০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্কট প্রসঙ্গে

জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্কট প্রসঙ্গে - ছবি : নয়া দিগন্ত

(লেখাটি দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রিন্ট সংস্করণে ২৩ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে।)

বাংলাদেশ বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এমন এক ব্যতিক্রমী দেশ যেখানে ভাষা সংস্কৃতি এবং ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে প্রায় পুরো জাতি অভিন্ন। ১ শতাংশের কম মানুষ বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলে। ৯০ ভাগের বেশি মানুষ ধর্মীয়ভাবে ইসলামে বিশ্বাসী। অন্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে মুসলিমদের সহাবস্থান ও সহমর্মিতায় তেমন একটা হেরফের হয় না। সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মোটা দাগে প্রভেদ নেই। এতসব ইতিবাচক দিকের পরও বাংলাদেশ কাঠামোগত কিছু বৈরী অবস্থার মুখেও আছে। এই বৈরিতা মাঝে মাঝে সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করে, নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।

ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের মূল মানচিত্র থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। দেশটির তিন দিকে রয়েছে ভারত, একদিকের কিছু অংশে রয়েছে মিয়ানমার আর অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশি। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার যে সংযোগস্থলে রয়েছে তার অদূরে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীন, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারত আর সঙ্ঘাত ও গৃহযুদ্ধ উপদ্রুত মিয়ানমারের অবস্থান। আর এ কারণে অঞ্চলটিতে ভূ-রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত হবার মতো অনেক উপাদান বিদ্যমান। আর বঙ্গোপসাগরের যে সমুদ্রাঞ্চল বাংলাদেশের রয়েছে সেটিও নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থান বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব যেমন বাড়িয়েছে তেমনিভাবে এর নিরাপত্তায় বিপদের মাত্রাও যুক্ত করেছে।

জাতীয় নিরাপত্তার নির্ণায়ক
একটি দেশের ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নিশ্চিত করার জন্য চূড়ান্ত শর্ত। ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব যখন বিপন্ন হয় তখন স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বও লুপ্ত হয়। তবে এই সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবার জন্য আরো বেশ কটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে ৭টি বিষয়কে জাতীয় নিরাপত্তার ধারায় সম্পৃক্ত করা হয়। এগুলো হলো, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সাধারণ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা। ওই প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, মানবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ওইসব বিষয়কে নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। ইউএনডিপির প্রতিবেদনে এসব বিষয়ের সমন্বিত নিরাপত্তাকে সার্বিক নিরাপত্তা ধারণা হিসাবে বিশ্লেষণ করা হয়।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় উন্নত বিশ্বের অবস্থান ভিন্নতর। তাদের প্রধান নিরাপত্তা ভাবনা বহিঃশক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার সেই গতানুগতিক চিন্তাধারাতেই সংশ্লিষ্ট, তবে এটাও ঠিক যে উন্নত বা অনুন্নত বিশ্বের এ ধরনের সমীকরণ বাস্তব অবস্থার নির্দেশক নয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, অনুন্নত বিশ্বের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো বহিঃনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সংবেদনশীল করে তোলে। আর উন্নত বিশ্বের বাইরের সমস্যা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে স্পর্শকাতর করে তোলে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বিষয়সমূহ কিভাবে সীমান্ত নিরাপত্তাকে অধিকতর সংবেদনশীল করে তুলেছে সেটি উদাহরণ হিসাবে গণ্য হতে পারে।

দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অস্থিরতা
কোনো জনপদের রাজনৈতিক উত্থান পতন যখন ভূরাজনৈতিক সঙ্কটের ঘনঘটা তৈরি করে তখন একের পর এক অঘটন দেখা যায়। তেমনি অঘটন ঘটছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্ত-ঘেঁষা অঞ্চলসমূহে। সেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে ওই দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী। সরকারি বাহিনীর পলায়নপর সদস্যরা মূল ভূূখণ্ডে ফিরতে না পেরে ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পালিয়ে আসছে। এতদিন এই যুদ্ধকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা হলেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বা সেনা সদস্যের একের পর এক অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশে।

ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের তিন বছর পেরিয়ে গেছে। দুটি পূর্ববর্তী অভ্যুত্থানের সাথে যুক্ত মিয়ানমারের জেনারেলরা ভেবেছিলেন যে তারা সহজেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। কিন্তু তিন বছর পর মিয়ানমার অব্যাহত বিপর্যয়ে ডুবে যাচ্ছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর গত তিন বছরের বেশি সময়ে মিয়ানমার ঐতিহাসিক কিছু পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে। অভ্যুত্থান জনগণের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হলে যথারীতি, সামরিক বাহিনী নির্মমভাবে বিক্ষোভকারীদের দমন করে। কিন্তু এবার মানুষ পাল্টা হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। তরুণরা জাতিগত সশস্ত্রগোষ্ঠী (ইএও) নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং সমষ্টিগতভাবে গণপ্রতিরক্ষা বাহিনী (পিডিএফ) নামে প্রতিরোধগোষ্ঠী গঠন করে। তখন থেকেই ইএও’র পাশাপাশি জান্তা শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে পিডিএফ।

বিদেশী পর্যবেক্ষকরা প্রাথমিক দিনগুলোতে পিডিএফকে অবমূল্যায়ন করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে তারা কয়েক মাসের মধ্যে সামরিক বাহিনীর দ্বারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হবে। কিন্তু তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ হয়। দেশব্যাপী প্রতিরোধের কারণে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং এখন পর্যন্ত দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা তো করতেই পারেননি, বরং সামরিক বাহিনী গত সাড়ে তিন বছরে ইএও ও পিডিএফের কাছে কয়েক ডজন শহর ও বিশাল এলাকা হারিয়েছে।

এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি
মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এ দুটি রাষ্ট্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। বিকাশমান এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। সামরিক শাসনের দীর্ঘস্থায়ী ছায়াসহ একটি সদ্যজাত গণতন্ত্র হিসাবে মিয়ানমারও মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল। জাতিগত বিভাজনে জর্জরিত এবং ভারত ও চীন এর মধ্যে অবস্থানের কারণে এটি উচ্চ মাত্রার ভূকৌশলগত গুরুত্ব লাভ করে। বছরের পর বছর ধরে, মিয়ানমার শুধু চীন বা ভারতের জন্য মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়নি একই সাথে রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে। সাম্প্রতিক অতীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভূরাজনৈতিক পশ্চিমের কিছু অংশও মিয়ানমারকে বিশেষ মনোযোগের কেন্দ্র বানিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে চীনের অবস্থানটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে প্রাচীন সামুদ্রিক ‘সিল্ক রুট’ পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। সে সাথে রয়েছে তার ক্রমবর্ধমান শক্তির চাহিদা পূরণ করার জন্য জ্বালানি অ্যাক্সেস তৈরি করার স্বার্থ। ভারতও তার চাহিদা পূরণ করতে কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে একটি কানেকটিভিটি তৈরি করতে চেয়েছে রাখাইন ও চিন প্রদেশের মধ্য দিয়ে পূর্বাংশের ৭ রাজ্যের সাথে। বাংলাদেশের রাখাইন রাজ্যের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে, যা এখন ক্রমবর্ধমান ভূকৌশলগত গুরুত্ব পাচ্ছে। যদিও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠাণ্ডা ও উষ্ণতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে।

রোহিঙ্গা ফ্যাক্টর
মিয়ানমার বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষে জীবন ও বাড়িঘর ধ্বংস হচ্ছে। সঙ্কট আরো গভীর হচ্ছে যখন আরাকান আর্মি ও সামরিক জান্তা ইচ্ছাকৃতভাবে আরাকান থেকে বাকি সব রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক নির্বাসনের জন্য রোহিঙ্গা গ্রামে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সঙ্ঘাত। আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।

আরাকান আর্মি ও মিলিটারি জান্তা রোহিঙ্গা গ্রামে আর্টিলারি ব্যবহার করার ফলে আরাকানে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে, যার ফলে চরম দুর্ভোগ হয়। আরএসও দাবি করছে, যুদ্ধরতদের কৌশলের মধ্যে রয়েছে বেসামরিক নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ভয় ছড়ানো এবং অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা। এখন এক কথায় সেখানকার অবস্থা ভয়াবহ। আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিলে শান্তি আসবে বলে কোনোভাবেই মনে হয় না। লাখ লাখ রোহিঙ্গা তাদের জন্মভূমি আরাকানের জন্য আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে আছে। নৃশংসতা এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার তাদের স্বাধীনতার তৃষ্ণা আরো গভীর করে তুলছে। আরাকানের মুক্তির জন্য তাদের চেতনা প্রতিটি অন্যায়ের সাথে শক্তিশালী হয়ে ওঠে বলে আরএসও তাদের এক এক্স টুইটে উল্লেখ করেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসাবে একটি বৈশ্বিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগণের ব্যাপক বিতাড়নে সেটি আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এর আগে ১৯৭৮, ১৯৯১, ২০১২ থেকে ২০১৫ এবং আবার ২০১৬ সালে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের যদি একটি টেকসই সমাধান না হয় তাহলে সার্বিক সঙ্কট অব্যাহত থাকবে।

অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক উপায়ে সঙ্কটের সমাধানের পথ চেয়েছে এবং দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিকসহ সব উপকরণ ব্যবহার করেছে। বহুপক্ষীয় পন্থার অংশ হিসাবে ব্যাক-চ্যানেল কূটনীতিতে সংলাপ ও স্বাভাবিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী না হয়ে পুরো দেশকে একটি সঙ্ঘাতে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একটি শান্তিপূর্ণ, টেকসই এবং দ্রুত সমাধান সঙ্কটের শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্বার্থেই নয় বিস্তৃত অঞ্চলের স্বার্থেই প্রয়োজন। আর এ জন্য আরাকানের ভেতরেই রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। এটি হতে পারে আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার বাহিনীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে অথবা হতে পারে প্রতিরোধ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে।

বিচ্ছিন্নতার সঙ্কট
বাংলাদেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত। একসময় এটি ছিল চট্টগ্রাম জেলার আওতাধীন। পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে আলাদা জেলা করা হয়। এখন তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত। এ তিন জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে চাকমা উপজাতির বসবাস বেশি। এরপর রয়েছে ত্রিপুরা উপজাতির বসবাস। অন্য দিকে বান্দরবানে মারমা উপজাতির বসবাস সবচেয়ে বেশি। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির পাহাড়ি চূড়া বা এর আশপাশে বম বা কুকিরা বসবাস করে। সংখ্যায় তারা খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও দুর্গম অঞ্চলে বসবাসের কারণে তাদের বসবাস অঞ্চল বেশ বিস্তৃত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে বসতি করলেও নৃতাত্ত্বিকভাবে তারা মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীভুক্ত। এ হিসাবে উপজাতিসমূহের মধ্যে অমিল যেমন রয়েছে তেমনি মিলও আছে। সে তুলনায় পার্বত্যাঞ্চলের সমতল এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের সাথে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারাগত মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। বাংলাদেশের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাহাড়ি উপজাতিরা এ কারণে মাঝে মধ্যে বিপন্ন বোধ করে। তারা নিজস্ব রাজাদের অধীনে থেকে ভূমি ব্যবস্থাপনা ভোগ করার কারণে সমতলের সব বিধিবিধান তাদের জন্য প্রযোজ্য হয় না।

অন্য দিকে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের এক-দশমাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও তা আহরণ স্থানীয় বাস্তবতা ও অন্যান্য কারণে হয়নি। অধিকন্তু ষাটের দশকে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা বাস্তুচ্যুতির মুখে পড়ে। এই বঞ্চনাবোধ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের বীজ বপন করে। এরপর স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে সরকারপ্রধানের পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে মিলে যাবার আহ্বান সেটিকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হবার প্রবণতার দিকে নিয়ে যায়। পাহাড়িরা জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এরপর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সংগঠিত হয়ে প্রতিবেশী দেশে গিয়ে ‘শান্তি বাহিনী’ নামে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি সঙ্ঘাত অঞ্চল। ’৯০-এর দ্বিতীয়ার্ধে আওয়ামী লীগ নতুন করে সরকার গঠন করলে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এই সঙ্ঘাতের অবসানের উদ্যোগ নেয়া হয়। শান্তিচুক্তির পর সরকারি প্রশাসনের ক্ষমতার একটি অংশ আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়। অন্য দিকে পার্বত্য জেলাসমূহ থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে পার্বত্যাঞ্চলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও শিথিল হয় যা পূরণ করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতারা।
নানা ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্যেও শান্তি চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত এক ধরনের স্থিতি বজায় ছিল পার্বত্য জেলাগুলোতে। ২০১৭ সালে আরাকানে গণহত্যা ও নির্মূল অভিযানে ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসার পর এ অঞ্চলে বৈশ্বিক মনোযোগ বেড়ে যায়। ২০২১ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখলের পর এ অঞ্চলের প্রতি বৈশ্বিক রাজনীতির ফোকাস আরো বেড়ে যায়। গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানোর পর মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী লড়াই নতুন রূপ নেয়। ক্ষমতাচ্যুত সু চির এনএলডি সমান্তরাল জাতীয় ঐক্য সরকার গঠন করে। একই সাথে জান্তা শাসনকে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করতে মিলিশিয়া বাহিনী পিডিএফ গঠন করে।

সামরিক অভ্যুত্থানে তিন বছর পূর্তি হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। সশস্ত্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো ও পিডিএফ মিলে মিয়ানমারের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সেনাবাহিনী ক্রমেই বড় বড় শহরে সীমিত হয়ে পড়ছে। রাখাইন থেকে শুরু করে চিন সাগাইং কাচিন শান হয়ে কারেন স্টেট পর্যন্ত সীমান্তবর্তী এলাকার ওপর মিয়ানমারের সেনা সরকার কার্যত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। চীন সীমান্তের শান ও কাচিন স্টেটের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর ওপর আগে থেকেই চীনা প্রভাব ছিল। এখন ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাজ্যের সশস্ত্র এলাকাগুলোর ওপরও চীনা প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠনের মাধ্যমে। রাখাইনের শক্তিশালী আরাকান আর্মিসহ এই রাজ্যগুলোর সশস্ত্র তিন নৃতাত্ত্বিক সংগঠন মিলে এই ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠন করেছে। তাদের অগ্রাভিযানে রাখাইন থেকে চিন সাগাইং হয়ে শান স্টেট পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা বাহিনী। বিদ্রোহীদের তৎপরতা মান্দালয় পার হয়ে রাজধানী নেপাইথো পর্যন্ত চলে গেছে। পিডিএফের অভিযানে বামার অঞ্চলের যেসব রাজ্যে জান্তার নিয়ন্ত্রণ ছিল সেগুলোও একে একে হাতছাড়া হচ্ছে।

এরপর শেষাংশ আগামীকাল
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন : তাজুল ইসলাম চিফ প্রসিকিউটর আবুধাবির কারাগার থেকে দেশে ফিরেছেন ১৪ বীর কোনাবাড়ীতে কলেজছাত্রকে গুলি করে হত্যা : কনস্টেবল গ্রেফতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তগুলো যৌক্তিক : ফখরুল ‘একটি চক্র জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ অস্ত্র জমা দেয়নি শামীম ওসমান ও গাজী পরিবার এবি পার্টির উপদেষ্টার পদ ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া নিয়ে বিতর্কে মন্ত্রণালয়ের দুঃখ প্রকাশ আশুলিয়ায় শ্রমিক দলের সমাবেশে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৫ রূপগঞ্জে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা না দেয়া ডাক্তারদের সনদ বাতিলের দাবি ড্যাবের

সকল