২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পেজেশকিয়ানের পথচলা সহজ নয়

মাসুদ পেজেশকিয়ান - ছবি : সংগৃহীত

ইরানের সংস্কার ফ্রন্টের সদস্যরা মাসুদ পেজেশকিয়ানকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাঈদ জালিলির থেকে মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। কট্টরপন্থীরা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধকে অন্য সব কিছুর ওপরে অগ্রাধিকার দেন। অবাক করা বিষয় হলো, প্রতিদ্বন্দ্বী চারজনের মধ্যে তিনজন ছিলেন কট্টরপন্থী। এর মধ্যে দু’জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও তারা সাঈদ জালিলিকে সমর্থন দেননি। ফলে সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ও আইআরজিসির পছন্দের প্রার্থী জালিলি নির্বাচিত হতে পারেননি। তবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ তার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, পেজেশকিয়ান কি সত্যিকার অর্থে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবেন?

সংস্কারপন্থী সমর্থনকারীরা বর্তমান প্রেসিডেন্টকে ঘিরে অনেক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এমন বিষয়ে তারা সোচ্চার যার বেশির ভাগ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিমূলে প্রোথিত। প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানকে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে যা মোটেও সহজ নয়। যেমন- মানবাধিকার, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সংস্কার ও অর্থনীতি।

সংস্কারবাদী সাধারণরা পেজেশকিয়ানকে নারী অধিকারের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছেন। নারীদের ওপর সিস্টেমের কড়াকড়ির সমালোচনা করছেন এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বৈদেশিক নীতির পরিবর্তনসহ আরো ভালো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষ সমর্থন করেছেন। তারা তাকে আইআরজিসিবিরোধী রাজনীতিবিদ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছেন। পেজেশকিয়ানের সংসদীয় ক্যারিয়ার ২০০৮ সালে শুরু হয়েছিল এবং আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে। সংস্কারবাদীরা আজ তাকে যেভাবে চিত্রায়ন করছেন বাস্তবতা অবশ্য তার থেকে ভিন্ন।

পেজেশকিয়ান খামেনির নীতির সমর্থক : সংস্কারবাদীদের বর্তমান সমর্থন থেকে উপকৃত হওয়া সত্ত্বেও, পেজেশকিয়ান ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির নীতিগুলোকে তার পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পেজেশকিয়ানকে সমর্থন করে এক নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠানে জাওয়াদ জারিফ বলেছিলেন, সব নিপীড়নমূলক আইন, ইন্টারনেট ও নূর প্ল্যান বিধিনিষেধ ইত্যাদির পেছনের স্থপতি ‘রক্ষণশীলরা’। নূর হিজাব প্ল্যান নীতির ফলে ইরানের শত শত নারীকে হেনস্তা হতে হয়েছে।

আইআরজিসি : ২০১৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আইআরজিসিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন পেজেশকিয়ান ও তার পার্লামেন্টের সদস্যরা ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তেজনা বাড়াতে চাপ দেন। তারা ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কোরের অবস্থান শক্তিশালীকরণ’ শিরোনামে আইন প্রবর্তন করেন। পেজেশকিয়ান এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আইআরজিসি না থাকলে এই দেশটি বিভক্ত হয়ে যেত এবং আমাদের কাজ শেষ হয়ে যেত।’ বর্তমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্কের সময়ও তিনি খোলাখুলিভাবে আইআরজিসির জন্য নিঃশর্ত এবং সমালোচনাহীন সমর্থন প্রকাশ করেন এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনকে ‘গর্বের উৎস’ হিসেবে বর্ণনা করেন। জাওয়াদ জারিফ আইআরজিসির কুদস ফোর্সের কমান্ডার সোলেইমানিকে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনসহ (জেসিপিওএ) কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন।

পররাষ্ট্রনীতি : তৃতীয় যে ক্ষেত্রটি ইরানের বর্তমান অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সঙ্কটের মূলে রয়েছে তা হলো ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও পশ্চিমা দেশগুলো এবং বিশেষ করে তাদের মিত্র ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, সংসদে তার মেয়াদকালে পেজেশকিয়ান ও আরো ৩৯ জন সদস্য একটি বিল প্রস্তাব করেছিলেন, যা আইনে পরিণত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘ফিলিস্তিনকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান বাধ্যতামূলক’। এ পরিকল্পনায় ইরান সরকারকে ইসরাইল সমর্থনকারী দেশগুলোর সাথে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন করার দাবি ওঠে এবং বড় গ্রুপের সাথে সংঘর্ষকে উৎসাহিত করে। এটি ইরানে ইসরাইলি পণ্য প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় টেলিভিশনে রাজনৈতিক বিতর্কের সময় পেজেশকিয়ান বারবার অন্যান্য দেশের সাথে সুসম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই বিশ্বের সাথে সম্পর্ক থাকতে হবে এবং ইসরাইল ছাড়া সব জাতির সাথে দৃঢ় সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।’

বাহাই ধর্মাবলম্বীদের সাথে আচরণ : বর্তমান ইরানের সংবিধান কেবল চারটি ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়- ইসলাম, খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদি ধর্ম ও জরাথুস্ট্রবাদ; ফলে বাহাই বিশ্বাসকে বাদ দেয়া হয়েছে। ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো বলছে, বাহাই ধর্মের অনুসারীরা ব্যাপক বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এক যৌথ বিবৃতিতে ইইউ পার্লামেন্টের সদস্য ও ইউরোপজুড়ে সিনেটররা বাহাই নারীদের ওপর নিপীড়ন বৃদ্ধিতে হতাশা প্রকাশ করেন।

ইরানের বিস্তৃত প্রক্সি নেটওয়ার্ক : মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের বিস্তৃত প্রক্সি নেটওয়ার্ক রয়েছে, যেটির মাধ্যমে ইরান নিজ দেশের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও আঞ্চলিক গতিশীলতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয়ভাবে কাজ করে। আন্তর্জাতিক ও ভূকৌশলগত কারণে প্রক্সিগুলোর প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর ব্যয়ভারও বিশাল। আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেও ইরানকে এই বিশাল ব্যয়ভার বহন করতে হয়।

যেমন- লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া এবং রাজনৈতিক আন্দোলন হিজবুল্লাহকে ২০২০ সালে ৭০০ মিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছিল। এটি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অনুমান। হিজবুল্লাহ এমন একটি মাঝারি আকারের বাহিনী, যেটি সুসংহত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বেশির ভাগ আরব সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদসহ ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোকে বার্ষিক ১০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হয়। ইরান ২০১২ থেকে ২০২১ সালের ভেতর আসাদ সরকার এবং তার প্রক্সিগুলোর সমর্থনে ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে! সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় আসাদ সরকারের টিকে থাকার জন্য ইরানের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইরানের বিপ্লবী গার্ড ও অভিজাত কুদস বাহিনী কমপক্ষে ছয়টি দেশে মিলিশিয়া ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা দেয় বলে জানা যায়। ইরানের প্রক্সিগুলো আঞ্চলিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রিন্স রেজা পাহলভি : তিনি মরহুম রেজা শাহ পাহলভির ছেলে, বিদেশে অবস্থান করছেন। ইরানে কোনো গোলযোগ দেখা দিলে তিনি মিডিয়ায় আসেন। এবারো এসেছেন। ইরানে রেজা শাহ পাহলভির রাজতন্ত্র ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে প্রিন্সের স্বপ্ন দেখতে সমস্যা নেই। তার গাত্রোত্থান পেজেশকিয়ানের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। কেননা এবার প্রিন্স বিরোধীদের সাথে মিশে সরকারবিরোধী ভূমিকায় নামছেন।

শয়তানের দল : ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী পোশাক বা শয়তানি পোশাক বিক্রির অভিযোগে তেহরান প্রদেশের ১৮টি দোকান বন্ধ করা হয়েছে এবং আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তরুণদের বিপথগামী করা এবং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উপায়ে প্রভাব বিস্তার করছে এই শয়তানি চক্র।

সেন্সরশিপ, স্যাটেলাইট চ্যানেল জ্যামিং ও মিডিয়া : ইরানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থাও তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যার ২০২৪ সালের চলতি প্রতিবেদনে ইরানি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন স্তরের সেন্সরশিপ এবং দমনের বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে। বিশেষত বিরোধী কণ্ঠস্বরকে লক্ষ্যবস্তু করে এই দমন নীতি চালানো হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
সংস্কারবাদীরা এখন ইরানিদের উদ্বেগের সমাধান করবে কি না সেটি বড় বিষয়।
ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ ও উত্তর-পশ্চিমের কুর্দিস্তান প্রদেশের দরিদ্র জাতিগত সংখ্যালঘুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করাও হবে বর্তমান প্রেসিডেন্টের জন্য দুরূহ একটি বিষয়। সেই সাথে খুজেস্তান প্রদেশে পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করাও আশু করণীয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement