২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চোরাকারবারি কেন এমপি হবেন?

আনোয়ারুল আজিম আনার - ফাইল ছবি

বাংলাদেশে ১৯৮১-২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মোট চারজন সংসদ সদস্য খুন হন। এই চারজনের মধ্যে প্রথম দু’জন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে এবং পরের দু’জন সরকারে থাকা অবস্থায় খুন হয়েছেন। ২০০৪ সালে গাজীপুরে আহসান উল্লাহ মাস্টার, ২০০৫ সালে হবিগঞ্জে শাহ এম এ এস কিবরিয়া, ২০১৬ সালে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন গাইবান্ধায় নিজ বাড়িতে খুন হন। সর্বশেষ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হলেন ভারতের কলকাতায়।

ভারতে বাংলাদেশের এই সংসদ সদস্য হত্যার ঘটনায় এখনো দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছেন। মরদেহের সন্ধান ও হত্যার কারণ জানতে উভয় দেশের কর্মকর্তারা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছেন। আসামিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিহতের লাশ খুঁজে পেতে কয়েক দফা অনুসন্ধান করে সর্বশেষ কলকাতার যে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ‘খুন হয়েছেন’ বলা হচ্ছে, তার সেপটিক ট্যাংক থেকে কিছু মাংসের টুকরা উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
তবে, প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের নাগরিক একজন এমপিকে ভারতে হত্যার ঘটনায় বিচার হবে কোন দেশে? কারণ হত্যা সংঘটনের স্থান ভারতের কলকাতায় হলেও এর পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভুক্তভোগী, আসামি, ঘটনাস্থল এবং হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বিবেচনায় দুই দেশেরই এই হত্যা মামলার বিচার করার এখতিয়ার রয়েছে।

এদিকে আনোয়ারুল আজিম আনারের মৃত্যুর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না হওয়ার কারণে ঝিনাইদহ-৪ আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারছে না জাতীয় সংসদ সচিবালয়। যদিও হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশের দিনই (২২ মে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত না করলে জাতীয় সংসদ আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারবে না। কারণ আনোয়ারুল আজিম আনারের দেহ পাওয়া যায়নি। হত্যার মোটিভও বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় পুলিশ কেউই জানতে পারেনি। কোনো একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে হত্যা নিশ্চিত না হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।

বিদেশে বাংলাদেশের কোনো সংসদ সদস্যের টুকরো টুকরো লাশ হয়ে হত্যার ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম। সেটিও আবার বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী নিরাপদ দেশ ভারতে!

এর আগে বিদেশী কারাগারে ঠাঁই হয় আমাদের আর এক মাননীয়ের। তাও ইসলামী দুনিয়ার নামকরা দেশ কুয়েতে। নিজ দেশে মাননীয়দের কারো কারো সাবেক হওয়ার পর জেলে যাওয়া বড় ঘটনা নয়। বিদেশে কারাগারে ঠাঁই হওয়ার রেকর্ডটি হয়েছিল কুয়েতে বাংলাদেশের মাননীয় সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলকে দিয়ে। ঘটনা রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কারণে নয়, মানব ও অর্থপাচার, ভিসা কায়কারবারসহ ঘুষ দেয়ার অভিযোগে। তাকে লাশ হতে হয়নি চলতি সংসদের মাননীয় আনোয়ারুল আজিম আনারের মতো।

ভিন্ন মতের রাজনীতিক-সাংবাদিকদের ধরে সীমান্তের ওপারে ফেলে আসার রেকর্ডটি পুরোনো। রোপণ করা গাছটির চারা বড় হয়ে এখন ফল ফলছে নিজের ঘরে। আগে থেকে ভাবলে হয়তো এই টাইপের মাননীয়রা সোনা চোরাচালান-মাদক বেচাকেনা, হুন্ডি ব্যবসার মতো কাজে জড়িয়ে কলাগাছ হওয়ার আগে কিছুটা হলেও ভাবতেন। মাননীয় আনার কলকাতায় নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি শুরুতে দেশের গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায়নি। টানা কয়েক দিন কোনো কোনো পত্রিকায় এটি প্রচার হয়েছে নেহাত নিখোঁজ সংবাদের মতো। তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ায় পাল্টে গেল দৃশ্যপটও। ব্রেকিং নিউজে তথ্যের কত যে ধুম। কারা কত দিন ধরে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে, কিভাবে খুন করেছে- আরো কত্তো প্রশ্ন। সঙ্গে অন্তহীন কথামালা। একজন টাটকা-তরতাজা মাননীয় পরম বন্ধু প্রতিবেশী দেশে গিয়ে টানা কয়েক দিন নিখোঁজ থাকলেন। দু’দেশের পুলিশ গোয়েন্দারা হদিসই বের করতে পারল না! দেশটিতে নিযুক্ত আমাদের কূটনৈতিক মিশন কী করছিল- এমন প্রশ্নবাণ তো রয়েছেই।

কেবল মাননীয় নন, যে কারো মৃত্যু সংবাদ জানার সাথে সাথে রেওয়াজ হচ্ছে, ক্ষমা করে দেয়াসহ তার প্রশংসা করা। তাকে ভালো বলা। বড় ভালো লোক ছিলেন বলে সমবেদনা জানানো। আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে বলা এবং বলানোর চেষ্টা চলে যে ‘বড় ক্লিনম্যান’ ছিল। এমপি-মন্ত্রী হলে সংসদে শোক প্রস্তাব আনা। কিছুক্ষণ তার প্রশংসা গাওয়া। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানানো। এ শোক যেন শক্তিতে পরিণত হয় সেই কামনা করা। পরপারে তিনি যেন ভালো থাকেন সেই দোয়া করা। তিনি এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন বলে হত্যার শিকার হয়েছেন মর্মে তার দল থেকে দাবি করা হয়েছে। এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখানে লোকেরা সন্তোষ প্রকাশ করছে। কেউ কেউ খুশিতে লাইক, লাভ রিয়েক্ট দিচ্ছে। শোকের বদলে এখানে আনন্দের বন্যা। তার মতো ক্লিন ইমেজের আরো কতজন মাননীয় আমাদের মহান জাতীয় সংসদে আছেন- সেই রসময় আলোচনা তো আছেই!

গত কয়েক বছর ধরে এই মাননীয়দের কারো কারো ক্লিন ক্রিয়াকর্ম রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে। চন্দ্রবিন্দু দিয়ে তাদের সম্বোধন করতে হয়। তারা মান্যবর। নামের পূর্বাপরে বলতে হয় মাননীয়-মহোদয়। এটি তাদের সাংবিধানিক প্রিভিলেজ। নিজ নিজ সীমানায় বা এলাকায় মহাশয় পর্যায়েও তাদের কেউ কেউ। জনগণ মনে মনে যাই ভাবুক, জনগণকে ঠিকই নানা উদামকাণ্ড মেনে নিতে বাধ্য করে ছাড়ছেন তারা। যেখানে যার মন যা চায় করছেন, বলছেন। এর মধ্য দিয়ে নিজেরা ফ্রিস্টাইলে উদাম বা দিগম্বর হচ্ছেন। আর সরকারকে ফেলছেন মোটা দাগের প্রশ্নের মুখে। জনগণকে তোয়াক্কা না করতে করতে এখন আর সরকারকেও তোয়াক্কার দরকার মনে করে না তারা। যেন ধরেই নিয়েছেন, সরকার বা দলের শীর্ষ পর্যায় এখন আর তাদের কিছু করবে না বা করতে পারবে না। তারা দেশকে-সরকারকে পেয়ে বসেছেন।

সরকারকে সমানে ডোবানোর কাজে সাবরিনা, পাপিয়া, খালেদ, সাহেদ, শোভন-রাব্বানীরা যারপরনাই অবদান রেখেছেন। আনিসুর রহমান, মমিনুল হক সাঈদ, মোল্লা কাউছাররাও কম করেননি। তাদের বাইরে সাংবিধানিক মাননীয় চট্টগ্রামের শামসুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলার নুরুন্নবী শাওন, নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজারের নজরুল ইসলাম বাবুসহ আরো কত। ডা: দীপু মনি, জাহিদ মালেকও বাদ পড়েননি। প্রকল্প পাসের আগেই সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড-ইডিসিএল কারখানার জন্য ৩১ একর জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সদ্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার আত্মীয়স্বজনদের কাণ্ডকীর্তি এখনো বাসি বা তামাদি হয়ে যায়নি। ওই জমি অন্যের নামে হস্তান্তর ও মূল্যবৃদ্ধির কার্যক্রমে লিপ্ত হওয়ার খবর ফাঁস হয় নিজেদের মধ্যে ভেজাল হওয়ার কারণে। চাঁদপুরে নদী দখল এবং চড়া দামে বিকিকিনিতে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর জড়িত থাকার খবর ফাঁসের নেপথ্যও অনেকটা তেমনই। তার ভাই জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জাওয়াদুর রহিম টিপুসহ বেশ কয়েক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ৪৮ একরের বেশি খাসজমি দখলের খবর সরকারকে সামলে দিতে হয়েছে।

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, দলের কর্মীদের ওপরই মামলা-হামলা, নানা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততা, মাদক কারবার, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগও আছে তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে। জলমহাল, সরকারি খাস পুকুর, বাড়িঘর দখল, টেন্ডারবাজি তো মামুলি। এ ধরনের কিছু মহাশয়ের বিরুদ্ধে আরো আগেই তৃণমূল থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে রাখা হয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে। ব্যবস্থা নেয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে তা ঝুলে যায়। অভিযুক্তদের জন্য এটি আশীর্বাদের। এ ফাঁকে নাতনীর বয়সী কলেজছাত্রী নাদিয়াকে বিয়ে করে ভাইরাল হয়েছেন এক মাননীয়। পরিচয় গোপন রেখে দোসরা বিয়ে করে জেলহাজত খেটে মুখ দেখাতে সমস্যা হচ্ছে না পাবনার মাননীয় খন্দকার আজিজুল হক আরজুর। মাননীয় সংসদ সদস্যরা ‘ফ্রি স্টাইলে’ ঋণখেলাপি হচ্ছেন। নয়ছয় করে, ঘুষ-দুর্নীতি করে টাকা আয় করছেন। সে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

বর্তমানে নির্বাচিত ৮০ শতাংশ এমপিই চোরাকারবারে জড়িত বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। তিনি বলেন, স্মাগলার চোরাকারবারি, সন্ত্রাসী বা মাদক পাচারকারীর সংসদ সদস্য কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন দলে থাকার কথা নয়। রাজনীতি যেখানে যাওয়ার চলে গেছে, বাকি তো কিছু নেই আর। যেভাবে ভোট হচ্ছে, ভোটটাকেও দিলো শেষ করে। সবাই চান নিজেরটা। কিন্তু দেশের কী হবে কেউ চিন্তা করে না। চিন্তা করে, আমার কী হবে, আমি কত টাকা বানাতে পারলাম, হাজার কোটি টাকা... এসব।

চোরাকারবারি কেন এমপি হবেন? এমপি হবেন তারা, যাদের সংসদ, আইন এসব সম্পর্কে জানেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সংসদে চোরাকারবারি আছেন, ব্যবসায়ী আছেন। প্রশ্ন হলো, তারা আইনপ্রণেতা হন কিভাবে, আইন প্রণয়ন করবেনইবা কিভাবে?
এসবের কোনো জবাব নেই।

রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও। এগুলোর অনুপস্থিতি যতটা প্রকট হচ্ছে, আনারের মতো চিহ্নিত চোরাকারবারিরা এমপি হওয়ার সুযোগ পেয়ে বসছেন। এরকম বহু আনার এখনো আছে ক্ষমতার চারপাশে, দাবি করেন অনেকে।

জনগণ তাদের কিছু বলে না, কেবল সয়ে যায়। অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আসলে প্রতিবাদ করার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। একসময় এই উপলব্ধি তাদের হবে, প্রতিবাদ করার অধিকার থাকা তাদের জন্যও ভালো হতো। সেজন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
যশোরে আ.লীগের ১৬৯ নেতাকর্মীর আদালতে আত্মসমর্পণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো ২ বছর সময় দিতে হবে : ভিপি নুর সতর্ক থাকুন, দেশকে কেউ যেন বিভক্ত করতে না পারে : মির্জা ফখরুল নিরাপদ বাংলাদেশ গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪ দফা দাবি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে রাবি অধ্যাপক আতাউরকে সাময়িক অব্যাহতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হলেন নাসিমুল গনি রাজশাহীতে রাজপাড়া থানার নতুন ভবন উদ্বোধন এনআইডির তথ্য বেহাত, কম্পিউটার কাউন্সিলের সাথে ইসির চুক্তি বাতিল সবার সহযোগিতায় দুর্নীতিমুক্ত ও ক্রিয়েটিভ বাংলাদেশ গড়তে চাই : শিশির মনির মিরসরাই পৌরসভার সাবেক মেয়রের ওপর হামলা ‘বিচারের পরেই আওয়ামী লীগ ফিরতে পারবে’

সকল