হজ : কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ০১ জুলাই ২০২৪, ০৭:২৮, আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ১৩:২৭
![](https://www.dailynayadiganta.com/resources/img/article/202407/846293_164.jpg)
ইবরাহিম আ:-এর প্রতি মহান আল্লাহর নির্দেশ ‘লোকদের হজ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহ্বান জানাও- তারা যেন এখানে আসে পায়ে হেঁটে, উঠের পিঠে, কাছ থেকে-দূর থেকে’- তারই প্রতিফলন হজ। প্রতি বছর পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিশ্বাসী মানুষ হাজির হন পবিত্র নগরী মক্কায়- এই আহ্বানের প্রত্যুত্তরে। মূলত হজের এই আহ্বানের অনুরণন ও অনুসরণের প্রতিফলন সাড়ে চার হাজার বছর ধরে চলমান। যারা বিত্তশালী, মক্কা পর্যন্ত যাওয়া-আসার খরচ বহনে সামর্থ্য রাখেন, তাদের ওপর হজ অত্যাবশ্যকীয়। জিলহজ মাসের ৯ তারিখে মুসলিম জনগোষ্ঠী ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির) ধ্বনিতে একই পোশাকে হাজির হন আরাফাতের ময়দানে। এর আগে তাদের পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করতে হয় এবং মিনায় রাত্রি যাপন করতে হয়।
হজের সামগ্রিক আনুষ্ঠানিকতার অন্তর্নিহিত মর্মার্থ্য হচ্ছে- পৃথিবী ও সংসারের সমস্তÍ আকর্ষণমুক্ত হয়ে মহান স্রষ্টার কাছে নিজেকে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করা যা ইবরাহিম আ: করতে পেরেছিলেন। অসংখ্য নবী ও রাসূল এভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন আল্লাহর কাছে। তাদের এই আত্মসমর্পণ তাদের বিশ্বাসের গভীরতার দৃঢ়তার সাথে সাথে উৎসাহ জুগিয়েছিল, শক্তি সঞ্চার করেছিল সত্যের বাণী প্রচার করার। জুলুমের প্রতিবাদ করার, অন্যায়কে রুখে দাঁড়ানোর। এ অসত্য-অন্যায়-জুলুম ছিল ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। তারা নিজেদের প্রাণনাশের ভয়ে ভীত হননি, পিছিয়ে আসেননি; বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে-দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদী ছিলেন।
এই চেতনায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতে না পারলে হজের পুরো আয়োজন কেবল আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই পালিত হবে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, হজের সমগ্র চারণভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে কঠিন পরীক্ষা, কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও ধৈর্যের পরাকাষ্ঠার পুণ্যময় স্মৃতি। কাবাঘর, হাজরে আসওয়াদ, জমজম কূপের সাথে সৃষ্টিকর্তার সংশ্লিষ্টতা অনুভূত হওয়ার সাথে সাথে আপনাআপনি সৃষ্টিকর্তার মুখোমুখি হওয়ার অনুভূতি যেমন একদিকে হাজী সাহেবানদের আলোড়িত করে; তেমনি কাবাঘর নির্মাণে ইবরাহিম আ: ও ইসমাইল আ:-এর স্মৃতি যেন বাস্তবতা লাভ করে। বাঙময় হয়ে ওঠে সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সায়ি করার মধ্যে বিবি হাজেরার আর্তনাদ এক ফোঁটা পানির জন্য। বিবি হাজেরার এই আর্তনাদ যেন কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত স্নেহশীলা মায়েদের আর্তনাদ। কাবা প্রাঙ্গণে মোহাম্মদ সা:-এর ওপর অত্যাচারের দৃশ্যগুলো যেন অনুভবে আসে। প্রতিধ্বনিত হয় হজরত বেলালের কণ্ঠের আজানের ধ্বনি। হজ পরিক্রমায় এই স্মৃতিময়তা-হাজীদেরকে যেন উদ্বুদ্ধ করে, উজ্জীবিত করে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে- এ জন্যই কাবাকেন্দ্রিক হজের আয়োজন। হেরাগুহা যেন নিজেকে আবিষ্কারের আরেক বিস্ময়। দেড় হাজার বছর আগে লোকালয় থেকে দূরে পাহাড়ের শীর্ষে হেরাগুহার নির্জন একাকিত্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের যে প্রাণান্তকর চেষ্টা তাও সামনে আসে। মক্কা নগরীর প্রথম সারির বিত্তশালীদের একজন হওয়া সত্ত্বেও হজরত খাদিজা তার প্রতি সহমর্মী হয়ে থেকেছেন।
মিনায় হজরত ইসমাইল আ:-কে কোরবানি করার দৃশ্যকল্প মনে পড়লেই শিহরিত না হয়ে পারা যায় না। অহঙ্কারী বাদশাহ আবরাহার করুণ পরিণতি এবং মহান সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতার প্রকাশ এখনো মিনা প্রান্তরে দৃশ্যমান। আরাফাতের প্রান্তর শুধু বিদায় হজের পুণ্যভূমিই নয়; নয় শুধু বিদায় হজের ভাষণ; বরং এর সাথে জড়িত বহু নবী-রাসূলের স্মৃতি। এ ছাড়াও ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনার নীরব সাক্ষী হজ আনুষ্ঠানিকতার স্থানগুলো। হাজী সাহেবানদের হৃদয়ে যেন চেতনায় শাণিত হয় এবং এই চেতনায় যাপিত হয় হজ-পরবর্তী জীবন। একজন হাজী এসব অনুভূতিতে শাণিত হয়ে যখন আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন, তখনই তার হজ সার্থকতা লাভ করে, পূর্ণতা পায়।
মিনায় প্রতীকী শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারা যে নিজের অভ্যন্তরীণ রিপুকে প্রতিরোধের প্রয়াস ও প্রকাশ তা কতজন ভেবে দেখেছেন? মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের প্রান্তর যে মহামিলনের শিক্ষা দেয় তা অনুধাবন না করে সামান্য বৈষয়িক ব্যাপার নিয়ে পরস্পরের সাথে বিবাদে লিপ্ত হওয়া বা হাতাহাতি করা হজের চেতনার সাথে কতটুকু মানানসই তা অনেক সময় হাজী সাহেব বুঝতে পারেন না। এ ব্যাপারে হজ এজেন্সিগুলো পূর্বাহ্ণে হাজী সাহেবদেরকে ঠিকমতো সতর্ক করে না। হজ-পরবর্তী সময়ে হাজী সাহেবদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে হজের প্রতিফলন না ঘটার পেছনে এটি একটি প্রধান কারণ। অনেকের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় হজ যেন আনন্দ ভ্রমণ। ‘হজ ট্যুরিজম’- এ পরিণত করা হয়েছে ইসলামের এই অত্যাবশ্যকীয় (ফরজ) বিধানকে।
কাবাঘর তাওয়াফের সময় যখন একজন বিশ্বাসীর মনে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের কামনায় ব্যাকুল থাকার কথা, সমস্ত পার্থিব চিন্তাচেতনার ঊর্ধ্বে থাকার কথা, তখন দেখা যায় তাওয়াফের সময় অনেক হাজী ভিডিও করছেন, সেলফি তুলে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। এটি হজের চেতনার সাথে কতটুকু মানানসই? হজসংশ্লিষ্ট জায়গাগুলো দেখার সময় এর সাথে একাত্মতা বোধের পরিবর্তে ছবি তুলে, সেলফি তুলে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে পাঠানো শোভন নয়। অনেককে দেখা যায় কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এত কষ্টের অর্থ ও সময় ব্যয় করে পুণ্যভূমিতে এসে অনেকে কেনাকাটায় বেশি সময় ব্যয় করছেন। হজকে অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে হাজী সাহেবদের এ ব্যাপারে হজে যাওয়ার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন। হজ এজেন্সিগুলো এবং বিভিন্ন জায়গায় হজ প্রশিক্ষণের সময় এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। সৌদি সরকারের হজ মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে দায়িত্ব সর্বাধিক। বিভিন্ন দেশে দূতাবাসের মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারে তারা।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা