০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
সুশাসন

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সহযোগিতায় গুরুত্ব

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সহযোগিতায় গুরুত্ব - ফাইল ছবি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৯ মে ২০২৪ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা অবধি প্রতিনিধিদলকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী আনোয়ারুল্লাহ তারার সাক্ষাৎ প্রদান করেন। তিনি পাকিস্তানের নবম প্রেসিডেন্ট রফিক তারারের দৌহিত্র। সাক্ষাৎকালীন আনোয়ারুল্লাহ তারার বাংলাদেশ-পাকিস্তান ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ হিসেবে সবধরনের সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা তুলে ধরে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, দু’দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতা উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক হবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে দলনেতা মন্ত্রীর ব্যস্ত সময় সত্ত্বেও তিনি প্রতিনিধিদলকে আন্তরিকভাবে সাক্ষাৎ দিয়ে মতবিনিময় করায় তাকে অভিনন্দন জানান।

দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ২টা অবধি প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেল হাম নিউজ পরিদর্শন করে। পরিদর্শনকালীন ব্যুরো চিফ জাভেদ সুমরু এবং ডাইরেক্টর নিউজ মোহাম্মদ রেহান আহমেদ সমভিব্যাহারে প্রতিনিধিদল চ্যানেলটির বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে। চ্যানেলটি থেকে উর্দু ও ইংরেজিতে সংবাদ পাঠ ছাড়াও বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়ে থাকে। প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে কিভাবে উভয় দেশের টিভি চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান আদান-প্রদানের মাধ্যমে একে অপরকে আরো গভীরভাবে জানার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষ প্রতিনিধিদলের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করে।

হাম নিউজ চ্যানেল থেকে প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদ হেরিটেজ মিউজিয়াম যা লোক ভিরসা নামে পরিচিত পরিদর্শন করে। হেরিটেজ মিউজিয়ামটি ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ। মিউজিয়ামটিতে পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। মিউজিয়ামটির বহিরাঙ্গনে পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রস্তুতকৃত কারুপণ্যের বিপণনের ব্যবস্থা রয়েছে। মিউজিয়ামে আগত দর্শনার্থীরা অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যে এখান থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর হস্তশিল্পজাত পণ্য ক্রয় করতে পারেন।

প্রতিনিধিদল রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ইসলামাবাদ ক্লাবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় আয়োজিত নৈশভোজে অংশগ্রহণ করে। ইসলামবাদ ক্লাবের সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, স্কোয়াশ কোর্ট, জিমনেশিয়াম ছাড়াও অতিরিক্ত আকর্ষণ হলো গলফ কোর্স। ক্লাবটির লাইব্রেরিতে বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ক হাজারো পুস্তকের সমারোহ রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের ডিজিটাল সংস্করণ পাঠকদের জন্য সহজলভ্য প্রবেশদ্বার উন্মোচন করেছে। ক্লাবটি সারা বছর বিভিন্নধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজনে ভরপুর থাকে। নৈশভোজে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রতিনিধিদলের ভ্রমণসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নৈশভোজটি অত্যন্ত আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। ভোজে অংশগ্রহণকালীন প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সাথে দেশটির কর্মকর্তাদের আলাপচারিতায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ বাড়াতে বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রসঙ্গ উঠে আসে।
ইসলামাবাদ ভ্রমণের তৃতীয় দিন ১০ মে ২০২৪ শুক্রবার হওয়ায় প্রতিনিধিদলের সদস্যদের জন্য বাদশাহ ফয়সাল মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করা হয়। মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী অপরূপ। এটি ইসলামাবাদের একটি প্রধান পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র। মসজিদটি পাকিস্তানের বৃহত্তম মসজিদ। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। মসজিদটি ইসলামাবাদের মারগাল্লা পাহাড়ের পাদদেশে ৩৩ একর ভূমির ওপর অবস্থিত। মসজিদটির অভ্যন্তর এবং বহিরাঙ্গনে একসাথে তিন লাখ লোক নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদটির চারটি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ৭৯ মিটার বা ২৩০ ফুট। মসজিদটি নির্মাণের সমুদয় ব্যয়ভার বাদশাহ ফয়সালের নির্দেশে সৌদি সরকার বহন করে। এ কারণে বাদশাহ ফয়সালের নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।

জুমার নামাজ আদায় শেষে প্রতিনিধিদল পাকিস্তান ইলেকট্রনিক মিডিয়া রেগুলেটরি অথরিটির কার্যালয় (পিইএমআরএ) পরিদর্শন করে। প্রতিনিধিদলকে পিইএমআরএ’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেমসহ অপরাপর কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বিষয়ে অবহিত করেন। পিইএমআরএ ১ মার্চ ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের বেসরকারি ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদলের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। প্রতিনিধিদলের সাথে পিইএমআরএ’র কর্মকর্তাদের মতবিনিময়কালে উভয় দেশের বেসরকারি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত প্রতিনিধিদল সেন্টোরাস মল নামক ইসলামাবাদের আধুনিক বিপণি কেন্দ্র পরিদর্শনে যায়। মলটিতে পাকিস্তানের প্রথিতযশা ব্র্যান্ডের পোশাক, জুতা ও প্রসাধনীর বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিদিন এটিতে বিপুলসংখ্যক ক্রেতার সমাগম ঘটে। মলটির অভ্যন্তরের দোকানগুলো সুবিস্তৃত ও পরিচ্ছন্ন। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মলটি থেকে নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী পরিবারের জন্য পণ্যসামগ্রী ক্রয় করেন। পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সেলোয়ার-কামিজের বাংলাদেশে বিপুল চাহিদা রয়েছে; তবে ক্রয়কালীন তুলনামূলক বিচারে দেখা যায় সেখানে পণ্যের মূল্য আমাদের দেশের তুলনায় সাশ্রয়ী।

প্রতিনিধিদল রাতে পিটিভির (পাকিস্তান টেলিভিশন) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আয়োজিত নৈশভোজে যোগদান করে। নৈশভোজে পিটিভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্প্রচার বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নৈশভোজে পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করা হয়।

পরের দিন অর্থাৎ ইসলামাবাদে অবস্থানের শেষ দিন ১১ মে ২০২৪ প্রতিনিধিদল মিনিবাসে মাউন্টেন রিসোর্ট সিটি মারি ভ্রমণে যায়। মারি পীর পাঞ্জাল রেঞ্জের গালিয়াত অঞ্চলে অবস্থিত। মারি ইসলামাবাদের ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মারি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ৫১৬ ফুট উচ্চতায় স্থিত। ব্রিটিশরা তাদের শাসনামলে পাঞ্জাবের সমতল ভূমির গ্রীষ্মকালীন ত্বক ঝলসানো তাপ থেকে রক্ষায় শহরটি প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ রাজকর্মচারীদের কাছে মারি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ছিল। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর মারি ব্রিটিশ শাসনামলের মতো পাকিস্তানের নাগরিকদের কাছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। প্রতি বছর ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিসহ পুরো পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক পর্যটক মারি ভ্রমণে আসেন। ইসলামাবাদ বা রাওয়ালপিন্ডি থেকে কোনো পর্যটক অ্যাবোটাবাদ, আজাদ কাশ্মির বা গিলগিট বালটিস্তান ভ্রমণ করতে চাইলে মারি ট্রানজিট রোড হিসেবে বিবেচিত হয়। মারিতে বহিঃসম্প্রচার বিভাগের পক্ষ থেকে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। মারি ভ্রমণ শেষে প্রতিনিধিদল সন্ধ্যায় ইসলামাবাদ প্রত্যাবর্তন করে।

ইসলামাবাদ শহরটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। এই শহরটির সড়কগুলো প্রশস্ত এবং শহরের সর্বত্র ইলেকট্রনিক সিগন্যাল সিস্টেম কার্যকর। শহরটির কোথাও ট্রাফিক পুলিশকে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের মতো হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে তৎপর থাকতে দেখা যায়নি। শহরটিতে বসবাসরত জনমানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে শহরের এক স্থান থেকে অপর স্থানে অতি সহজে যাতায়াত করতে পারে। শহরটিতে বসবাসরত সরকারি কর্মকর্তা, বিদেশী দূত ও বেসরকারি নাগরিকদের আবাসন ব্যবস্থা বেশ পরিকল্পিত। শহরের কোথাও সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম দিবা-ভাগে সম্পন্ন হওয়া প্রত্যক্ষ করা যায়নি।

রাতে প্রতিনিধিদলের সম্মানে পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আওরঙ্গজেব হারালের বাসভবনে নৈশভোজের ব্যবস্থা করা হয়। হারাল বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে সুদীর্ঘ চার বছর কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালীন তিনি বাংলাদেশের মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হারালের আগে মিস আম্বরিন জান ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে পাঁচ বছরকাল দায়িত্বরত ছিলেন। প্রতিনিধিদলের ইসলামাবাদ ভ্রমণকালীন প্রায় প্রতিটি কর্মসূচিতে আম্বরিন জান উপস্থিত ছিলেন। তা ছাড়া প্রতিনিধিদলের প্রতিটি কর্মসূচিতে সার্বক্ষণিক জাহিদুল্লাহ এবং মিস আমিনা ইকবাল ও মিস ইকরা উপস্থিত থেকে সফরকে উপভোগ্য করার ব্যাপারে সর্বতোভাবে সহায়তা করেন। প্রতিনিধিদল মধ্যরাতে হোটেল রামাদা ত্যাগ করে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে এবং ইসলামাবাদ বিমানবন্দর থেকে প্রত্যুষে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে দুবাই হয়ে ১২ মে ২০২৪ রাত ৯টায় ঢাকায় অবতরণ করে।

সামগ্রিক সফরের বিবরণী প্রতিবেদন আকারে বিবৃত হলেও মূলত নিবন্ধটি দু’টি দেশের জনমানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে অতীতের ভুল বোঝাবুঝির অবসানে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করে কিভাবে পারস্পরিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে এর একটি প্রয়াস। বাংলাদেশের আট সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন- ১. মোকাররম হোসেন, সম্পাদক, ডেইলি নিউ নেশন; ২. ইকতেদার আহমেদ, সাবেক জজ, লেখক ও কলামিস্ট; ৩. রিয়াজ আহমেদ, এক্সিকিউটিভ এডিটর, ঢাকা ট্রিবিউন; ৪. এ এস এম মঈনুল হক, সিনিয়র রিপোর্টার, নিউএইজ; ৫. মো: কামরুজ্জামান, বাংলাদেশ রিপোর্টার, টিআরটিওয়ার্ল্ড (টার্কিশ রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন); ৬. মো: আব্দুল ওয়াদুদ, সিনিয়র সাব-এডিটর, দৈনিক ইনকিলাব; ৭. জীবন আহমেদ সরকার, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, এনটিভি ও ৮. শেখ সাজিদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শেয়ারবিজ এবং বিজনেস ইনসাইডার। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক জজ, লেখক ও কলামিস্ট ইকতেদার আহমেদ। (সমাপ্ত)

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement