২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

খ্রিষ্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত

খ্রিষ্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত - নয়া দিগন্ত

২৩ মে গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পূর্ব তিমুরের মতো বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে এখানে একটা খ্রিষ্টান দেশ বানানোর এবং বঙ্গোপসাগরে একটা ঘাঁটি করার চক্রান্ত চলছে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবসাবাণিজ্য চলে। এ জায়গাটার ওপর অনেকেরই নজর। সেটি আমি হতে দিচ্ছি না- এটাও আমার একটা অপরাধ। কোনো এক সাদা চামড়ার মানুষ এ প্রস্তাব দিয়েছে।

আমি স্পষ্ট বলেছি, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, আমরা যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি, দেশের অংশ ভাড়া দিয়ে বা কারো হাতে তুলে দিয়ে আমি ক্ষমতায় যেতে চাই না, ক্ষমতার দরকার নেই। যদি জনগণ চায় ক্ষমতায় আসব, না হলে আসব না। এই কথাগুলো বললাম, কারণ সবার জানা উচিত। ৭ জানুয়ারি আমার ক্ষমতায় আসতে অসুবিধা হবে না, যদি আমি বাংলাদেশে কারো বিমানঘাঁটি করতে দেই। এমন প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল (বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ২৩ মে’ ২৪; যুগান্তর, ২৪ মে’ ২৪)।

প্রধানমন্ত্রী যে শঙ্কা ও বিপদের কথা বলেছেন বিগত ২৫ বছর ধরে আলিম ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদরা এ চক্রান্তের কথা প্রকাশ্যে জনসমক্ষে তুলে ধরেন এবং জনগণকে সচেতন করে আসছেন। এ বিষয়ে নয়া দিগন্তে বেশ ক’টি উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।

জনগণ উদ্বেগের সাথে লক্ষ করেছে দেশে যখনই রাজনৈতিক ক্রাইসিস শুরু হয় সাদা চামড়ার মানুষদের আনাগোনা বাড়ে। তারা সরকারি, বিরোধী ও সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে বারেবারে বৈঠক করেন। সরকারি দলকে চাপে রাখেন এবং বিরোধী দলকে ক্ষমতার মুলা দেখান। একদলকে নামিয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানোতে থাকে তাদের বিশাল বিনিয়োগ। তাদের মূল অ্যাজেন্ডা তাদের আধিপত্য ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। তারা কোনো সরকারের বন্ধু নয়। অতীতে তারা বহুদেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করেছেন। সাদা চামড়ার লোকেরা বাংলাদেশে যা ইচ্ছা তা করতে পারেন না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে তাদের বিবেচনায় রাখতে হয়। চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের মুকাবেলায় ভারতকে তাদের প্রয়োজন।

সাদা চামড়ার লোকেরা কূটনৈতিক-রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি এনজিওর মাধ্যমে সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের কথা বলে খ্রিষ্টীয় ধর্ম প্রচারের ব্যবস্থা করে থাকে। জনগণের দরিদ্রতার সুযোগটা পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা ঘিরে এনজিও এবং আন্তর্জাতিক খ্রিষ্টান লবি বিজাতীয় সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে সুদীর্ঘ কালব্যাপী নানামুখী চক্রান্ত চালিয়ে আসছে। চিকিৎসা, সমাজ ও মানবতার সেবার অভিনয়ে তারা মূলত পার্বত্য এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে ইউরোপীয় জীবনাচার ও দর্শনের দিকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালাচ্ছে। স্কুল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, হাসপাতাল স্থাপন, ঋণ প্রদান, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, দারিদ্র্যবিমোচন, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি মুখরোচক কর্মসূচির আড়ালে রয়েছে এ দেশে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করার নীলনকশার বাস্তবায়ন। স্মরণযোগ্য যে, বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস।

বিদেশী তহবিলে পরিপুষ্ট ঝাঁকে ঝাঁকে এনজিও এখন তিন পার্বত্য জেলায় সক্রিয় আছে। কিন্তু এত দিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আর্তমানবতার সেবার নামে এসব এনজিওর বেশির ভাগ আসলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত করার কাজে কোমর বেঁধে নেমেছে। এ কাজে তাদের সাফল্য রীতিমতো চোখ ধাঁধানো। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে বর্তমানে ১৯৪টি গির্জা উপজাতীয়দের ধর্মান্তরিত করে খ্রিষ্টান বানানোয় মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। খাগড়াছড়ি জেলায় আছে ৭৩টি গির্জা। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এ জেলায় চার হাজার ৩১টি পরিবার খ্রিষ্টান হয়েছে। বান্দরবান জেলায় গির্জা আছে ১১৭টি। এখানে একই সময়কালে খ্রিষ্টান হয়েছে ছয় হাজার ৪৮০টি উপজাতীয় পরিবার। রাঙ্গামাটিতে চারটি চার্চ খ্রিষ্টান বানিয়েছে এক হাজার ৬৯০টি উপজাতীয় পরিবারকে।

এগুলো তুলনামূলকভাবে হাল আমলের হিসাব। পাহাড়ি যেসব জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তাদের প্রায় শতভাগ খ্রিষ্টান হয়ে গেছে অনেক আগেই (এম এ নোমান, আমার দেশ, ১২.০৮.২০১১)।

পাহাড়িদের নিজস্ব সংস্কৃতি অটুট রাখতে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনকারী পশ্চিমা গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে চলা ধর্মান্তরকরণ সেখানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, উপজাতীয়দের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ আজ আক্ষরিক অর্থে বিপন্ন। তাদের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়া পাহাড়িদের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি যারা ঘটাচ্ছে তারা যদি পাহাড়িদের রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের শিকড় কেটে দিতে সক্ষম হয় তবে তা বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠবে। এভাবে দেশের একটি স্পর্শকাতর এলাকায় ডেমোগ্রাফির নাটকীয় পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া যায় না। ত্রাণ ও সেবার নামে আসলে ওই অঞ্চলের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া লোকজনকে ধর্মান্তরিত হতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। এ কথা সত্য যে, আমরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সমতলবাসী বাঙালিরা পাহাড়িদের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা করিনি। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, ব্রিটিশ রাজশক্তি ঔপনিবেশিক আমলে বিশেষ মতলব নিয়ে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছিল, যাতে পরস্পরের মধ্যে সার্বিকভাবে দূরত্ব তৈরি হয়। তাদের সেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফল এখন পাকতে শুরু করেছে বলে মনে হয় (প্রাগুক্ত)।

ইতোমধ্যে কেএনএফ ‘কুকি-চিন রাজ্য’-এর মানচিত্র প্রকাশ করেছে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বাংশের রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক উপত্যকা বাঘাইছড়ি থেকে শুরু করে বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি এবং বান্দরবানের উপকণ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড় হয়ে রুমা, থানছি, লামা ও আলিকদমসহ ৯টি উপজেলা রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ তিন জনজাতি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের পরিত্যক্ত করা হয়েছে কথিত এ রাজ্যে। রাখা হয়েছে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোদের। সংখ্যার দিক দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের পরেই রয়েছে ম্রো জনগোষ্ঠী। ম্রোদের মোট জনসংখ্যা ২২ হাজার ১৭৮ জন। বম জনসংখ্যা ১৭ হাজার। ম্রোদের দাবি, তাদের প্রকৃত সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। বমরাও একই রকম দাবি করেন (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৩০ জুন, ২০২২)।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মো: মজিবুর রহমান দৈনিক নয়া দিগন্তের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শুধু কেএনএফ নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ক’টি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন আছে তারা সবাই এই ভূখণ্ডকে আলাদা রাষ্ট্র তথা জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। এরা দেশের শত্রু। স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের জন্য বরাবরই হুমকি। এগুলোর পেছনে মূলত দায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) প্রধান সন্তু লারমা। তিনি শান্তিচুক্তি করলেও প্রধান দু’টি শর্তই মানেননি। অস্ত্র জমা না দিলে তো শান্তিচুক্তি আর বাস্তবায়ন হয় না। তার কারণেই বিভিন্ন গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গ্রুপ এখন দেশরক্ষা বাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। এগুলো কঠোরভাবে দমন করা না হলে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে।’

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) মো: আবদুর রশীদ বলেন, ‘সদস্য সংখ্যার বিবেচনায় কেএনএফ তেমন বড় বা শক্তিশালী কোনো সংগঠন নয়। এ মুহূর্তে তাদের সদস্য সংখ্যা কম। তবে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাথে জোটবদ্ধ হলে সেটি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্থানীয় জনগণকে আনুগত্যে বাধ্য করতে পারে। তবে আপাতত সামগ্রিকভাবে এটা তাদের অপচেষ্টা।’ তিনি বলেন, ‘কেএনএফ মিয়ানমার থেকে এখন কিছুটা সমর্থন পেতে পারে। সেটি সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়েও হতে পারে। তারা যেহেতু সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাই আমাদের সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে বাংলাদেশের মাটিতে তারা শক্ত ঘাঁটি গড়তে না পারে’ (সময়ের আলো, ১৬ অক্টোবর, ২০২২)।

ভয়াবহ পরিস্থিতির এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুসলমানদের দাওয়াতি ও সেবার ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বাস্তব কর্মসূচি হাতে নিতে হবে, যাতে খ্রিষ্টান মিশনারিদের কবল থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও লালিত কৃষ্টি রক্ষা করা যায়। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আলিমসহ সর্বস্তরের মুসলমানকে এ বিষয়ে সুচিন্তিত কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। পার্বত্য এলাকায় ইসলামের দাওয়াতি তৎপরতা চালাতে টাস্ক ফোর্স গঠন করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। যেসব মানুষ ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরনো ধর্ম ত্যাগ করেন, তারা সঙ্গত কারণে নিজেদের পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন, বাসস্থান, শিক্ষা ও জীবিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তহবিল গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : লেখক ও গবেষক।


আরো সংবাদ



premium cement