০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

কালো বিড়াল, হুলো বিড়াল, থলের বিড়াল

কালো বিড়াল, হুলো বিড়াল, থলের বিড়াল - নয়া দিগন্ত

কাজী আবুল কাসেমের অমর কবিতা টেলিফোনের কথামালা কানে বাজে না এমন লোক আমাদের সমাজে খুব কমই আছে। বিশেষ করে যাদের বয়স ৪০ পার হয়েছে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তাদের কাছে ক্রিং ক্রিং টেলিফোন, হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো! কে তুমি, কাকে চাই? বলো বলো বলো! আমি ম্যাও, হুলো ক্যাট। ইঁদুরকে চাই- জরুরি আলাপ আছে। তুমি কে হে ভাই? আমি ইঁদুর। তবে, কথা হলো এই আমি গেছি মার্কেটে- বাড়িতেই নেই! ক্রিং ক্রিং টেলিফোন- শোন হে ইঁদুর! শুনবো না শুনবো না দূর দূর দূর!! কবিতাটি জীবনের একটি উপসর্গে পরিণত হয়েছে।

২০২৪ সালের জুন মাসে এসে আমাদের দেশ কাল সমাজে যেভাবে ইঁদুর-বিড়াল খেলা শুরু হয়েছে তার সাথে কাজী আবুল কাসেমের টেলিফোন কবিতার কি মিল রয়েছে সে কথাই আলোচনা করব। তবে তার আগে শিরোনাম নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে নেই। কালো বিড়াল, হুলো বিড়াল ও থলের বিড়াল নিয়ে আবহমান বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে লাখো কোটি অলক্ষণে কাহিনী রয়েছে। কালো বিড়ালকে সাধারণত নেতিবাচক প্রাণী হিসেবে দেখা হয়। গ্রাম বাংলায় কালো বিড়াল দেখলে ছেলে-বুড়ো সবাই বারবার তাকায়। আর রাতের বেলা হলে তো কথাই নেই। সবচেয়ে সাহসী মানুষটি যদি গ্রামের পথে হাঁটতে গিয়ে রাতের আঁধারে দেখে, একটি কালো বিড়াল তার সামনে দিয়ে দৌড়ে পাটক্ষেত বা ধানক্ষেতে ঢুকল- ওমনি লোকটি থমকে দাঁড়াবে। তারপর ডান-বাম উপরে-নিচে তাকাবে এবং বুকে ফুঁ দিয়ে তারপর পথচলা শুরু করবে।

বাংলার রূপকথায় কালো বিড়ালের সাথে জিন-ভূত-শয়তানসহ নানা অশরীরী আত্মার যোগাযোগ নিয়ে শৈশবে এত্তসব গল্প শোনা হয় যা পরিণত বয়সের বড় বড় যুক্তিবাদী জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-নাস্তিকদেরও কিভাবে অমাবস্যার রাতে আতঙ্কে ফেলে দেয় তা অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে চমৎকারভাবে বর্ণনা করে গেছেন। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও বাংলার রাজনীতিতে কালো বিড়ালের জমকালো অভিষেক ঘটিয়েছিলেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তার সেই অসাধারণ কালো বিড়াল আজকের আওয়ামী সরকারের ডালপালা, লতা-পাতা ও শিকড়ে কিভাবে বাসা বেঁধেছে এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আমলাতন্ত্রে কিভাবে আছর করেছে তা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

কালো বিড়ালকে যদি আপনি রহস্যময় প্রাণী হিসেবে গণ্য করেন তবে হুলো বিড়ালকে বলতে পারেন বাঘের মামা বা বাঘের চাচা। এরা বিকট শব্দে ম্যাও ম্যাও করে, শিকার ধরার জন্য লম্ফঝম্প করে এবং সুযোগ পেলেই যাকে তাকে আঁচড় কাটে। এসব ছাড়াও হুলো বিড়ালের চুরি-ডাকাতির রেকর্ড- নির্লজ্জতা-বেহায়াপনা এবং অবাধ যৌনাচারের জন্য দানবীয় তাণ্ডবে লোকজন-ভীষণ রকম বিরক্ত বোধ করে। হুলো বিড়ালের বন্যতার কারণে এরা অবাধ্য বেয়াদব এবং বজ্জাত প্রকৃতির হয়।

হুলোর পরে এবার থলের বিড়াল নিয়ে কিছু বলা যাক। গৃহপালিত বিড়ালগুলোর মধ্যে যেগুলোর চুরি-ছেচ্ছরি এবং যেখানে সেখানে মলত্যাগ করাসহ পরিবারের নিরীহ গবাদি পাখি যথা- হাঁস-মুরগির সাথে মারামারি কাটাকাটি গৃহকর্তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে তখন সেগুলোকে বস্তাবন্দী করে দূর গ্রামে বা বহু দূরে ফসলের মাঠে ফেলে দেয়ার যে রেওয়াজ গ্রাম বাংলায় রয়েছে সেটিকেই থলের বিড়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়। যেসব বিড়ালকে থলের মধ্যে ঢোকানো হয় সেসব বিড়াল দৃশ্যত গৃহপালিত ও অনুগত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওদের চরিত্রে ভণ্ডামি-মোনাফেকি এবং চুরি চামারির অভ্যাস মনুষ্যসমাজের জন্য ভয়ঙ্কর এবং বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।

উল্লিখিত তিন প্রকারের বিড়ালের সাথে যদি চলমান সময়ের দেশ কাঁপানো দুর্নীতিবাজদের রসায়ন ঘটাতে চান তবে পদ-পদবি থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া মহা ধড়িবাজ-ফাঁপরবাজ-উদ্ধত-অহঙ্কারী-দুর্নীতিবাজদের গডফাদারদের আপনি কালো বিড়ালের সাথে তুলনা করতে পারেন। অন্যদিকে, দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের যে অংশটি এখনো বড় বড় পদ-পদবিতে থেকে শিকার ধরার নামে ক্রিং ক্রিং টেলিফোনের মাধ্যমে ইঁদুর ধরার নামে দুর্নীতির মহাকাশ তৈরিতে ব্যস্ত এবং যাদেরকে আপনি আমি চিনি জানি কিন্তু ভয়ে যাদের নামটি উচ্চারণ করতে পারি না- তাদেরকে হুলো বিড়ালের সাথে তুলনা করতে পারেন। আর থলের বিড়াল বলতে আপনি প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে দুর্নীতির রাজ্যে মধ্যম স্তরের প্রাণীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে ওদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা তদবির করতে পারেন।

শিরোনামে বর্ণিত তিন প্রকৃতির বিড়াল নিয়ে আমার আর তেমন কিছু বলার নেই। এবার কবি কাজী আবুল কাসেমের টেলিফোন কবিতার ভাবসম্প্রসারণ করে বর্তমান সমাজে সে ইঁদুর-বিড়াল খেলা শুরু হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করব। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিদিনই দুর্নীতি নিয়ে পিলে চমকানো সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের মধ্যে কেউ হয়তো রাজনীতির সাথে জড়িত, আবার কেউ বা আমলা। ব্যবসায়-বাণিজ্যের সাথেও অনেকে জড়িত। তবে এদের সবার একটি বিশেষ যোগ্যতা হলো, রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে তাদের নিদারুণ দহরম-মহরম। এ কারণে দুর্নীতিবাজদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। আর তা হলো, পুরো দেশটিই তাদের অথবা তাদের বাবা-দাদাদের। এ কারণে রাষ্ট্র-রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ওপর যেমন তাদের এক ধরনের মালিকানার দাবিনামা রয়েছে, তদ্রƒপ দেশের আমজনতাকে তারা মনেপ্রাণে ক্রীতদাস হিসেবে ধ্যানজ্ঞান করে।

দুর্নীতিবাজদের উল্লিখিত চিন্তা-চেতনার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত রসায়ন লক্ষ করা যায়। তাদের চালচলনে আফ্রিকার সিংহ অথবা সুন্দরবনের বাঘের হম্বিতম্বি লক্ষ করা যায়। ভয়, আতঙ্ক ও লজ্জা-শরম বলতে তাদের কিছুই থাকে না। চলাফেরা, পোশাক-আশাক, হাঁকডাকে বাঘ-সিংহের ভাবসাব দেখালেও চিন্তা ও মন-মানসিকতায় তারা শিরোনামে বর্ণিত তিন প্রকারের বিড়াল ছাড়া যে আর কিছুই নয় তা আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতিবাজদের নিয়ে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার মাধ্যমে বুঝতে পারছি। তাদের একটি অংশ কালো বিড়ালের ভূমিকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অপর অংশটি হুলো বিড়ালের মতো ঘড়ঘড় আওয়াজ করছে এবং বাকিদেরকে বস্তায় ভরে দূরদেশে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

পরিস্থিতি যখন উল্লিখিত অবস্থায় পৌঁছে গেছে, ঠিক তখন আমাদের দেশে গল্প কবিতা উপন্যাসের মতো চোর-পুলিশ খেলা অথবা ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতো একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে অথবা শুঁটকির হাটে বিড়াল চৌকিদারের মতো জনপ্রিয় প্রবাদগুলোর বাস্তবতা নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে তদ্রƒপ কাজী আবুল কাসেমের টেলিফোন কবিতার মতো হুলো বিড়াল ফোন করে ইঁদুর ধরার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ইঁদুর মশাইকে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে হুলো বিড়াল যেভাবে শিকার খোঁজার চেষ্টা করছে এবং হুলো বিড়ালের ফোন পেয়ে যেভাবে ইঁদুর শিশুতোষ বাক্যে বলার চেষ্টা করছে যে, আমি ইঁদুর কথা বলছি বটে তবে এই মুহূর্তে আমি বাড়িতে নেই- মার্কেটে গেছি।

কবি যখন টেলিফোন কবিতা রচনা করেছিলেন তখন মোবাইল টেলিফোন ইন্টারনেট কিংবা কথা বলার অন্যতম প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি। সুতরাং কেবল শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য তারযুক্ত সাধারণ ফোনকে কেন্দ্র করে ইঁদুর-বিড়ালের কথোপকথনকে তিনি যেভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন তা বর্তমান জমানার দুর্নীতিবাজদের স্যাটেলাইট ফোন নির্বিঘ্নে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এবং লন্ডন-আমেরিকার বিলাসবহুল বেগমপাড়ার অট্টালিকার নিজস্ব সুইমিংপুলে সাঁতাররত অবস্থায় তাদেরকে খোঁজকারীর সাথে কথোপকথন যদি কবি জানতেন তবে কী ধরনের কবিতা লিখতেন তা নিয়ে এই যুগের কবিরা চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement