২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সব সময় সব কথা বলা কি যায়!

সব সময় সব কথা বলা কি যায়! - নয়া দিগন্ত

রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ- শাসন, আইন ও বিচার বিভাগ। তবে কিছুকাল আগে থেকে আরো একটি উপাদানকে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে তাত্ত্বিকভাবে যোগ করা হয়েছে। সেটি হলো মিডিয়া বা গণমাধ্যম। যা-ই হোক, ইদানীং একটি তির্যক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এই চারটি স্তম্ভের কোনোটি কি এখন স্বরূপে সমুজ্জ্বল! চার স্তম্ভের হাল আমলের অবস্থান ও ভূমিকাকে দেখে অনেকের মনে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সংশয় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সে জন্যই এমন প্রশ্ন মানুষের মনে উঁকি দিয়েছে। সবাই জানেন রাষ্ট্রের চার স্তম্ভের ভূমিকা ও দায়িত্ব কী এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞজনরা মনে করেন, যৌক্তিক কারণেই এ প্রশ্ন জাগাটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। খুব দূর অতীত থেকে নয়, নিকট অতীত থেকে চার স্তম্ভের যে স্বরূপ সৌন্দর্য ও ভূমিকা ছিল সেটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। তবে নিকট অতীত থেকে আজ পর্যন্ত স্তম্ভগুলোর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় তার উজ্জ্বলতা নিম্নগামী হয়েছে এবং তার প্রভা হ্রাস পেয়েছে।

ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে পেতে এখন অনেকটা ম্লান ও বিবর্ণ। তাদের আবারো বর্ণাঢ্য করে তোলার প্রয়াস বা চিন্তা উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এদের অন্তত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টাও লক্ষ করা যাচ্ছে না। এভাবে যদি বিরামহীনভাবে স্তম্ভগুলো পেছনের দিকে ছুটতে থাকে তবে এটা অনিবার্য, তা দ্রুত বিলীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রায় শতভাগ। একটা সাধারণ উদারণ হচ্ছে- কোনো ঘরের যদি চারটি স্তম্ভ তথা খুঁটিকে উইপোকা খেয়ে ফেলে। তবে সে ঘর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তখন সে ঘর বিধ্বস্ত হয় আর ঘরের বাসিন্দারা উদ্বাস্তু হন এবং ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়েন। কোনো রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভই যদি ভেঙে পড়ে তবে সে রাষ্ট্রের নাগরিকরা কি ঠিকানাবিহীন হয়ে যাবে না? এ কঠিন সত্যটা কি ভেবে দেখা হচ্ছে? বোঝার চেষ্টা করছে কেউ?

এটা কি খুব জরুরি বিষয় নয়? এটি কোনো ব্যক্তিবিশেষের সমস্যা নয়। সবার সমস্যা। তাই সবাইকেই ভাবতে হবে। আর ভেবে শুধু আকাশের দিকে চোখ মেলে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের দূর পশ্চিমে এবং পূর্বদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। তাহলে দেখব ওই সব দেশের স্তম্ভগুলো সজীব প্রাণবন্তু এবং কর্মচঞ্চল। তার পরিণতিতে সেসব দেশ ঝলমল উঠছে, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। নাগরিকরা সেখানে আমাদের মতো বিমর্ষ বদনে ম্লান মুখে হতোদ্যম হয়ে নেই। তারা হাসছে গাইছে। সুখানন্দে হাস্যোজ্জ্বল সব মুখ।

বাংলাদেশে চার স্তম্ভের এমন পিছু হটা চতুর পাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সর্বত্র এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষবাষ্প অনেককে স্পর্শ করেছে। কোথাও কি এমন কেউ নেই যারা বিষের নীলকে অধঃপতিত ও দলিত মথিত করতে পারে। এগিয়ে এসে কেউ ত্রাতা হয়ে পাশে দাঁড়াবে না? ইতিহাস বলে ধ্বংসের ভেতর থেকে আবার নতুন মিনার তৈরি হয়। আমরা কান পেতে শুনি, হাত উঁচিয়ে রাখি, চোখ মেলে থাকি, সেই নতুনের পদধ্বনি শুনতে, হাত উঁচিয়ে রাখব সেই আগন্তুককে স্বাগত জানাতে। চোখ খুলে রাখব সেই আগন্তুকের পথের সাথী হতে।

এখন দেখা যেতে পারে, চার স্তম্ভের অন্যতম প্রধান শাখা শাসন বিভাগের ভূমিকা ও ইতিবৃত্তি। তবে খুব সংক্ষিপ্ত করে একটি ছোট উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। প্রশ্ন হতে পারে ছোট উদাহরণ কেন। উত্তর হচ্ছে, ছোট বিষয়ই যদি কেউ সামলাতে না পারে তবে বড় বিষয়ে তার অবস্থানটা কত নড়বড়ে আর বিপর্যয়কর হবে। সবাই জানেন, আজ আমাদের সমাজের ধৈর্যসহ্যের সীমা, পরিধিটা কত ছোট হয়ে হয়ে এসেছে। তাই সীমার মধ্যে থাকাটাই বোধ হয় নিরাপদ। ছোট বিষয় নিয়ে ছোট কথা বলার অঙ্গীকার করেছি। আফগানিস্তানের ভূমিকা নিয়ে কথাটা শুরু করছি। ভৌগোলিক বিচারে নয় তাদের অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ওই দেশটি এখনো খুব ছোট। তাদের চার স্তম্ভের কোনোটিই এখনো সচল উজ্জ্বল নয়। সেই দেশের নতুন একটি প্রশাসনিক পদেক্ষপ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মাত্র কিছুকাল আগে আফগানিস্তান বলতে পপি চাষের দেশ বা ভয়াবহ মাদকের জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। মাদক চোরাই করা পাচার করা বাবদ যে অর্থ আসত সেটিই ছিল ওই দেশের বহু নাগরিকের রোজগারের প্রধান উৎস। নয়া আফগান সরকার ক্ষমতায় এসেই সর্বত্র মাদকের বিষবৃক্ষ সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে। আর আমাদের এখানে পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় হলেও মাদককারবারিদের একটি পশম উৎপাটিত করা যায়নি। যে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানো হবে, সেই সর্ষের ভেতর সব ভূত বাসা বেঁধে আছে বাংলাদেশে। একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে পর্যন্ত মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। হাজারো সুন্দর নামে মাদকের সয়লাবে দেশ এখন ভাসছে। লক্ষ করুণ মাদকের প্রশ্নে কাবুল আর ঢাকার অবস্থান কত যোজন দূরত্বে। কাবুল সরকার তার অঙ্গীকার পূরণ করছে। আমরা হয়তো মনে করি আর কী করা যায়। সহঅবস্থান না হয় করি।

দেশের প্রশাসন নিয়ে অতীতের আরো একটা মূল্যায়নও আমাদের স্মরণে আছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জীবিত থাকাকালে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের একদল সাংবাদিক দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফর করে ঢাকাতেও তারা কয়েক দিন অবস্থান করেছিলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাব ভিজিটের সময়। ঢাকার এক প্রবীণ সাংবাদিক যিনি তখন ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক। তিনি কথা প্রসঙ্গে জার্মানির সিনিয়র জার্নালিস্টের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তোমরা যেসব দেশ সফর করে এসেছ ওই সব দেশের প্রশাসনের সাথে আমাদের প্রশাসনের কোনো তফাত কি লক্ষ করেছ। সেই জার্মান সাংবাদিক মুখে কোনো মন্তব্য না করে হাত তুলে দেখালেন তোমাদের আমলাদের অবস্থান দেড় হাত উঁচুতে। আজ যদি এ দেশের আমলাদের নিয়ে কথা ওঠে এবং সেই সাথে প্রশ্ন হয় তারা এখন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা না অন্য কারো বরকন্দাজ। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে এ দেশে অর্থনীতি শেষ হয়ে গেছে, ব্যাংক ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। অনিয়ম দুর্নীতি অর্থপাচার এখন এই রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। জনজীবন দুর্বিষহ, দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তায়ন রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পায় কেন? প্রশাসন ধ্বংসের আর কতটা সময় বাকি। সবাই যেন নিরোর মতো রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংসের এই ক্রান্তিকালে বাঁশি বাজিয়ে ঘুরছেন। আমাদের সীমান্তটা সুরক্ষিত? কেউ কি হাস্য পরিহাস করে এখানে পাখি শিকারের মতো মানুষ মেরে যায়?

আইন বিভাগ নিয়ে কথা বলার অবকাশ যথেষ্ট। যার নির্বাচনের শুদ্ধতা নিয়ে দেশে বিদেশে হাজারো প্রশ্ন আছে। যে আইন বিভাগের গঠন নিয়ে কুহেলিকার শেষ নেই। বৈধতাব প্রশ্নও বিদ্যমান। তার পক্ষে বিধান তৈরির পথ কতটা সঙ্গত। নৈতিকতার কতটা বরখেলাপ। এ সংসদ একাদশ সংসদেরই উত্তরসূরি। সেই একাদশ সংসদের মোট ২২টি অধিবেশনের একটা মূল্যায়ন কিছু আগের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, একাদশ সংসদের ২২টি অধিবেশন আয়োজন বাবাদ রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। কেননা সেখানে শুধু ব্যক্তিবিশেষের বন্দনা প্রশংসা ও স্তুতিতে খরচ হয়েছে শত কোটি টাকা। যদি কারো আগ্রহ থাকে তবে তাদের অনুরোধ করি, দয়া করে পঞ্চম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম সম্পর্কে একটু জানার চেষ্টা করুন। সেখানে জাতীয় সংসদের ভূমিকা কেমনতর ছিল। সেখানে কতটা নিষ্ঠার সাথে সেই সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তৎকালীন স্পিকার জনাব মির্জা গোলাম হাফিজ ও ডেপুটি স্পিকার ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ। তারা কতটা দক্ষতা যোগ্যতার সাথে সংসদ পরিচালনা করেছেন। সেটি দেখে নেয়া যেতে পারে। সেই সংসদের সংসদ নেতা আর প্রতিপক্ষের নেতাদের ভূমিকা জেনে নিতে পারেন। একটি সংসদ তখনই কার্যকর হতে পারে যখন তার অপজিশন বেঞ্চ ট্রেজারি বেঞ্চের চেয়ে কম দক্ষ নয়। সংসদের প্রতিটি সদস্য তখনই সাহসী দক্ষ যোগ্য হতে পারে যখন জনগণ তাদের সততা যোগ্যতা ও সক্ষমতা যাচাই বাছাই করে সংসদে পাঠাতে পারে। সে অতীতে জনগণের হাতে যাচাই বাছাই করা তথা ভোটদানের ক্ষমতাটা ছিল জনগণ বেছে বেছে তখন সংসদে সদস্যদের পাঠিয়েছে। ব্রিটিশ সংসদকে বলা হয় সংসদীয় সূতিকাগার বা মাদার পার্লামেন্ট। সেই ব্রিটিশ সংসদের বিরোধী দলের সদস্যদের সম্মান করে বলা হয়; হিজ ম্যাজিস্ট্রিজ অপজিশন।

আমাদের এখন তথাকথিত বিরোধী দলকে বলা হয় গৃহপালিত বিরোধী দল। এটা কি মর্মান্তিক আর অপমানজনক ব্যাপার নয়? তা ছাড়া তাদের আর কী বলা হবে! তারা তো জনপ্রতিনিধি নয়। ক্ষমতাসীনদের করুণার পাত্র মাত্র। ইদানীং আরো কিছু বিষয় নিয়ে অবাক আর হতভম্ভ হতে হয়। দ্বাদশ সংসদের কোনো কোনো সদস্য সোস্যাল মিডিয়ায় হাজির হয়ে কথা বলেন। প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কি তাদের ফোরাম। এর অর্থ দু’রকম হতে পারে। প্রথমত, তারা এই সংসদকে কথা বলার ফোরামই মনে করেন না। দ্বিতীয়ত, তাদের হয়তো বলার সুযোগ হয় না।

বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। সেখানে আমরা ভয়ে যেতে চাই না। বিচার বিভাগ নিয়ে অনেকে বহু কথা বলছেন। তবে তা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চাই। তবে অতীতে বিচার বিভাগের সম্মানিত বিচারপতিদের কিছু আচরণ ও বক্তব্য স্মরণ করে এখনো আন্দোলিত হই। তাদের অনন্যসাধারণ ভূমিকায় সবার ভেতর আশাবাদ সৃষ্টি হতো। তারা আইনের গণ্ডিতে থেকে আইনের ভাষাতেই কথা বলতেন। এমনকি সরকারপ্রধানকে পর্যন্ত তার ভুল বক্তব্য দেয়ার জন্য ভর্ৎসনা বলব না, তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলা এখানে সাঙ্গ করছি।

মিডিয়া কর্মী তথা সাংবাদিকদের জন্মকালে তাদের পায়ে শিকল জড়ানো বা হাতে চুড়ি পরা অবস্থায় ছিল না। কর্তার ইচ্ছায় যেমন কীর্তন গাইতে হয়। তেমনি কর্তৃপক্ষের আশা আকাক্সক্ষার সমঝদার হয়েই এখন সাংবাদিকদের পথ চলতে হয়। তাদের বেঁধে দেয়া স্বরলিপিতে গাইতে হয়। এখন সংবাদপত্র সেবক-সেবিকাদের হাত বাঁধা আছে। তাদের কর্মস্পৃহা কমেছে, সৃষ্টিশীলতা হ্রাস পেয়েছে। নিত্যনতুন আইনকানুন তাদের নিষ্প্র্রভ করছে। এসব কারণে এখন অনেকে তাদের প্রতিভা ও অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্ন উত্তোলনকারীরা একবার নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন। এমন এক বৈরী পরিবেশে তিনি কী করতেন। তারপরও বলব, এখন সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় সাংবাদিকদের অসম সাহসীকতার স্ফুরণ কি একেবারেই দেখা যায় না! তবে হ্যাঁ, অস্বীকার করব না, কখনো কখনো তারা কেবল মুদ্রার একটি পিঠ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। এটা একদেশদর্শিতার পরিচয়। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা বলে উল্লেখ করা হয়। এভাবেই প্রমাণ হয় বা আবিষ্কৃত হয় আমাদের সীমাবদ্ধতার দেয়াল কোথায়। এই সময়ের সৃষ্ট পরিবেশ পরিস্থিতি শুধু সংবাদপত্র, সংবাদপত্রসেবীদেরই জন্যই নয় ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। তবে সব কথা সব সময় কি বলা যায়। আভাষ ইঙ্গিত থেকে অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়। শেষ কথা- সবাইকেই এখন অনেক কিছুই বুঝতে হবে, সজাগ সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সময়ের মাত্র এক ফোঁড়ই যথেষ্ট।

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement