২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এল নিনো-কার্যকারণ প্রসঙ্গে

এল নিনো-কার্যকারণ প্রসঙ্গে - ফাইল ছবি

গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক আবহাওয়া ক্রমশ দুঃসহ হয়ে উঠছে। অকাল বৃষ্টি, বন্যা, খরতাপ, দাবদাহ, মরুকরণ প্রক্রিয়া, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সব কিছু মিলিয়ে আবহাওয়াবিদরা হিমশিম খাচ্ছেন। গরমের সময় শীত, শীতের সময় বন্যা ও তুষারধস সুপ্ত আগ্নেয়গিরিগুলোর লাভা উদগীরণ, সব কিছু চিন্তিত করে তুলছে আবহাওয়াবিদদের। ওজোন স্তরের ক্ষয়-সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সব কিছু যেন একটি অশুভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রের উপরিভাগ অস্বাভাবিক উত্তপ্ত হয়ে উঠতে আবহাওয়ার এ অস্বাভাবিক আচরণ। এটিকে তারা বলছেন এল নিনো-কার্যকারণ। এর ফলে মরু অঞ্চলে অস্বাভাবিক বৃষ্টি এবং বন্যা, অঞ্চল বিশেষে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে তাপদাহ, অতিরিক্ত তুষারধস এবং বরফ গলে যাওয়া। বৈজ্ঞানিকরা, আবহাওয়াবিদরা বারবার সতর্ক করছেন, অতিরিক্ত কার্বন নির্গমন, নির্বিচারে বন-জঙ্গল, গাছপালা উজাড়, জলাধারগুলো ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ, গ্রিনহাউজ প্রভাবকে আমাদের অজান্তে বাড়িয়ে তুলছে। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, সবুজ বেষ্টনীর পরিমাণ ২৫ শতাংশের জায়গায় নেমে এসেছে ২ শতাংশে। গত ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে বনাঞ্চল এবং জলাধারগুলো। অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যন্ত্রযানের সীমাহীন আধিক্য, বাড়িঘর-স্কুল কলেজ, অফিস আদালত ও গাড়িতে শীতাতপ যন্ত্রের ব্যবহার, ইটভাটার অস্বাস্থ্যকর কার্বন নিঃসরণ, যন্ত্রযানের কালো ধোঁয়া- সব মিলিয়ে সারা দেশটা যেন এখন জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে কম বেশি সৃষ্টি হয়েছে এ অবস্থা।

‘মানুষের কৃতকর্মের কারণ জলে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে তিনি তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যেন তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।’ (সূরা আর রুম-৪১) ‘তোমাদের যেসব বিপদাপদ ঘটে, সেগুলো তোমাদের কৃতকর্মের ফল।’ (সূরা আশ-শূরা-৩০)

মহান সৃষ্টিকর্তার এ অমোঘ বার্তা আমরা কখনো ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। ‘যখন কোনো জনপদের লোকেরা জাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-১০৬) নবী করিম সা:-এর এ সতর্কবাণীও আমরা অনুধাবন করিনি। উল্টো নির্বিকারে বন ধ্বংস, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, তেজস্ক্রিয়া বর্জ্য পরিশোধনে ব্যর্থতা, নদী বিল খালের নাব্যতা বন্ধ হয়ে মৃত জলাধারে পরিণত হওয়া অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার ক্ষমতার দাপট দেখানোর যুদ্ধ সবকিছু প্রকৃতির স্বাভাবিকতা ধ্বংস করে এল-নিনোর প্রভাব আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এগুলোর সবকিছু মানুষের স্বোপার্জিত। পৃথিবীব্যাপী তোড়জোড় শুরু হয়েছে বনায়ন বৃদ্ধি, জলাধার তৈরি, পুরাতন জলাধার সংস্কার ও সংরক্ষণ, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ। অথচ আমাদের চিত্র ভিন্ন। গত ১০ বছরে দেশ বৃক্ষশূন্য হয়েছে একাধারে। উন্নয়নের নামে কাটা হচ্ছে হাজার হাজার শতবর্ষী গাছ। যেগুলো ছিল এক একটি অক্সিজেনের কারখানা। ছিল জীবন দায়ী। সেগুলো কেটে বিরান করা হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তর। সেগুলোর পরিবর্তে লাগানো হয়েছে ছয় মাস বা এক বছর বয়সী চারাগাছ। যেগুলোর বেড়ে ওঠার সুযোগ খুব কম। দেশের মহাসড়কগুলোর দিকে তাকালে এর সত্যতা বোঝা যায়। এখনো উন্নয়নের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষ নিধন চলছে নির্বিচারে। অথচ এ গাছগুলো বাঁচিয়ে রেখে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়গুলোতে গাছপালা ও পাহাড় কেটে সমতল করা হয়েছে। সেখানে চাষ করা হচ্ছে তামাক নামক বিষ। আবার মাঝে মধ্যে নিবন্ধনহীন ইটভাটাও চলছে জোরেশোরে। এসবের জ্বালানির মুখ্য অংশ হচ্ছে পাহাড়ের গাছ এবং জঙ্গল। যাদের এসব দেখার কথা অজানা কারণে তারা নিশ্চুপ। তাদের নাকের ডগা দিয়ে-চোখের সামনে চলছে প্রকৃতি নিধনের মহোৎসব। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, অধিদফতর এবং এর কর্মকর্তারা নির্বাক, নিষ্কর্ম প্রশ্নবিদ্ধ দর্শকের ভূমিকায়। অথচ এ মুহূর্তে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে তোলার মতো বৃক্ষরাজি রক্ষা করা প্রয়োজন। যে বৃক্ষ যেখানে আছে-সেটিকে সযতেœ সেখানে রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব।

পৃথিবীর বহু দেশে শতবর্ষী এমনকি চার পাঁচ শতবর্ষী গাছের দেখা মেলে। আমাদের দেশে এসব গাছের দেখা মেলা ভার। ক্রমাগত গাছপালা নিধনের ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে উত্তপ্ত কড়াই। সারা দেশের নদী-নালা এবং প্রাকৃতিক জলাধারগুলো হারিয়ে গেছে চিরতরে। একদিকে বৃষ্টি নেই, অন্যদিকে এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অন্য শহরগুলো তলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে। শহরের পানি বেরিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। ঢাকার বাতাস সারা বছর অস্বাস্থ্যকর। একসময় দেখা যাবে-বসবাস অযোগ্য হয়ে ঢাকা নগরী বিরান হয়ে গেছে।
মরুকরণ এড়িয়ে সারা দেশ বসবাসযোগ্য করে তুলতে অবিলম্বে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা দরকার।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গাছ বাঁচিয়ে বিকল্প উপায় বের করা এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজন সারা দেশে বছরব্যাপী বৃক্ষরোপণ অভিযান। মহাসড়কের পাশের পরিত্যক্ত জমিতে ঘন ও দ্রুত বর্ধমান বনায়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন গাছকাটা আইনের পরিবর্তন। ঢাকা মহানগরীর সব কলেজ-অফিস, আদালত প্রতিষ্ঠানের ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগানোর কাজ শুরু করা দরকার এখন-ই। বৃক্ষরোপণে ফলদ ও ভেষজ গাছের প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। এতে ফিরে আসবে পাখ পাখালি; পরিবেশ হবে ভারসাম্যপূর্ণ। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা আবশ্যিক করা প্রয়োজন। অবিলম্বে যেকোনো মূল্যে যেকোনো ধরনের পলিথিন প্রস্তুত এবং বাজারজাতকরণ বন্ধ করা দরকার। মাটিতে পচে মিশে যায় এ ধরনের তন্তুর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা দরকার। কলকারখানাগুলোর বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা, অন্যথায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কারখানা বন্ধ করে দেয়া এখন অত্যন্ত যৌক্তিক পদক্ষেপ। ছাদ বাগানকে উৎসাহিত করা দরকার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের জন্য।

নিবন্ধনহীন ইটভাটা বন্ধ করে এসবের মালিক ও অনুমোদনদান-কারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। নদীখেকো, বনখেকো, নদী, জলধারা ও পাহাড়খেকোদের চিহ্নিত করে দলমত নির্বিশেষে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। জাতীয় বাজেটে পরিবেশ রক্ষায় প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। সমাজের সব স্তরের জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থ জীবনের প্রধান শর্ত এটা।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement