০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

জেদ ও বল প্রয়োগের পরিণতি

জেদ ও বল প্রয়োগের পরিণতি - ছবি : নয়া দিগন্ত

(লেখাটি নয়া দিগন্ত প্রিন্ট সংস্করণে ২৩ জুলাই, ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে)

দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত রোববার সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ব্যাপারে কোটাবিষয়ক রায় দিয়েছেন। রায়ে সরকারি চাকরির নিয়োগে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা-শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ এবং অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ সংরক্ষণের আদেশ দিয়েছেন আদালত। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে কোটা সংস্কারের একটি সুরাহা হয়েছে বটে; কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের জন্য চড়া মূল্য দিতে হলো, এটিই এখন সবার বেদনার কারণ।

কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে গত পাঁচ দিনে (মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি ও রোববার) অন্তত ১৭৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েক হাজার। আর রাষ্ট্রীয় স্থাপনাসহ সম্পদের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা অবর্ণনীয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবি আদায়ে কেন, কীভাবে এমন বীভৎস ঘটনা ঘটতে পারল? কেন আন্দোলনকারীদের চড়া মূল্য দিতে হলো? বাস্তবে ছাত্রসমাজের একটি যৌক্তিক দাবি নিয়ে সরকার নানা টালবাহানায় সময় ক্ষেপণ করেছে। বিভিন্ন সময় নানা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি অহেতুক বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ স্কুল-কলেজের অল্প বয়সী ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকরা যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে রাস্তায় নেমে আসেন, তখন সেই আন্দোলনের আবেগ ও স্পর্শকাতরতা সরকারি নীতিনির্ধারকরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তা না হলে ক্ষীপ্রগতিতে কোটা সংস্কারে উদ্যোগী হতেন তারা। তাদের এই ব্যর্থতা এবং বুঝে উঠতে না পারার খেসারত দিতে হলো এতগুলো তরতাজা প্রাণকে, যারা ঝরে পড়লেন মৃত্যুর কোলে এবং বিপুল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। অথচ সরকারের বর্তমান অবস্থান থেকে বোঝা যায়, শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল। এর পরিবর্তে দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা করতে উসকে দেয়া হয়। পরিণতিতে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। পরিণামে এত প্রাণ ঝরেছে। প্রথম দিকে চলমান ছাত্র আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছ থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অবস্থান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়ি রকম বল প্রয়োগ করার কারণে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়।

স্মরণযোগ্য যে অতীতেও বিভিন্ন দাবিতে ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। তখন এত প্রাণ দিতে হয়নি। কিন্তু ৫৩ বছর বয়সী স্বাধীন বাংলাদেশে এবার পুলিশের হাতে এত বিপুল প্রাণের অপচয় হলো। এর জবাব কিভাবে দেবেন ক্ষমতাসীনরা, তা আমাদের জানা নেই।

সবার স্মরণে থাকার কথা, কোটা আন্দোলন সর্বপ্রথম ২০১৬ সালে শুরু হয়েছিল। প্রথম দিকে বিবৃতি দিয়ে সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার কোনো বিবৃতি-আবেদন আমলে নেয়নি। পরে ২০১৮ সালে কোট সংস্কার আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে ছাত্ররা ধর্মঘট-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেন; তখন একপর্যায়ে সরকার পরিপত্র জারি করে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেয়। এর বিরুদ্ধে ২০২১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাত সন্তান হাইকোর্টে একটি রিট করেন। রিটের নিষ্পত্তি করে গত ৫ জুন সরকারের জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। এ রায় ঘোষণার পর ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলন শুরু করেন। পরে সারা দেশে ওই আন্দোলন দুর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। স্মরণযোগ্য যে, বর্তমান আন্দোলন দীর্ঘ প্রায় এক মাস শান্তিপূর্ণ ও অহিংস ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কেন একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন এমন সহিংস হয়ে উঠল? কাদের কারণে আন্দোলন এমন সঙ্ঘাতময় হয়ে উঠল তা খোলাসা হওয়া দরকার। এ কথা সহজে বলা যায়, যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন করছেন, তাদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক মতলব কাজ করেছে বলে মনে হয়নি কারো। দেশের বেসরকারি খাতে সম্মানজনক কর্মসংস্থান না থাকায় তাদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র সরকারি চাকরিতে সীমাবদ্ধ হয়ে আসায় ছাত্রছাত্রীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছেন।

উপরিউক্ত এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের চলমান আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ বাধার আগের কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে চোখ রাখতে হবে। তাতে দেখা যাবে, সরকারের একাধিক মন্ত্রী আন্দোলনকারীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। উপহাস করেছেন। এতে করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা চালানোর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এখান থেকে শুরু আন্দোলনের সহিংস রূপ নেয়া। ছাত্রলীগ-যুবলীগের আক্রমণে সৃষ্ট সংঘর্ষে গত মঙ্গলবার ছয়জনের প্রাণ ঝরে। ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমান সময়ে কত অজনপ্রিয়, তার নমুনা পাওয়া যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বিতাড়নের ভেতর দিয়ে। সেই তারা আন্দোলনকারীদের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পারলে পুলিশ বাহিনীকে মাঠে নামানো হয়। পরে দেখা গেল, পুলিশও আর পেরে উঠছে না। একপর্যায়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত করা হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় সরকার কারফিউ জারি করে। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কারফিউয়ের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে গত শনিবার ২৬ জন ও রোববার ১২ জনের প্রাণহানির খবর বেড়িয়েছে গণমাধ্যমে। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এবারের আন্দোলন দমাতেও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ছুড়েছে পুলিশ। এর জ্বলন্ত প্রমাণ রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র ছাত্র আবু সাঈদের বুক বরাবর নিশানা করে গুলি চালানোর ঘটনা। পুলিশের ছোড়া গুলিতে আবু সাঈদ মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আবু সাঈদের হত্যার আগ মুহূর্তের ছবি দেখে যে কেউ বলবেন, তাকে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী পুলিশ সদস্যের দুর্ভাগ্য হলো, আবু সাঈদ মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তের যে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, আমাদের দেশে ওই ছবি ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়ানো ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক হয়ে থাকবে বহু বছর, এটি সহজে অনুমেয়।

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শুধু আবু সাঈদই মারা যাননি। আরো অনেকে মারা গেছেন। আন্দোলনে নিহত হওয়া অনেকের নিষ্পাপ ছবি গণমাধ্যমে দেখে সংবাদপত্র পাঠকের বেদনা আরো গভীর হয়েছে। তীব্র দুঃখবোধ তাদের গ্রাস করেছে। এত মানুষ মারা যাওয়ায় দল-মত নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ গভীরভাবে মর্মাহত। বলা চলে, সবাই এমন মর্মান্তিক ঘটনায় নির্বাক। বাকরুদ্ধ। এ ঘটনায় দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কবে নাগাদ আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা বলা মুশকিল। অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করায় দেশের চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় ইতোমধ্যে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এমনিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থা। চলমান ছাত্র আন্দোলনে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় শহরাঞ্চলে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়ে গেছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ এবং শ্রমজীবীদের কষ্ট আরো তীব্রতর হয়েছে। লাগাতারভাবে যে সঙ্ঘাত ও সহিংসতা চলছে, তাতে সারা দেশের জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

চলমান ছাত্র আন্দোলন সঙ্ঘাতময় হয়ে ওঠার পেছনে সকারের একগুঁয়েমি ও জেদ অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন দেশের সচেতন নাগরিকরা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রথম থেকে যদি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে আমলে নিয়ে সরকার এর যৌক্তিক সমাধানে উদ্যোগী হতো; তা হলে আজকের এ বীভৎস পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দেশের নীতিনির্ধারকরা শেষপর্যন্ত গণদাবি মেনে নেন, তবে ঘোরা পথে। অনেক দেরিতে। ততক্ষণে জানমালের বিপুল ক্ষতির শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষকে। এই অদূরদর্শী নেতৃত্ব কবে দূরদর্শী হবে তা কারো জানা নেই।


আরো সংবাদ



premium cement