২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আইসিসির অসহায়ত্ব

আইসিসির অসহায়ত্ব - ফাইল ছবি

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আইসিসি প্রথম এবং একমাত্র স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত যা আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য ব্যক্তিবর্গের বিচার করার এখতিয়ার রাখে। গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, আগ্রাসনের অপরাধ সম্পর্কিত মামলায় আইসিসি স্বাধীনভাবে ন্যায়বিচারের কাজ করে। এটি জাতিসঙ্ঘের একটি অঙ্গ যা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ শুনানিও করে। এটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের একটি বড় পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের উদ্ভাবনী শক্তি হিসেবে বিবেচিত। আইসিসি আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তার এখতিয়ার, পক্ষপাত এবং কার্যকারিতার বিষয়ে অনেক সমালোচনারও মুখোমুখি হয়েছে। তারপরও মানবাধিকার এবং মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি করার, বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আইসিসি বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল মামলায় জড়িত গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সুদানের দারফুরের মুহাম্মদ আলী আবদুর রহমান। তার বিরুদ্ধে ছিল ২০০৩ সালের আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে দারফুরে সঙ্ঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ৩১টি অভিযোগ। ট্রায়ালটি ২০২২ সালের এপ্রিলে শুরু হয়ে বর্তমানে চলছে। আদালত তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ বহাল রেখেছেন। সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর হাসান আহমেদ আল বশির, এখনো পলাতক রয়েছেন। ২০০৯ ও ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে দু’টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আইসিসি কোর্টরুমে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির বিচার করে না। আরো রয়েছেন মালির আল হাসান মোহাম্মদ আল মাহমুদ। তার বিরুদ্ধে রয়েছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। আল হাসান আইসিসির হেফাজতে রয়েছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে মামলা হয় এবং বিচার চলছে। গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের থমাস লুবাঙ্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ, একচেটিয়াভাবে শিশুদের সৈনিক বানানো। লুবাঙ্গাকে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের সশস্ত্র দলে বাধ্যতামূলক নিয়োগ এবং তালিকাভুক্ত করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এসব ন্যায়বিচার, জবাবদিহি এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে মানবাধিকার ও মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন মোকাবেলার প্রতি আইসিসির প্রতিশ্রুতির নিদর্শন বলা যায়।

আইসিসিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করা আইনজীবী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো আত্মবিশ্বাসী যে তাদের আবেদনে যথেষ্ট ‘মেটেরিয়াল’ রয়েছে। গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধে ইসরাইলের সঙ্ঘটিত গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছয় শতাধিক আইনজীবী ও অধিকার গোষ্ঠী আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খানের কাছে তাদের মামলা উপস্থাপন করেন। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে, (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা মামলা দায়ের করেছে তার পরিপূরক হবে, যেখানে বিচারকরা ২৬ জানুয়ারি ছয়টি অস্থায়ী ব্যবস্থাসহ একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন রায় জারি করেছিলেন, ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যা রোধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যার মধ্যে স্থলভাগে তার বাহিনী এবং মানবিক সহায়তার উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারের উল্লেখ রয়েছে। আইসিজে, যা ওয়ার্ল্ড কোর্ট নামেও পরিচিত, জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ আদালত যা দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে। আর আইসিসি চারটি অপরাধের জন্য ব্যক্তিদের তদন্ত ও বিচার করে : সেগুলো- গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং আগ্রাসনের অপরাধ। ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই চারটি অপরাধ বিদ্যমান।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ এবং ব্রাসেলসভিত্তিক অ্যালায়েন্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড ডিগনিটি ইন্টারন্যাশনালের জ্যেষ্ঠ সদস্য আবদেল মাজিদ ম্রারি বলেন, আইসিসির কাছে জমা দেয়া মামলাটি ‘আইনত শক্তিশালী এবং যথাযথভাবে প্রস্তুত’। তিনি বলেন, প্রমাণের সব উপাদান-টেক্সট ডকুমেন্ট, ছবি এবং ভিডিও- প্রমাণ দেয় যে, গাজায় গণহত্যার অপরাধ সঙ্ঘটিত হয়েছে। ম্রারি আরো বলেন, এই উপস্থাপনের মাধ্যমে আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে রয়েছি যা ফিলিস্তিন সম্পর্কিত মামলায় আইসিসিতে আগে কখনো দেখা যায়নি। প্রমাণগুলো ১৫টি পৃথক অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে, যার প্রত্যেকটির নিজস্ব শিরোনাম এবং বিশেষ ফোকাস রয়েছে, যেমন বেসামরিক ক্ষতিগ্রস্ত, স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোতে হামলা, অবকাঠামোতে হামলা, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, অনাহারে রাখা, ফিলিস্তিনি বন্দীদের প্রতি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নগ্ন ও অপমানজনক উপায়ে আচরণ ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

দক্ষিণ আফ্রিকার গণহত্যা মামলায় আইসিজের রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলা হয়। এর ফলে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি ঐতিহাসিক এ জন্য যে, আদালত ছয়টি আদেশ জারি করেছিল এবং বিচারকরা প্রায় সর্বসম্মত ছিলেন, এমনকি ইসরাইলের প্রতিনিধিত্বকারী বিচারকও ছয়টি সিদ্ধান্তের মধ্যে দু’টির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আদেশগুলো শক্তিশালী ছিল, ইসরাইলকে কোনো ছাড় দেয়নি। যুদ্ধবিরতির সরাসরি আদেশ না দেয়ার কারণ হলো, ‘যুদ্ধরত পক্ষগুলোর সবাই আদালতের সদস্য নয় এবং তাদের সবাই গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী নয়।’ রায়ের প্রতিপাদ্য হলো- ইসরাইলি দখলদারিত্বের নিন্দা। আদালত তার রায়ে ইসরাইলের বৈধ আত্মরক্ষার অধিকার বা সন্ত্রাসবাদ শব্দটি উল্লেখ করেনি। ২০০৪ সালে বিচ্ছেদ প্রাচীর নিয়ে একটি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে রায় দিয়েছিল আদালত। আদালত তখন বলেছিল, ইসরাইলের জাতিসঙ্ঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করার কোনো অধিকার নেই, কারণ ইসরাইল দখলদার; আর দখলদারের আত্মরক্ষার অধিকার দাবি করার কোনো অধিকার নেই।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির করিম খানের গ্রেফতারি পরোয়ানা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বলা যায়, বিশ্বমঞ্চে কয়েক দশকের ইসরাইলি ব্যতিক্রমবাদ এবং দায়মুক্তির অবসানের সঙ্কেত। ইসরাইলের শক্তিশালী পশ্চিমা মিত্ররা তেলআবিবকে অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো একই আইনি ও রাজনৈতিক মানদণ্ডে ধরে রাখার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেটিকে যেন অক্ষম করে দিয়েছে এই রায়। ইসরাইলি ব্যতিক্রমবাদ জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের সৌভাগ্য নাগালের বাইরে, সেটিই বিশ্ব দেখছে। ২০২১ সালে আইসিসির প্রসিকিউটর হিসেবে শপথ নেয়ার সময় করিম খান উত্তরাধিকার সূত্রে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি নিয়ে একটি উন্মুক্ত তদন্ত পেয়েছিলেন। করিম খান ফিলিস্তিনের বিষয়ে চুপ ছিলেন।
আমরা দেখেছি, অক্টোবরে ইসরাইল যখন গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, করিম খান এবং তার দল পূর্ব জেরুসালেম এবং গাজা উপত্যকাসহ অধিকৃত পশ্চিম তীরে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করছিল। তবুও, খান ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ঘটে যাওয়া অপরাধের ক্ষেত্রে একতরফাভাবে তার প্রচেষ্টার ফোকাসকে সঙ্কীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

জাতিসঙ্ঘের বেশ কয়েকটি সংস্থা এবং জাতিসঙ্ঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশন বসতি, বর্ণবাদ, নির্যাতন, জোরপূর্বক স্থানান্তর অপরাধ পুঙ্খানুপুঙ্খ নথিভুক্ত ও তদন্ত করেছে এবং করিম খানকে ফৌজদারি মামলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ সরবরাহ করেছে। গাজায় গণহত্যার বিষয়টিও তার আওতাবহির্ভূত ছিল না। তিনি আইসিসির প্রসিকিউটর আইসিসির সাবেক বিচারক ও যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক সভাপতিসহ বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেলের পরামর্শ নেন, যিনি ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও পরামর্শ দিতেন।

আইসিসি কি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন আদালত? আদর্শগতভাবে, আইসিসি কর্মীদের অবশ্যই স্বাধীনভাবে এবং কোনো পক্ষের চাপ বা ভয়ভীতি ছাড়াই কাজ করা উচিত। তিনি জানেন, ২০২০ সালে তার পূর্বসূরি ও অন্য কর্মীদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা কী বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে।

যুদ্ধাপরাধের তদন্ত বন্ধ করতে আইসিসির প্রসিকিউটরকে হুমকি দিয়েছিলেন মোসাদের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ইয়োসি কোহেন। মিসেস ফাতি বেনসুদাকেও ফিলিস্তিনে যুদ্ধপরাধ তদন্তে কোহেন হুমকি দিয়েছেন ও অতর্কিত হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বেনসুদা ২০২১ সালে আইসিসিতে তার ৯ বছরের মেয়াদ শেষ করে, খানকে তদন্তের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন।

গাজা গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্ট, প্রতিরক্ষা বাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভির বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে আইসিসির তদন্তের নিন্দা জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আইসিজে ইসরাইলে জার্মানির অস্ত্র বিক্রির ওপর রায় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

১৯১৭ সালের কুখ্যাত বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যে একটি হাইব্রিড সত্তা তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রায় ১০০ বছর আগে, ১৮১৮ সালে মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ সালে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর, শয়তান দানব তৈরি করতে সহায়তা করেছিল ব্রিটেন। সেটি ইসরাইলি রাষ্ট্র। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব কারো ক্ষতি না করে শুরু করলেও ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ, হত্যা, নিপীড়ন ও সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে জাতিগত নিধনের ওপর।

ইসরাইল কখনো সভ্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করেনি। এটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একের পর এক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ফিলিস্তিনের যে অংশটি এখন ইসরাইল নামে পরিচিত, সেখানকার নাগরিকত্ব অর্জনকারী ফিলিস্তিনিরাও রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী মতাদর্শ থেকে রেহাই পায়নি। তারা ৬৫টিরও বেশি ইসরাইলি আইনের অধীনে আনুষ্ঠানিক বৈষম্যের মুখোমুখি যা কার্যকরভাবে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছে। তাহলে এক রাষ্ট্রে কিভাবে মুসলমানরা বসবাস করবে?

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement