ঈদ আনন্দ
- গোলাম মাওলা রনি
- ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২৮
এবারের ঈদ আপনার কেমন কেটেছে তা আমি জানি না কিন্তু আমার ঈদটি ছিল জন্মের পর দেখা অদ্ভুত এক উৎসব। আমি নিজে অথবা আপনজনদের জন্য কেনাকাটা করিনি। কোনো ইফতার পার্টির আয়োজন করিনি এবং আমার শত শত ধনী বন্ধুর কেউই এবার আমাকে তাদের বাসায় দাওয়াত দেননি। অন্যান্য বার বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে পাঞ্জাবি জায়নামাজ আতর তসবি খেজুরের উপহারে সয়লাব হয়ে যেতাম। এবার শুধু আমার এক ডাক্তার বন্ধু ওমরাহ থেকে ফিরে একটি আতর তসবি এবং এক প্যাকেট খেজুর পাঠিয়ে আমার মাহে রমজানকে আনন্দময় করে তুলেছেন।
আমি নিজেও প্রতি বছর উপহার কিনি। কিন্তু এবারের ঈদে এবং পূর্ববর্তী দিনগুলোতে মনের ওপর এমনই এক জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে যা সরিয়ে ঈদের আনন্দের জন্য নিজেকে সচল করার কোনো সামর্থ্য ছিল না। ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের বেদনা, ব্যবসা বাণিজ্যের বেহাল দশা এবং পরিচিতজনদের অর্থনৈতিক হাহাকার আমাকে এতটা বিমর্ষ করে তুলেছে যে, আহার নিদ্রা বিশ্রাম বা বিনোদনে রীতিমতো অরুচি চলে এসেছে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রান্তিক পর্যায়ে কতটা আমায় হেনেছে তার দুটো উদাহরণ দিয়ে তারপর অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব।
প্রথম ঘটনাটি একজন গার্মেন্ট মালিকের যিনি করোনাকালীন বড় অঙ্কের আর্থিক লোকসানের মুখোমুখি হন। ৭০ বছর বয়সি অভিজ্ঞ ভদ্রলোক নিজে ব্যবসা করছেন ৩০ বছর ধরে এবং ব্যবসা শুরুর আগে দেশের নামকরা একটি গার্মেন্টস গ্রুপে টানা ২০ বছর চাকরি করেছেন। তার কর্মজীবন গত দুই বছর ধরে রীতিমতো জাহান্নামে পরিণত হয়েছে। পরপর কয়েকটি অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে তিনি বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে একের পর এক স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হারাতে থাকেন। ব্যাংকে নতুন এলসি খোলার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হন। তার দীর্ঘদিনের পরিচিত ক্রেতা বড় বড় অর্ডার দিয়ে তাকে সাহায্য করতে চান কিন্তু ডলার সঙ্কটের কথা বলে ব্যাংক এলসি গ্রহণ এবং সেই এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করতে থাকে।
গত এক বছর ধরে ভদ্রলোক বিভিন্ন ব্যাংকে দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো রকম ইতিবাচক সাড়া পাননি। ইতোমধ্যে সরকারি একটি ব্যাংকের সাথে কথা হয় যারা শতভাগ এফডিআর বা নগদ জমার বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে সম্মত হয়। ভদ্রলোক কালবিলম্ব না করে নিজের শেষ সম্বল জমিটি ৯ কোটি টাকায় বিক্রি করেন এবং ৬০ লাখ টাকা বায়না গ্রহণ করে ব্যাংকে জমা দেন। জমির ক্রেতা বায়না দলিলের এক মাসের মাথায় বাকি টাকা পরিশোধ করে দলিলের রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু তার টাকা যে ব্যাংকে জমা ছিল যে ব্যাংক আর্থিক সঙ্কটের কারণে গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ পরিশোধে তালবাহানা করতে থাকে এবং এভাবেই রমজান মাসের ১৫ তারিখ চলে যায়। টাকার সংস্থান করতে না পেরে ভদ্রলোক মোবাইল ফোন বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যান। অন্যদিকে জমি বিক্রেতা পড়েন মহাবিপদে। ব্যাংকসহ অন্যান্য পাওনাদার এবং ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা তার ঘুম হারাম করে দেন। যেদিন অফিস বন্ধ হওয়ার কথা এবং শ্রমিকদের বেতন বোনাস পরিশোধের কথা সেদিন ভোররাতে ভদ্রলোকের নিরাপত্তা রক্ষীরা শ্রমিকদের ভয়ে ফ্যাক্টরিতে তালা মেরে লাপাত্তা হয়ে যান। সকালবেলা শ্রমিকরা এসে ফ্যাক্টরি তালাবদ্ধ দেখে হন্যে হয়ে মালিকপক্ষকে খুঁজতে থাকেন। আর ৭০ বছর বয়সি বিপত্মীক মালিক তার কিশোর পুত্রকে নিয়ে সেই যে লাপাত্তা হয়েছেন যার হদিস এখনো মেলেনি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ধানমন্ডির একটি অভিজাত দোকানের। ঈদের পর দোকানপাট খুললে আমি সেই দোকানে যাই টুথপেস্ট কেনার জন্য। কথা প্রসঙ্গে দোকানের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করি এবার কেমন বিক্রিবাট্টা হলো। বিরস বদলে ভদ্রলোক জানালেন যে, গত ত্রিশ বছরে তিনি এতটা দুর্দশার মধ্যে পড়েননি। আমি আর কথা না বাড়িয়ে টুথপেস্টের মূল্য পরিশোধ করে দোকান থেকে বের হয়ে এলাম।
উল্লিখিত দুটো ঘটনার সাথে আপনি যদি নিজের ঈদ আনন্দের তুলনা করেন তবে খুব সহজেই নিজের সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যের হদিস পেয়ে যাবেন। আপনাদের মধ্যে যারা একটু আর্থিক সচেতন তারা হয়তো দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিয়ে আতঙ্ক অনুভব করবেন। কিছু ব্যাংককে দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচাতে এবং ব্যাংক ডাকাতদের অপকর্ম ধামাচাপা দিয়ে তাদের অপরাধের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার কৌশল হিসেবে একটি দুর্বল ব্যাংকের সাথে অন্য ব্যাংকের একীভূতকরণ নিয়ে যেসব খবর বের হয়েছে তা আপনার ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে কি না বলতে পারব না। তবে রাষ্ট্রের সাবেক কর্মচারী বেনজিরের অঢেল সম্পত্তি নিয়ে জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে যে রসালো খবর বের হয়েছে তাতে করে ঈদের আনন্দে ত্রিমাত্রিক রসায়ন ঘটেছে।
দেশের হাড্ডিসার শ্রমজীবী মানুষগুলো নিজেদের রোদে পোড়া চামড়া এবং রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে যে বেদনার মধ্যে ছিলেন তারা বাংলার আকাশে মেদবহুল থলথলে উজ্জ্বল সম্পদের পাহাড় সম্বলিত চাঁদমুখের বাহারি ছবি দেখে হয়তো এমন সান্ত্বনা লাভ করেছেন যে- আমরা পারিনি। তা কী হয়েছে ও তো পেরেছে। আমরা খেতে পারছি না তো কী হয়েছে। ও তো খেয়েছে এবং দিব্যি হজম করে সফলতার আকাশের উজ্জ্বল তারকারূপে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। শ্রমজীবী মানুষ ছাড়া অন্য শ্রেণী-পেশার লোকজন যা রাষ্ট্রীয় পদে থেকে টুকটাক দুর্নীতি করে চলেছে এবং আরো দুর্নীতির প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা দুর্নীতির ভিসির খোঁজ করছিল তারা এবারের ঈদের আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পেয়ে নিঃসন্দেহে আগামী ঈদ আরো জমজমাট করার স্বপ্নে বিভোর এবং আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল।
আমাদের দেশের যেসব লোক কথায় কথায় নীতিকথা বলে বেড়ায় এবং এই দুনিয়ার মধু মেওয়া পরিহার করে নিজেকে সাধু পুরুষ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা-তদ্বির করে তাদের কাছে বেনজিরের নজিরবিহীন সহায়সম্পদের খবর ছিল রীতিমতো চপেটাঘাত। তারা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কারো কারো কোষ্ঠকাঠিন্যের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল এবং ঈদের আনন্দে বেনজিরের নজিরবিহীন সফলতা নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। এবারের ঈদ আনন্দে তরমুজ বিদ্রোহ ছিল বাঙালির অন্যতম সাফল্যের মাইলফলক। বাঙালির একতা নেই- তারা রাগ করতে পারে না- বিদ্রোহ করতে জানে না- চোর দেখলে ভয় পায়, ডাকাতের নাম শুনলে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে- এসব অপবাদ যারা দিতেন এবারের তরমুজ বিদ্রোহে তাদের মুখে রীতিমতো চুনকালি পড়ে গেছে। রোজাদার বাঙালি লোভী তরমুজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবার তরমুজ কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে ধড়িবাজ তরমুজ বিক্রেতারা ভারি বিপদে পড়েছিল এবং আদি ও অকৃত্রিম প্রাগৈতিহাসিক গালাগাল করে তরমুজ বিদ্রোহীদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেছিল।
তরমুজ বিদ্রোহে শতভাগ সফলতার পর বাঙালি গরুর গোশতে বিদ্রোহের দিকে ধাবিত হয়েছিল। সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে এই বিদ্রোহে পরিপূর্ণ সফলতা না এলেও আংশিক সফলতা এসেছিল। পুরো রমজান মাসের বেহাল অবস্থা এবং বেশির ভাগ লোকের কাছে বিবর্ণ ঈদের রেশ এবার পয়লা বৈশাখের ওপরও পড়েছিল। এবারের পান্তা ইলিশ মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিহিতা বঙ্গ ললনাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস বিগত দিনের মতো ছিল না। অনেকে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন বটে কিন্তু পথেঘাটে উৎসবের আমেজ না থাকার কারণে বৈশাখের তপ্ত রোদে উত্তপ্ত হয়ে বিরস বদনে নিজ নিজ গৃহে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন।
চলতি বছরের ঈদ আনন্দের কয়েকটি আনকোরা ঘটনা হয়তো অনাগত দিনের ইতিহাস হয়ে থাকবে। এবার ছিঁচকে চোর ছিনতাইকারী এবং সঙ্ঘবদ্ধ ডাকাত দলের বড় কোনো অপকর্ম পত্রপত্রিকায় আসেনি। হয়তো চুরি-ডাকাতি করার মতো মালসামানের অভাব ছিল। নতুবা ডামি নির্বাচনের সফলতার পর চোর ডাকাতরা ভোটচোরদের কর্মকৌশলে হতবিহ্বল হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সনাতনী পদ্ধতিতে চুরি ডাকাতি না করে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার জরুরি। সে জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের জন্য তারা এবারের ঈদের লম্বা ছুটিতে বাঙালিকে কিছুটা ছাড় দিয়েছিল।
এবারের ঈদ আনন্দ যাই হোক না কেন, তবে ঈদ-পরবর্তী একটি আন্তর্জাতিক ঘটনা বাংলার ১৮ কোটি মানুষের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের হৃদয়-মন এবং মস্তিষ্কে এক অনন্য ঈদের আনন্দের পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। ইরান কর্তৃক ইসরাইলের মূল ভূখণ্ডে নজিরবিহীন এবং সফল ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার ঘটনায় তামাম মুসলিম দুনিয়ায় ঈদের নতুন চাঁদ উদিত হয়েছিল। ইসরাইলের নির্মমতা এবং ফিলিস্তিনিদের রক্তের বদলার জন্য সারা দুনিয়ার মুসলিমরা যখন আল্লাহর দরবারে অনবরত দোয়া করে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় ইরান কর্তৃক ইসরাইল আক্রমণ আল্লাহর জমিনে খুশির বন্যা বইয়ে দেয়। আর সেই খুশির আবেশে আমরা আমাদের নিত্যদিনের দুঃখ ভুলে নতুন এক ঈদ আনন্দের পুলক অনুভব করতে থাকি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা