বাদায়ুনীর ইতিহাস ও ধর্মদৃষ্টি
- মুসা আল হাফিজ
- ২৭ জুন ২০২৪, ০৬:০৫
ভারত উপমহাদেশে ইতিহাসকে ইতিহাস হিসেবে অধ্যয়নের পটভূমি যারা রচনা করেন, তাদের অন্যতম আবদুল কাদির বাদায়ুনী (১৫৪০-১৬১৫)। তার মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ মুসলিম ভারতের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসগ্রন্থ। রাজ দরবারের ঘনিষ্ঠ হয়েও রাজকীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতর সমালোচনার প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করে এই গ্রন্থ। প্রবল প্রতাপশালী সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজরোষের মোকাবেলা করে নিজের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাকে প্রমাণ করেছে এই বই। বহু শতাব্দীর সময়ঝড় বইয়ের একটি হরফকেও পারেনি মলিন করতে, মুছে ফেলতে।
গ্রন্থটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বয়ানের পাশাপাশি তখনকার ভারতের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, চিকিৎসক, কবি, দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের উপর অতিরিক্ত অধ্যায় যোজনা করে। রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সমাজের অন্তরালে কিভাবে বিবর্তিত হয়, তার উপর অন্তর্দৃষ্টির বিস্তার করেছে বইটি। বইটির ভূমিকা অত্যন্ত মূল্যবান। সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ধর্মীয় নীতির তুখোড় সমালোচনা আমরা পাই এতে। বাদায়ুনী নিজের অসঙ্কোচ মতামতের উপস্থাপনে কোনো ভয় বা আশঙ্কার কাছে বিচলিত হননি।
বাদায়ুনী ছিলেন বহুভাষাবিদ, অনুবাদক, আইনজ্ঞ, ইতিহাসবিদ ও হাদিস-বিশারদ। সঙ্গীত ও জ্যোতিষশাস্ত্রে তিনি ছিলেন প্রাজ্ঞজন। উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনের নিদ এলাকায় তার জন্ম হয় হিজরি ৯৪৮ মোতাবেক ১৫৪১-৪২ খ্রিষ্টাব্দে। তার পিতা মুলুক শাহ ছিলেন তখনকার প্রভাবশালী অমাত্য। বাসাভারে তিনি কৈশোর পার করেন। বদায়ুনের বিখ্যাত সন্ত বাচ্চুর কাছে তিনি শিখেন সংস্কৃত, বেদ, গিতা, উপনিষদ, পুরান, রামায়ণ ও মহাভারতের পাঠ। সম্ভল ও আগ্রায় সারেন মাধ্যমিক ও উচ্চতর পড়াশোনা। আবুল ফজল ফয়জির পিতা বহুবিদ্যাবিশারদ মোল্লা শেখ মোবারক নাগোরি ছিলেন তার অন্যতম শিক্ষক। মুসলিম রহস্যবাদী ও সুফিদের নিয়ে তার আগ্রহ ছিল বিস্তর। জীবনের বড় একটি অংশ এ বিষয়ক অধ্যয়ন ও সাধনায় কাটিয়ে দেন তিনি। ১৫৬২ সালে পাতিয়ালায় তিনি ৯ বছরের জন্য যুবরাজ হোসেন খানের চাকরিতে প্রবেশ করেন।
১৫৭৩-৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের সাথে তার পরিচয়। জামাল খান কুরচি এবং আইনে মুলুক সিরাজি রহ:-এর সুপারিশে বাদশাহ আকবরের দরবারে আসেন তিনি। কোনো এক বুধবার বাদশাহর নামাজের ইমামতি করেন তিনি। এ জন্য তার উপাধি দেয়া হয় ‘আকবর বাদশাহর ইমাম’। আকবর তার বিদ্যা ও প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হন। তাকে দরবারি পণ্ডিতদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। রাজদরবারের ধর্মীয় অফিসে ছিল তার দায়িত্ব।
ইতিহাসবিদ নিজামুদ্দিন আহমদ বক্সী (১৫৫১-১৬২১) ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাবাকাতে আকবরির লেখক হলেন বক্সী। সমকালে বাদায়ুনীর সর্বাধিক সম্মানিত কাজ ছিল কিতাবুল হাদিস (হাদিসের গ্রন্থ), বিশালাকার গ্রন্থটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার উদ্ধৃতি ও উল্লেখ রয়েছে বহু গ্রন্থে। হিজরি সনের এক হাজার বছর পূর্ণ হলে তিনি লিখেন তারিখে আলফি বা হাজার বছরের ইতিহাস। লেখকদের একটি পরিষদ এতে কাজ করেন। গ্রন্থটি এক অসামান্য কাজ হিসেবে বন্দিত হয়। মহান ইতিহাসবিদ রশিদ উদদীনের জামিউত তাওয়ারিখ (সর্বজনীন ইতিহাস) গ্রন্থটি একে অবলম্বন করে রচিত হয়। বাদায়ুনী অনেক সংস্কৃত কাহিনী এবং হিন্দু কাব্যকাহিনী অনুবাদ করেন।
ইতিহাসে বাদায়ুনীর সবচেয়ে বড় অবদান মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ, যাকে তারিখে বাদায়ুনীও বলা হয়। ১৫৯০ সালে বাদায়ুনী শুরু করেন মুন্তাখাব রচনা। সমাপ্ত হয় ১৫৯৫ এর অক্টোবরে। গ্রন্থটি রচনার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হন।
কাজটিতে তিনটি খণ্ড রয়েছে। প্রথম খণ্ড আমির নাসিরুদ্দিন সাবুক্তগিনের ক্ষমতাগ্রহণ (খ্রি. ৯৭৭) থেকে হুমায়ুনের মৃত্যু (২৪ জানুয়ারি ১৫৫৬) পর্যন্ত বিবরণী পেশ করে। গজনবি শাসক ও রাজাদের ইতিবৃত্ত দিয়ে শুরু হওয়া গ্রন্থটি ঘুরি রাজবংশ, মামলুক রাজবংশ (দিল্লি), বাবর এবং হুমায়ূন সম্পর্কিত বিবরণীর মধ্য দিয়ে দিল্লি সালতানাতের গোটা চিত্রপট এবং মোগল সালতানাতের প্রথম প্রহরকে খোলাসা করে।
দ্বিতীয় খণ্ড হাজির করে মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বের প্রথম ৪০ বছর, যা ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ থেকে অক্টোবর ১৫৯৫ পর্যন্ত ঘটনাচক্রে মুখরিত। আবদুল কাদির বাদায়ুনী আকবরের যুগের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এই খণ্ডটি আকবরের প্রশাসনিক পদক্ষেপের একটি খোলামেলা এবং সমালোচনামূলক বিবরণ। যেখানে একজন বুদ্ধিজীবী রাজদরবারে অবস্থান করে রাজকীয় আদেশে গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে নিন্দা করছেন রাজার কর্মকাণ্ডের। রাজার ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্মকাণ্ড, নৈতিকতা ইত্যাদিকে অনবরত প্রশ্ন করছেন, তার মন্দ দিকের উন্মোচন করছেন। সমালোচনা করছেন ধারালো তীব্রতায়। তবে আকবরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই খণ্ডটি গোপন রাখা হয়েছিল। প্রায় ১৬০৫ সালে খণ্ডটি যখন প্রকাশ পায়, আকবর-পুত্র জাহাঙ্গীর তখন ক্ষমতায়। তার রাজত্বের ১০টি বছর পার হয়েছে। বাদায়ুনীর এই ঝুঁকিগ্রহণ মুসলিম পণ্ডিতদের সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার জানান দেয়, যেখানে তারা শাসকের চোখে চোখ রেখে সত্য উচ্চারণের দায় পালনে মোটেও দ্বিধা করেননি।
বইটির তৃতীয় অংশে আছে সমকালীন কবি, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, সুফি, আলেম ও প্রাজ্ঞজনের জীবনীমূলক বিবরণ, যারা হয় বাদায়ুনীর পরিচিত ছিলেন নয় আকবরের দরবারে সংযুক্ত ছিলেন। এতে আমরা পাই ৩৮ জন সুফি-শাইখ, ৬৯ জন আলেম, ১৫ জন দার্শনিক, চিকিৎসক এবং ৬৭ জন কবির জীবন ও চিন্তার ইতিবৃত্ত।
বইটির সবগুলো খণ্ড যখন সামনে এলো, সমসাময়িক পাণ্ডিত্যে এর প্রভাব দেখা গেল। তখন সম্রাট আকবরের সমালোচনা মানে গুরুতর সমস্যাকে নিজের দিকে টেনে আনা। কিন্তু বাদায়ুনী সব দেয়াল ভেঙে দিলেন। বইটি সামনে আসার পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রচণ্ড অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। কিন্তু বইটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন না বাদায়ুনীর সন্তানরা। ১৬৬৭ সালে রচিত মিরআতুল আলমের লেখক শেখ মুহাম্মাদ বাক্কা সাহারানপুরির মতে, আবদুল কাদির বাদায়ুনীর সন্তানরা জাহাঙ্গীরকে বলেছিল যে, তারা এই কাজের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না। কিন্তু তাদের কৈফিয়তকে বিশ্বাস করতে পারেননি জাহাঙ্গীর।
এই গ্রন্থে আকবরের নতুন ধর্ম-সম্পর্কিত যে মতামত প্রতিফলিত, তা সমকালীন অন্য কোনো ইতিহাসগ্রন্থে নেই। বাদায়ুনী আকবরের ধর্মমত প্রতিষ্ঠার যে বিবরণ হাজির করেছেন, তাকে সেকালের ইতিহাসবিদরা কেন এড়িয়ে গেলেন, তা বিস্ময়চিহ্ন তৈরি করে। আকবরের প্রকৃত চিত্র আমরা জানতে পারি প্রধানত এই বইয়ের কল্যাণে। বইটির প্রচার খুব দ্রুত হয়নি।
মোল্লা আব্দুল বাকি নাহাওয়ান্দি ১৬১৬ সালে যখন মাআছিরে রাহিমি রচনা শেষ করেন, তখন তিনি এই বইয়ের ব্যাপারে জানতেনই না।
বাদায়ুনী এই গ্রন্থে ইতিহাসকে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে ভাগ করেননি। কিন্তু তার বিষয়বস্তু তার নিজের প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে ভিন্নভাবে সাজিয়েছেন। রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনায় তিনি প্রধানত তারিখে মোবারক শাহী ও তবকাতে আকবরি থেকে সহায়তা নেন। আর সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসের জন্য সহায়তা নেন প্রধানত আলা উদ্দৌলার নাফায়েসুল মাসির থেকে। বাদায়ুনীর গ্রন্থটি সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলেও মূলত আকবরের বিবরণী হলো তার প্রধান দিক। কারণ আকবরের শাসনামলের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। দরবারের অংশীদার ছিলেন এবং ঘটনার আড়ালের ঘটনাগুলো দেখেছিলেন মনোযোগসহকারে। মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ গ্রন্থের আকবর বিষয়ক অংশটি ১৮৬৮ সালে লখনৌ থেকে প্রকাশিত হয় স্বতন্ত্রভাবে। প্রায় পাশাপাশি সময়ে ডক্টর নাসিউলিসের সম্পাদনায় বইটি প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। ১৮৬৪-৬৯; ছয় বছরের ব্যবধানে একাধিক জায়গা থেকে বইটির প্রকাশ বলে দেয় ঔপনিবেশিক আমলে ইতিহাস অধ্যয়নে বইটি বিশেষ গুরুত্ব অধিকার করেছিল।
কলকাতা থেকে বুকস অব ইন্ডিয়া সিরিজে তিন খণ্ডে বইটি প্রকাশের পরে এর খ্যাতি ও গুরুত্ব পশ্চিমা দুনিয়ায়ও স্বীকৃত হতে থাকে। W. H. Lowe, George S.A. Ranking এবং W. Haig-এর অনুবাদে গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়। প্রথম খণ্ডের অনুবাদ করেন জর্জ র্যাংকিং, দ্বিতীয় খণ্ড ডব্লিউ এইচ লুই এবং তৃতীয় খণ্ড ডব্লিউ হেইগ। এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা তাদের বিবলিওথেকা ইন্ডিয়াকা সিরিজের অংশ হিসেবে ১৮৮৪ এবং ১৯২৫ সালে খণ্ডগুলো প্রকাশ করে।
ডক্টর উইলান এই গ্রন্থের উপর স্বতন্ত্র কাজ করেন। তিনি শুধু আকবর-বিষয়ক অংশ অনুবাদ করেন। গ্রন্থটি উর্দুতে অনুবাদ করেছেন মৌলভি এহতেশাম উদ্দিন মুরাদাবাদি যা ১৮৮৯ সালে নৌল-কাশউইর লখনৌ থেকে ছাপা হয়।
আবদুল কাদির বাদায়ুনী একদিকে ধর্মীয় জীবনে বিকৃতি ঘটানোর জন্য আকবরের নিন্দা করেছেন, অপরদিকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন রামায়ণ ও মহাভারত। বাদায়ুনীর মতে, বহু ধর্মের চর্চা ও অনুশীলন থাকবে একটি রাষ্ট্রে এবং জাতিতে জাতিতে জ্ঞানগত আদান-প্রদানও চলমান থাকবে। সাংস্কৃতিক অবগতির বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পরস্পরকে জানা ও অধ্যয়নের পরিসর বিস্তৃৃত হওয়া উচিত। কিন্তু এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মকে গুলিয়ে বিকৃতি সাধন করার মধ্যে ধর্মের অবমাননা ও আত্মপ্রহসন ছাড়া আর কিছু নেই। প্রত্যেক ধর্ম যার যার বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ধারায় চলমান থাকবে। এর মধ্য দিয়েই তাকে বুঝতে হবে, এই প্রকৃত অবস্থানে তার সাথে মোলাকাত করতে হবে। ধর্মকে এমন কিছু বানানো যাবে না, যা আসলে সে নয়। কিংবা বিভিন্ন ধর্মের নানা উপাদানের সংমিশ্রণকে ধর্মের নামে হাজির করা যাবে না, যা মূলত ধর্মসমূহের স্বভাবিকতার প্রতি অন্যায়।
ইতিহাস চর্চায় বাদায়ুনী যেমন সমসাময়িক কর্তৃপক্ষ ও শাসকের পছন্দের বক্তব্যকে পাত্তা দেননি, তেমনি ধর্মের প্রশ্নে এস্টাবলিশমেন্টের প্রয়োজন ও আয়োজনের বদলে ধর্মের দাবি ও স্বরূপের প্রতি নিষ্ঠাবান আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা