চক্রের কব্জায় শ্রমবাজার
- রিন্টু আনোয়ার
- ১৫ জুন ২০২৪, ০৬:২৬
সোনালি আঁশ, চা, কাঁচাচামড়া শেষ। কোনো রকমে টিকে আছে তৈরী পোশাক শিল্প। নানা খাতের এমন দুদর্শার মধ্যে ভরসার জায়গা রেমিট্যান্স, মানে শ্রম রফতানি বাজার। বিভিন্ন দেশে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশী কঠোর পরিশ্রম করে বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখছেন। পরিবারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিয়ে আসা এবং একটু স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে প্রতি বছর বিদেশে পা বাড়ান ১০ লক্ষাধিক বাংলাদেশী কর্মী। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করেন, বৈদেশিক রিজার্ভ সমৃদ্ধ করেন বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মীরা। সেটি শেষ করার যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছে সরকার ঘরানার একটি চিহ্নিত চক্র। এরা অজানা-অচেনা নয়। একবারে শিনা টান করে ঘুরে বেড়ানো দানব। অবিশ্বাস্য তথা বম্বের সিনেম্যাটিক ক্রিয়াকর্ম তাদের। সম্প্রতি এরা মোটামুটি প্রমাণ করে দিয়েছে, হয় এরা অধরা প্রজাতি, নইলে সরকার এদের কব্জায়।
প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের জুনে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার পর বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে দেশটিতে যেতে থাকেন বাংলাদেশী কর্মীরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে পাঁচ লাখ ২৭ হাজার কর্মী পাঠাতে বৈধ সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে যুক্ত করার দাবি ওঠে তখন। তবে প্রায় দুই হাজার এজেন্সির মধ্যে মাত্র ১০১টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আর বেঁধে দেয়া ৭৯ হাজার টাকার পরিবর্তে প্রতি কর্মীর কাছ থেকে সাতগুণ টাকা নিয়েও ৩০ হাজার কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে পারেনি এজেন্সিগুলো।
কী আচানকে চোখের সামনে প্রকাশ্যে এরা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বরবাদ করে দিয়েছে! হাজার হাজার মানুষের সর্বনাশ করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে এরা কাজটি করেছে। সরকারকে করেছে অসহায়। আর দেশের সম্মান তো ভূলুণ্ঠিত করেছেই। এসব গুণধরের কায়কারবারে এখন মধ্যপ্রাচ্যের অবশিষ্ট শ্রমবাজারও হারানোর অপেক্ষায়! এর অনেক দূর এরা সেরে ফেলেছে। কোমর বেঁধে মাঠে তৎপর এ চক্রের সঙ্ঘবদ্ধ সাঙ্গোপাঙ্গরা। বাহরাইন ও ওমানের বন্ধ শ্রমবাজার চালু না হওয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসানীতির কড়াকড়িতে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে এমনিতে নানামুখী সঙ্কট। কিন্তু, এতে চক্রটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মালয়েশিয়ায় এত বড় কুকর্মের পরও তাদের একটি কেশেও টোকা না পড়া তাদের জন্য একটি প্রণোদনা ও সামনে আরো অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার গ্রিন সিগন্যাল বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট-এনওসি।
তাদের অপকর্মের জেরে গত ৩১ মের মধ্যে ১৭ হাজার ই-ভিসাপ্রাপ্ত বাংলাদেশী দেশটিতে যেতে পারেননি। দালালচক্রের হাতবদল হয়ে এসব কর্মীর কাছ থেকে প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। এসব ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীর ভাগ্যে কী আছে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। আরো প্রায় ২০ হাজার কর্মী অনুমোদন পেয়েও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সিন্ডিকেট মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের কাছ থেকে জনপ্রতি সাড়ে চার লাখ টাকা করে এবং প্রায় ১০ লাখ কর্মীর মেডিক্যাল পরীক্ষা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যেসব কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের পাঠাতে সরকার আরো চেষ্টা চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। তবে ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ান হাইকমিশনার হাজনাহ মোহাম্মদ সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছেন, এ হতভাগাদের জন্য সময় বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ নেই। এরপরও আমাদের মন্ত্রী বলেছেন, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেছেন, দায়ীদের ধরা তো হবেই। এখন মূল কাজ হচ্ছে দোষীদের খুঁজে বের করা। প্রশ্ন হলো, ধরার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়ী বা দোষীদের কি খুঁজতে হয়? সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে যাদের নাম এসেছে, তাদের কি খুঁজতে হয়? তারা কি নিরুদ্দেশ-নিখোঁজ? সংসদে এ নামের দেখা যাওয়া, নিয়মিত সরকারের ও দলের বিভিন্ন কাজে অবদান রাখা এ নামের বিশিষ্টজনরা তাহলে কারা? এটিও কি বেসিক ব্যাংকের শেখ আবদুল হাই বাচ্চু কাহিনী? ব্যাংকটিকে খেয়েদেয়ে শেষ করে তিনি দিব্যি ঘুরছেন। কিন্তু, বছরের পর বছর পুলিশ, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে খুঁজে পায় না! দেশের শ্রমবাজার ছারখার হয়ে যাচ্ছে, হাজারো সাধারণ মানুষের নিঃস্ব করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে দেশের ইমেজ বরবাদ করা মহাশয়রা দিব্যি মোজ মাস্তিতে থাকবেন!
মালয়েশিয়া সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী, ৩১ মে পর্যন্ত দেশটিতে পাঁচ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৬ বাংলাদেশী কর্মীকে পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ছাড়পত্র দেয় প্রায় চার লাখ ৯৪ হাজার ৬৪২ জনকে। অজ্ঞাত কারণে বাদ দেয়া হয় ৩২ হাজার কর্মীকে। কথা ছিল, জনপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা করে দেবেন কর্মীরা। এ খরচের ভেতর আছে : পাসপোর্ট খরচ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, নিবন্ধন ফি, কল্যাণ ফি, বীমাকরণ, স্মার্ট কার্ড ফি ও সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জ। আর ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার উড়োজাহাজ ভাড়াসহ ১৫টি খাতের খরচ বহন করবে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় তালিকাভুক্ত চার লাখ ৭৬ হাজার ৬৪২ জনের কাছ থেকে সিন্ডিকেট কারসাজি করে মালয়েশিয়ার আমিন নুর ও দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো হাতিয়ে নেয় নির্ধারিত ফি বাদে গড়ে পৌনে পাঁচ লাখ টাকা করে, যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা।
এ অপকর্মের ইজারাপ্রাপ্ত সবাই হেভিওয়েট। তাদের শিরোমণিরা তো গোটা দেশের একেক জন কর্ণধার। তার কি যেনতেন ব্যাপার? তাদের আশপাশে দাঁড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দূরে থাক, আদাব-সালাম দেয়াও এখন দেশের মানুষের জন্য একটি সৌভাগ্যের ব্যাপার! এরপরও সরকারের শীর্ষস্থানীয়রা বলেছেন, মালয়েশিয়ার ঘটনায় দায়ীদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সবার বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ ধরনের হুঙ্কার এলে ভুক্তভোগী মানুষ একটু হলেও কলিজায় পানি পায়। কিন্তু দুষ্কর্মের হোতারা কিন্তু এর ফের বোঝে-জানে। জানে বলে তাদের চোখ এখন আরো সামনে মধ্যপ্রাচ্যসহ নানান দিকে।
বিদেশে জনশক্তি রফতানির উল্লেখযোগ্য অংশের চোখ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান ও বাহরাইনের দিকে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়ার দিকেও নজর কারো কারো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে। দেশটিতে বর্তমানে ২৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশী শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সৌদি আরবের পরিবর্তিত অভিবাসন আইন ও বৈশ্বিক মন্দাসহ নানা কারণে হাজার হাজার প্রবাসী চাকরি হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বর্তমানে আমাদের সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী কর্মীর কাজ নেই। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে আউটসোর্সিং কোম্পানি খুলে হাজার হাজার কর্মী নিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। এসব বাংলাদেশী কর্মী দেশের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাবার কিনে খাচ্ছেন। অথচ দেশের আদম ব্যাপারিদের কাছে এটি কোনো ঘটনা না। এরা মালয়েশিয়া অ্যাপিসোড শেষে এখন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের দিকে নজর। সাফল্যের হাতছানি সেখানেও। এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েও গেছে। জায়গায় জায়গায় লোক ঠিক করে রেখেছে।
নিজস্ব উদ্ভাবিত আরো বহু কায়দাকানুন তাদের জানা। যুক্তরাজ্য, দুবাই থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও ভারতেও তাদের চেইন আছে। রাজধানী ঢাকায় জটলা না পাকিয়ে এমএলএম তরিকায় দেশের জেলায় জেলায়ও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে নিজেদের প্রতিনিধিদের। এসব প্রতিনিধির মাথার ওপরে সেট করা হয়েছে এমপি, চেয়ারম্যান, মেয়রসহ স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধিকে।
দেশের বাস্তবতায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডে কাউকে দায় নিতে হয় না। সাতগুণ বেশি টাকা দিয়েও কাদের দোষে মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না ৩০ হাজার কর্মী? বর্তমানে সংবাদ সম্মেলন করে এমন প্রশ্নে একে অপরের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। তবে মন্ত্রণালয় ও রিক্রুটিং এজেন্সি সংগঠন বায়রার গাফিলতিকে দুষছেন এ খাতের প্রবীণ অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা। তবে এত পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীর স্বপ্নভঙ্গে সরকারের কোনো দায় দেখছেন না প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী। দায় বা যন্ত্রণার পুরোটা যেন ভুক্তভোগীদের। তারা এত টাকা দিয়ে প্রতারিত হতে যান কেন? এভাবে খোলাসা করে বলে দিলে বোধোদয় হয়ে যায়। বিষয়টি সোজাসাপটা জানিয়ে দেয়া ভালো। এত ছলচাতুরী-তামাশা, কথার মারপ্যাঁচ দরকার পড়ে না। কষ্ট করে মুখ খরচ করে বলতে হয় না- কাউকে ছাড় দেয়া হবে না! খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। কী দরকার এ ধরনের হুমকি-ধমকি মশকরার? বলে দিলে হয়, কিছু পীরের গরু ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যার যার ক্ষেত-ফসল সামলে রাখা যার যার দায়িত্ব। সরকার, মন্ত্রণালয়, এজেন্সি, অ্যাসোসিয়েশনসহ নানা প্রতিষ্ঠান এগুলো রাখতে হয় তাই রাখার জন্য রাখা!
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা