২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সামাজিক ও নৈতিক অপরাধ : জুয়া

সামাজিক ও নৈতিক অপরাধ : জুয়া - ফাইল ছবি

ইদানীং বিভিন্ন সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের সাথে সাথে বিভিন্ন নামে জুয়ার ভয়াবহ প্রসার অপরাধজগতে নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে। এ সামাজিক ব্যাধির সাথে ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা তৈরি করছে সামাজিক অস্থিরতা, দায়বদ্ধতা ও আইনের শাসনের দুর্বলতা। জুয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জুয়ার নেশা মানুষকে সর্বস্বান্ত করার সাথে সাথে পারিবারিক জীবন বিষিয়ে তোলে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, অনৈতিক ও অসৎ কাজের বিস্তারের পরিবেশ তৈরি করে। জীবন বিষাদময় করে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘লোকেরা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ।’ (২ : ২১৯) অন্যত্র সূরা মায়েদার ৯০-৯১ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্যনির্ণায়ক তীর নিক্ষেপ শয়তানের কাজ। সুতরাং তা বর্জন করো। শয়তান তো মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়াতে চায় এবং আল্লাহর স্মরণে তোমাদের বাধা দেয়।’ ইসলামী জীবনাচারে জুয়া ও ভাগ্যনির্ণায়ক যেকোনো ধরনের কাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে জীবিকার্জন হতে হবে সৎ উপায়ে, কায়িক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমের মাধ্যমে। এখানে ভাগ্যক্রমের কোনো স্থান নেই। জুয়া হচ্ছে প্রতারণা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

জুয়া মানুষকে ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল করে অলস বানিয়ে ফেলে। জাতীয়ভাবে সার্বিক অর্থনীতির ওপর ঋণাত্মক প্রভাব সৃষ্টির সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বিরোধী মনোভাব তৈরির মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। চারিত্রিক কাঠামো ধ্বংস করে দেয়। এটি একটি পরিবার ও সমাজবিধ্বংসী কাজ। অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবণতা তৈরির প্রক্রিয়া। ঋগবেদে জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করতে বলা হয়েছে। জুয়াকে অপরাধী কার্যক্রম ও প্রকাশ্য চুরি ঘোষণা করে শাসনকর্তাকে এজন্য শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মূল কারণ ছিল জুয়া নামক পাশাখেলার মাধ্যমে প্রতারণা।
বাইবেলে ‘অর্থের নেশা সব অনর্থের মূল’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে- অসৎ পথে অর্থ উপার্জন অপরাধ। (১৩ : ১১) ১৯৮৪ সালে ইহুদি ধর্মবেত্তাদের সংগঠন ‘সেন্ট্রাল কনফারেন্স অব আমেরিকান রাব্বিস’ জুয়াকে অগ্রহণীয় বলে ঘোষণা করেছে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে জুয়াকে অবৈধ বলা হয়েছে তাওরাতে। গৌতম বুদ্ধ জুয়াকে অকল্যাণকর উল্লেখ করে জুয়াড়ির সাক্ষ্যকে অগ্রহণীয় বলেছেন; জুয়াড়ির সমাজ-সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করেছেন, তাকে বিয়ের অনুপযুক্ত ঘোষণা করেছেন। মোটকথা, পৃথিবীর কোনো ধর্মমতে ও কল্যাণমুখী সমাজব্যবস্থায় জুয়াকে বৈধতা দেয়া হয়নি। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। নৈতিকতাবিরোধী কাজ।

দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের তকমায় অভিষিক্ত আমাদের দেশে জুয়ার অবস্থান অবাক করার মতো। ২৫ জুন ২০২৪ প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে জুয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান; রীতিমতো পিলে চমকানো তথ্য। তিনি বলেছেন, ‘৫০ লাখ মানুষ কীভাবে যেন এই অবৈধ জুয়ার সাইটগুলোতে জড়িয়ে গেছেন।’ একই প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ বি এম মইনুল হোসেনের বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার। তার ভাষ্য মতে, এসবের পেছনে কারা কিভাবে জড়িত তা সরকার সহজে বের করতে পারে। সরকারিভাবে এ দেশে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও জুয়া এভাবে ছড়িয়ে পড়াটা সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের দিকনির্দেশক।

স্মার্টফোনের বদৌলতে অনলাইন জুয়ার বিস্তার এক দিকে যেমন সামাজিক নৈতিক অধোগতির দিকনির্দেশক, তেমনি একই সাথে অর্থনীতিতে এর প্রভাব আতঙ্কজনক। অর্থমন্ত্রী ৯ মে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, অনলাইন জুয়া, বেটিং, গেমিং, ফরেক্স, ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং, হুন্ডি ইত্যাদি অপরাধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। অনলাইনে এসব পোর্টালের বিজ্ঞাপনে ব্যয় হয় বছরে ১৫ কোটি টাকা।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবারে ব্যবহৃত হচ্ছে স্মার্টফোন। এর কল্যাণে জুয়ায় জড়িত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিশোর ও তরুণরা; কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা। স্মার্টফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন আকর্ষণীয় পোর্টালে আসছে জুয়ার চটকদার বিজ্ঞাপন। তরুণ-তরুণীরা, কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সহজে এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে পা বাড়াচ্ছেন এ সামাজিক অপরাধের অন্ধকার জগতে। জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন অসামাজিক অনৈতিক কাজে। সরকারিভাবে দুই হাজার ৬০০টি অনলাইন জুয়ার পোর্টাল বন্ধ করার পরও অবস্থা সামাল দেয়া যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না হওয়ায় অসংখ্য বেকার তরুণ ও ঝুঁকে পড়ছেন এ আত্মবিধ্বংসী অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এটি যেকোনো মূল্যে ঠেকানো না গেলে তরুণ প্রজন্মের বিপথগামী হয়ে সংশোধন অযোগ্য অন্ধকার জীবনের পথে পা বাড়ানোর সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, বিটিআরসি সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার এখনই। এই টাস্কফোর্সের নিয়মিত তদারকির আওতায় থাকবে বিভিন্ন সামাজিক সম্প্রচার মাধ্যম, টেলিভিশন, ওয়েবসাইট।

টেলিযোগাযোগ বিভাগ, জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টার, কম্পিউটার কাউন্সিলসহ তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত সব বিভাগের কাজের সমন্বয় এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজন জুয়া বন্ধে বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন। প্রতিরোধী ব্যবস্থা হিসেবে প্রয়োজন শিক্ষা কার্যক্রমে এ বিষয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা সম্পর্কিত অধ্যায় সংযোজন। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বিশেষ করে ধর্মীয় স্থাপনাসমূহে এ ব্যাপারে আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম।
জুয়া সব দেশে সব সময় ছিল। সমাজ আগে এটিকে ঘৃণার চোখে দেখলেও ইদানীং এ ব্যাপারে একটি গা সওয়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এর ফাঁক গলে সমাজে বিস্তার লাভ করছে জুয়া নামের সামাজিক ব্যাধি। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু করা দরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা; বিশেষ করে সাইবার ক্রাইম বিভাগের কার্যকরী তৎপরতা এ ব্যাপারে সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে। সবচেয়ে জরুরি এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা। অভিভাবকরা তৎপর হলে এ প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে তাতে সন্দেহ নেই।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয় ঢাবি ক্যাম্পাসে রাজনীতি চর্চার প্রকৃতি ও ধরনবিষয়ক বিশেষ কমিটির কার্যক্রম শুরু তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিআরজেএ-এর দোয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার কাউকে রেহাই দেয়নি : রিজভী রাজাপুরে শাহজাহান ওমরকে প্রধান করে ২০৩ জনের নামে মামলা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র পেতে চাইলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবে যেকোনো পরিস্থিতিতে জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে চাই দেশের সব সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ বাড়াতে চাই : পার্বত্য উপদেষ্টা মাসিক ফুলকুঁড়ির ৪০০তম সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না : শিবির সেক্রেটারি

সকল