত্রিম বন্ধুর কাছে সামান্য কিছু চাইতেও ভয় পান। তাতে বন্ধু না আবার বেজার হয়!

সবার জানা, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছিল। সেটা কত বছর আগে হিসাব করা যেতে পারে। কিন্তু এখনো তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে আশার কথা নেই। সেই সময় চুরি না হওয়ায় সে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মাত্র ১৫০০ কোটি টাকা লেগেছিল। আজ সেটার শেষ করতে ব্যয় করতে হতো ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ প্রকল্প কার্যকর করতে পারলে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা যেত। তাতে দেশের কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব ঘটত। অথচ কথিত সেই বন্ধুরাষ্ট্র উজানে পানি আটকে দেয়ার কারণে তিস্তা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। স্মরণ করা যেতে পারে, বহু আগেই পদ্মায় পানি পাওয়ার বিষয়টি ‘গণকেস’ করে দিয়েছে সেই ‘অকৃত্রিম’ বন্ধু। তিস্তা নিয়ে তাদের রঙ্গ তামাশার কোনো শেষ নেই। দেশের মানুষের নাকের ডগায় মুলা ঝুলিয়ে এখন এ নিয়ে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। শাসক শ্রেণী চোখে দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে সে নাচন দেখছে না। বন্ধুদের গাওয়া ঘুমপাড়ানি গান শুনে দেশের কর্তৃপক্ষ এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

ফারাক্কায় পানি নেই, তিস্তা নিয়ে তেলেসমাতির শেষ নেই। তাতে কার কী এসে যায়। এ দিকে সিলেটে উজান থেকে দফায় দফায় পানির ঢল নেমে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই বিভাগের লাখো কোটি মানুষকে। সিলেটসহ দেশের আরো অনেক অঞ্চলের মানুষ বুক পানিতে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে একমুঠো ত্রাণের আশায়। ত্রাণ না পেলেও আফসোস কি আছে। বহুদিনের পুরনো একটি সুন্দর শ্লোক শুনে তাদের এখন বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। সেটি হলো, ‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।’ শুধু সিলেট কেন রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম বারবার বহুবার বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। মানুষের ঘরবাড়ি ডুবেছে, দোকানপাট তলিয়েছে। তাতে ক্ষতির পরিমাণ কত। সেটা দেখা বা শোনার কেউ কি আছে? গত কয়েক বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে জলবদ্ধতা দূর করার জন্য। দুই নগর পিতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে আর নয় জলবদ্ধতা। এবার কিন্তু নগর পিতারা সে কথা নিয়ে রা করেননি। রসিকজন মন্তব্য করেন, ঢাকা ওয়াসা যেহেতু নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে পারছে না, তাই ওয়াসাকে কমপেনসেট করছে দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা দিয়ে।
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেনি ওই মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে। কিন্তু ফলটা কী? নাকি মনে করেন, ‘সরকার কা মাল দরিয়ামে ঢাল!’

দেখা যাক, গত দেড় যুগে দেশের শ্রমিক শ্রেণী কতটা কী পেয়েছে। সরকারি সূত্র বলছে, কেবল ২০২২ সালেই বন্ধ হয়েছে ৫১০টি শিল্প। এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকায় বন্ধ হয়েছে ৯৬ প্রতিষ্ঠান, গাজীপুরে ১৫৭টি, চট্টগ্রামে ৮০টি, নারায়ণগঞ্জে ২০, মোমেনশাহীতে ছয়টি আর খুলনায় ১৫১টি। এটা তো কেবল ২০২২ সালের খবর। এরপর ২০২৩ ও ২০২৪ সালের খবর আমাদের কাছে নেই।

ছাত্রসমাজ কোটা সমস্যা নিয়ে একটি যৌক্তিক পরিণতি চেয়ে রাস্তায় নেমেছে। তাদের পুরস্কৃত করা হয় বুলেট দিয়ে। আর গর্হিত অরুচিকর ভাষায় গালাগাল দিয়ে। তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো। এখন এটা তো দৃশ্যমান কোটা সমস্যা। কিন্তু সেটা থাকলেই কী আর না থাকলে কী। চাকরিতে কোনোকালেই মেধাবীদের হওয়ার কথা নয়। শাসকদের অনুগতদের পরীক্ষায় বসার বহু আগেই তো তাদের বলে কয়ে দেয়া হবে। এভাবেই তো অনুগতদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার সব আয়োজন করা হয়েছে ছক কেটে। এভাবে গুটিকতক মানুষের কাছে দেশের কর্তৃত্বের ভার তুলে দেয়া হবে। যাতে শাসক দল ও অকৃত্রিম বন্ধুরা শত বছর ধরে পরমানন্দে এই জনপদকে শোষণ লেহন করে যেতে পারে নির্বিঘ্নে।

দেশ নিয়ে আরো অনেক দুঃসংবাদ আছে। যার অনেক কিছুই সবার জানা। কিছু মানুষ হয়তো এখনো সবটুকু সেভাবে জানেন না। গত দেড় দশকে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো অনেক উপরের নির্দেশে বাধ্য হয়ে শক্তিশালী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট কলকারখানা ব্যবসা বাণিজ্যের স্বত্বাধিকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। সেসব অর্থ কস্মিনকালেও আর ব্যাংকে ফিরবে না। প্রশ্ন হচ্ছে এসব টাকা কাদের- যা অকাতরে পানিতে ফেলা হলো? উত্তরটা খুব সহজ। টাকা এ দেশের সেইসব মানুষের- যাদের চাল, নুন, তেল কিনতে কষ্টের কোনো সীমা থাকে না। অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের। যারা সব খরচ থেকে কেটেছেঁটে তিল তিল করে একেকটি টাকা জমা করে ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখেন সম্ভাব্য দুর্যোগের কথা ভেবে। বিন্দু বিন্দু করে জমা করা সেই অর্থে হাত দিতে রক্তচোষাদের এতটুকু ভয়ডর লজ্জা শরম লাগেনি। এমন সব অপচয় আত্মসাতের জবাবদিহি কে করবে? জবাবদিহি নেয়াসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এখন বিলীন হতে চলেছে। সর্বস্তরের কর্তৃপক্ষ এখন জেগে ঘুমিয়ে আছে। এদের ঘুম তো কখনই ভাঙবে না।

শুরু করা হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থাকাদের মুখনিঃসৃত অমিয়বাণী দিয়ে। শেষও করতে চাই ওপর থেকে বলা কথা দিয়েই। একদা কোনো এক শুভ প্রভাতে একটি বাণী কানে এসেছিল। সে বাণীতে বলা হয়, এই জনপদের প্রকৃত চিত্র শহর বন্দর নগর গঞ্জ নয়, প্রকৃত চিত্রটা হচ্ছে গ্রামবাংলা। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছিল একদা। কিন্তু সত্যি কি আজ সেই চিত্রটা বজায় আছে! সরকারি ভাষ্যমতে, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের অবস্থান বর্তমান হতশ্রী সেসব গ্রামে। অপর এক শুমারি জানায়, এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে নগরে আসছে ¯্রােতের মতো করে। তারা শহরে এসে রিকশা চালায় দিনমজুরি খাটে। এখন কি তারা রং তামাশা করার জন্য এসেছে। না বাঁচার জন্য এসেছে। এদের নিয়ে আর কত পরিহাস করা হবে। এদের মুখের গ্রাস তো শাসকদের সেই সব সুহৃদ সুজনরা কেড়ে নিয়েছে। সেই সব তস্করই দারা পরিবার নিয়ে আমোদে আহলাদে দিন কাটানোর জন্য সব অপকর্ম করেছে এবং করছে। এদের তস্করপনার জন্যই কি দেশটাকে মানুষ স্বাধীন করেছে? যারা এই বৈষম্য ব্যবধান-বঞ্চনার জন্য দায়ী তারা এবং তাদের যারা তৈরি করেছে ওদের সেই পাপের স্খলন কিভাবে হবে। সেজন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। তবে মনে রাখতে হবে, সেই ভবিষ্যৎ এমনি এমনি আসবে না। তাকে আনতে মেহনত করতে হবে, সবাইকে একসাথে এক হয়ে।

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement