২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অর্থনীতি অচল, সামনে অন্ধকার

অর্থনীতি অচল, সামনে অন্ধকার - ছবি : নয়া দিগন্ত

আমাদের অর্থনীতি ক্রমে নিমজ্জমান। বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতির প্রতিটি খাতের যে চিত্র তুলে ধরছেন; তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক তুলে ধরে তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র কৃষি ছাড়া অর্থনীতির সব খাতে নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করছে। কৃষিতেও শুধু প্রধান খাদ্যশস্য ধান ছাড়া আর কোনো শস্যে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নেই। অর্থাৎ ধান ছাড়া আর সব কিছুতে আমরা আংশিক বা পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর।

দেশের অর্থনীতির এই যখন অবস্থা, তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ফোরামের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশ যে সহিংসতা ও মৃত্যুর মিছিল প্রত্যক্ষ করলো তা স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এক সপ্তাহের আন্দোলনে নিরীহ ছাত্র-জনতাসহ পৌনে দুশো মানুষের মৃত্যু কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মৃত্যুর মিছিল ও ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াতে প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান আসতে পারে সুদৃঢ় জাতীয় সংহতি এবং আর্থিক খাতের সুষ্ঠু ও সমন্বিত উদ্যোগ থেকে। জাতীয় সংহতি জোরদারের অনুকূল পরিবেশ গত ৫৩ বছর ধরে নেই।

জাতিকে বিভক্ত করে একটা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ঝোঁক-প্রবণতা স্পষ্ট। আর্থিক খাতে সুশাসনের বিকল্প নেই। এমন কথা সবাই বলেন। কিন্তু বাস্তবে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখতে পাচ্ছি গত দেড় দশকের ক্ষমতাসীনদের কর্মকাণ্ডে। তার অনিবার্য কুফল হিসেবে দুর্নীতি, লুটতরাজ, অর্থপাচার, দখলবাজি সর্বব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। ফলে অর্থনীতির প্রতিটি খাতে ধস নেমেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের নিরাপত্তা পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। সব দিক থেকে অর্থনীতি যখন ডুবন্ত জাহাজের মতো তারস্বরে বিপন্নতার ভেঁপু বাজিয়ে চলেছে; তখন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি অর্থনীতির ওপর চরম আঘাত হেনেছে।

গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে আমদানি-রফতানি, শিল্প-কারখানা, দেশ-বিদেশের লেনদেন, শেয়ারবাজার, পণ্য সরবরাহ এবং ইন্টারনেটভিত্তিক সব পরিষেবা বন্ধ রয়েছে। করোনার সর্বাত্মক লকডাউনের সময়ও মানুষ ঘরে বসে কাজ করতে পারতো। কিন্তু এবারের আন্দোলনে মানুষ ঘরে বসেও কাজ করতে পারছে না। পুরো দেশের আর্থিক কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে সম্পূর্ণ অচলাবস্থা। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ডিজিটাল সেবা ব্যাহত।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অচলাবস্থার একটি সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতিসহ পুরো জাতীয় জীবনে। বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জে পড়বে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি, বাড়বে অনিশ্চয়তা। ভবিষ্যতে অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। শুধু অর্থনীতি নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ গত দেড় দশকের শাসনে আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো কিছু স্বাভাবিক নেই। সুষ্ঠু রাজনীতির অবসান ঘটেছে। নির্বাচনব্যবস্থা বলে নেই হয়ে গেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর এবং মানুষের মৌলিক অধিকার অবদমিত হয়েছে।

কিন্তু সব কিছুর ওপরে সামনে আসছে বর্তমান অচলাবস্থার বিষয়টি। একটি ন্যায্য দাবির আন্দোলন বরাবরের মতো পেটুয়াবাহিনী দিয়ে শক্তির জোরে নস্যাৎ করতে গিয়ে পরিস্থিতি স্থলমাইনের মতো বিস্ফোরিত হয়েছে। আমরা গত কয়েক দিনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের কিছু মন্তব্য দেখে নিতে পারি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের বড় স্থাপনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। এগুলো মেরামত করতে হলে উন্নয়ন বাজেট থেকে ব্যয় করতে হবে। এতে অন্যান্য খাতে বরাদ্দ কমে যাবে। ... পরিস্থিতি কিভাবে সমাধান করা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ছোট একটি সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে অনেক বড় করে ফেলা হয়েছে। দ্রুত এর রাজনৈতিক সমাধান দরকার। কারণ কারফিউ বেশিদিন চলতে পারে না। অর্থনীতিতে এর বিশাল প্রভাব পড়বে। সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয়, বাজেট বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যক্তিগত মানুষের আয়-ব্যয় সবকিছুতেই প্রভাব ফেলবে।... এমনিতে কৃষি ছাড়া অর্থনীতির সব খাত শূন্যের কাছাকাছি। অনেক খাতেই জবাবদিহি নেই। এর মধ্যেই হঠাৎ অচলাবস্থা। ... এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের জীবন ধারণ মুশকিল হয়ে যাবে। ... পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ, কলকারখানায় উৎপাদন নেই, হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ। মানুষ কিভাবে খাবার কিনবেন। বাসা ভাড়া দেয়ার টাকা পাবেন কোথায়? সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স কিভাবে আদায় হবে। এটি উদ্বেগের বিষয়।’

উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেন, গত কয়েক দিনে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির থাকার স্বল্পমেয়াদি প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। সেগুলো অর্থনীতিতে অবশ্যই আসবে। ইতোমধ্যে আমদানি, রফতানি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, লেনদেন, পণ্যের সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে। যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতোমধ্যে খারাপ বার্তা চলে গেছে। এ অবস্থায় কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। অর্থাৎ বিনিয়োগেও প্রভাব পড়বে। সবকিছু মিলে অর্থনীতির জন্য খারাপ বার্তাই আসছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামীতে অতিরিক্ত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এই অতিরিক্ত পদক্ষেপ কতটা সম্ভব হবে সেটি বড় বিষয়।’
অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন, ‘আমি সামনে অন্ধকার দেখছি। অর্থনীতিতে হতাশা আসছে। কারণ, ব্যাংক, শেয়ারবাজার, বিমা, আমদানি, রফতানি, ফ্রিল্যান্সিং কার্যক্রমসহ আমাদের সবকিছু বন্ধ। ... আগামীতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। টাকার মান কমবে। ইতোমধ্যে রফতানি আদেশ বাতিল হওয়া শুরু হয়েছে। আর রফতানি কমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে বাধ্য।... আগামীতে বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। কারণ ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে।... এ অবস্থায় দেশজ উৎপাদন ৬ দশমিক ৭৫ শতাশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে রাখা অসম্ভব হবে।’

অর্থনীতিবিদদের এসব মন্তব্য গত রোববারের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরেও প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় তাদের বক্তব্য এসেছে।

অনেকে বলেছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে-বিদেশে বিনিয়োগকারীদের কাছে খারাপ বার্তা চলে গেছে। দেশে ব্যবসায়ীদের আস্থা ভেঙে পড়েছে। এটি কিন্তু নতুন কোনো বিষয় নয়। সুশাসন না থাকায় অর্থনীতিতে অনাস্থা তৈরি হয়েছে আগে থেকে, যার প্রমাণ রফতানির অর্থ দেশে না এনে বিদেশে রেখে দেয়া, অনেক ব্যবসায়ীর বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে যাওয়া। এমনকি কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ বেআইনিভাবে বিদেশে টাকা পাচার করেছে এমনও অভিযোগ রয়েছে। গত দেড় দশক ধরে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আসছে সামান্য পরিমাণে। অর্থনীতির প্রাণশক্তি বলে কথিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। অবিশ্বাস্য পরিমাণ খেলাপি ঋণের ভারে পুরো আর্থিক খাত এখন ভঙ্গুর। দুর্বল ব্যাংকগুলো কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখতে মার্জার বা একীভূত করা তথা ভেন্টিলেশনে রাখার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এতে কোনো কাজ হবে বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা।

আন্দোলন দমনে কারফিউ ও সেনা মোতায়েনে সৃষ্ট বর্তমান অচলাবস্থায় অর্থনৈতিক খাতে কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে তার একটি সামান্য ধারণা করা যাবে গত মঙ্গলবারের বিভিন্ন দৈনিকের শিরোনাম লক্ষ করলে। এক নজরে আমরা দেখে নিতে পারি। ‘তৈরী পোশাক খাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা।’ ‘দোকানপাট বন্ধ থাকায় দিনে ২০০০ কোটি টাকা ক্ষতি।’ ‘সফটওয়্যার খাতে দৈনিক ক্ষতি ৮০ কোটি টাকা।’ ‘মাছ আম সবজিতে হাতছাড়া শতকোটি টাকার বাজার।’ ‘ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ৫ লাখ ফ্রিল্যান্সার ক্ষতিগ্রস্ত।’ এর বাইরে মনে রাখতে হবে, এমন কোনো খাত নেই যা এই সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ছে সার্বিক জনজীবনে, সাধারণ মানুষের ওপর। পণ্য সরবরাহ বিঘিœত হওয়ায় এবং সেই অজুহাত দেখিয়ে বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। শাক-সবজিসহ নিত্যপণ্য ও খাদ্যপণ্যের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বোঝার উপায় নেই।

সব মিলিয়ে দেশে খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সহজ ভাষায় বলছেন, সামনে আলোর কোনো আভাস দেখা যাচ্ছে না। বরং এক গভীর অন্ধকারের ভেতর আমরা যে ঢুকতে যাচ্ছি তাতে সন্দেহ নেই।

তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ইতিবাচক কোনো অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। না রাজনৈতিক, না অর্থনীতির ক্ষেত্রে। যে কোনো ব্যর্থতায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপানোর সেই পুরনো প্রথাই তারা অনুসরণ করছেন। শুধু তাই নয়, নজিরবিহীন সঙ্কটময় এ মুহূর্তে যখন ইতিকর্তব্য নির্ধারণে সব রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার তখন নতুন করে ক্র্যাকডাউন শুরু করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এবার আর সহজে ছাড় দেয়া হবে না।
সুতরাং আগামী দিনের বাংলাদেশের ছবিটা কেমন হতে পারে তা সহজে বোধগম্য। অবস্থা এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে; যা কারো জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এ প্রসঙ্গে ছেলেবেলায় স্কুলের বাংলা বইয়ে পড়া একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে।

এক মাঝি বড় নদীতে নৌকায় যাত্রী পারাপার করতেন। হঠাৎ একদিন তার চলাচলের পথে স্টিমার চালু হলো। সব যাত্রী স্টিমারে চলাচল করতে শুরু করল। যাত্রী না পাওয়ায় বেচারা মাঝির জীবন-জীবিকা পড়ে গেল চরম হুমকিতে। ঘরে খাবার জোটে না। প্রতিদিন মাঝি মন খারাপ করে এক দু’জন যাত্রী নিয়ে নদী পারাপার করেন আর স্টিমারকে অভিশাপ দেন। যেন সেটির ওপর খোদায়ী গজব নেমে আসে। একদিন নদীতে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। ঝড়ের তীব্রতা এত বেশি যে, বিশাল স্টিমারও বিপন্ন হয়ে ঘন ঘন ভেঁপু বাজাতে থাকে। এই বিপদসঙ্কেত শুনে মাঝি খুশি হয়ে ওঠেন। খোদা শেষ পর্যন্ত তার আরজি কবুল করেছেন। জাহাজ ডুবে গেলে আবার তার জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু হঠাৎ মাঝির মনে ভিন্ন বোধের উদয় হলো। স্টিমার ডুবে গেলে তার ভালো হতে পারে, কিন্তু শত শত যাত্রীর মৃত্যু যে অনিবার্য! মাঝি নিজের জীবন বিপন্ন করে তার ছোট্ট নৌকা নিয়ে বিপন্ন স্টিমারের দিকে এগোতে শুরু করলেন, ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাতে হবে তো!

আমাদের সবার একটু ভাববার অবকাশ আছে। জাহাজ ডুবলে কোম্পানি দেউলিয়া হবে না। কিন্তু মানুষের কী হবে? মানুষ বাঁচাতে পারবো তো!

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল