তেলিয়াপাড়া বৈঠক-মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট
- কর্নেল (অব:) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি
- ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৯
২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিতে আক্রমণের সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটির অবস্থান ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এ পাঁচটি ব্যাটালিয়নই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাঁচটি ভিন্ন স্থান থেকে। যুদ্ধ তো এত সহজ বিষয় নয়। একটি শক্তিশালী দানবের মতো শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ তো বিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া যায় না। সফলকাম হওয়া বা শত্রুকে পরাজিত করার অদম্য লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করার ভীষণ প্রয়োজন ছিল সে সময়ে। তবুও যুদ্ধের ময়দানে তখন পাঁচটি ইউনিটের কমান্ডই ছিল মেজর ও ক্যাপ্টেনদের হাতে। জেনারেল ইশফাকুল মজিদ গ্রেফতার হওয়ার ফলে তখন সর্বজ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার ছিলেন কর্নেল ওসমানী। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কাশ্মির যুদ্ধ ও ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কমান্ডার। তিনি এবং অন্য সব অফিসার একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ৪ এপ্রিল একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
২৫ মার্চের কাল রাত্রির পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল ৪ এপ্রিল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল তেলিয়াপাড়া। এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার অন্তর্গত তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে উপস্থিত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন বীর সেনানী, যারা ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগঠক অকুতোভয় সিপাহসালার। এ সভা অনুষ্ঠিত না হলে এবং জেনারেল ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক ও প্রবাসী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশৃঙ্খল যুদ্ধে পরিণত হতো নিঃসন্দেহে।
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশারফ তার সদর দফতর প্রথমে মাধবপুর ডাকবাংলোয় স্থাপন করেন। সেখান থেকে পূর্ব যোগাযোগের ভিত্তিতে সীমান্ত এলাকায় তেলিয়াপাড়া বিওপির কাছে ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সাথে তার সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়। উভয়পক্ষের আলোচনায় ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া এসে চতুর্থ বেঙ্গলের সাথে যৌথভাবে সদর দফতর স্থাপন করেন। ইতোমধ্যে তেলিয়াপাড়ায় কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সমবেত হন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, এমএনএ, লে. কর্নেল (অব:) এম এ রব, এমএনএ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, লে. হেলাল মোর্শেদ খান, লে. নাসিরউদ্দিন, লে. মাহবুব, লে. আনিস, লে. সেলিম, লে. সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রমুখ। ৪ এপ্রিল সকালের মধ্যেই সেনা কর্মকর্তাদের সবাই তেলিয়াপাড়া বাংলোতে উপস্থিত হন। বেলা ১১টায় শুরু হয় ঐতিহাসিক সভার কার্যক্রম। প্রথমেই এর লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। ঐতিহাসিক এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা ছিল নিম্নরূপ :
সভায় মুক্তিকামী হাজার হাজার ছাত্র ও যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে সভায় উপস্থিত আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গাল ভারতীয় ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির স্থাপনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সভায় বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদের একটিমাত্র কমান্ড চ্যানেলে এনে সমম্বিত প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও সর্বাধিক অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়।
উপস্থিত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা এ দিনের কনফারেন্সে দেশটিকে চারটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন করে সেনা কর্মকর্তা নির্বাচিত করেন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে। বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর সফিউল্লাহকে। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে।
চট্টগ্রাম বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের সাহায্যার্থে ওই দিনই ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি রামগড়ের উদ্দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সভায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সেনা সদস্যদের বিদ্রোহকে আইনানুগ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সীমান্ত অতিক্রমকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়।
সভায় আলোচ্য বিষয়গুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনার জন্য ১০ এপ্রিল একই স্থানে পরবর্তী সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগে। তাই নিকটাতীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদাহরণ বিশ্লেষণ করে সভার লিখিত আকারে কোনো সিদ্ধান্ত সংরক্ষণ করা হয়নি। মৌখিকভাবে বাহিনীর সংগঠন, নেতৃত্ব ও যুদ্ধ পরিচালনার যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পায়। ১১ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণে ওই সভার সিদ্ধান্তের কিছু অংশ উচ্চারিত হয়েছিল। পরে এই সভার সিদ্ধান্তগুলোকে পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংশোধন, সংযোজনের মাধ্যমে আরো সময়োপযোগী করে তোলা হয়। এ সভা বাংলাদেশ বাহিনীর সাংগঠনিক ধারণা দেয় এবং তা মুক্তিবাহিনী পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
ওই বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশকে স্বাধীন করার শপথবাক্যও সবাইকে পাঠ করান তিনি।
৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধটিকে সমম্বিত অ্যাকশনে রূপ দেয়া এবং কমান্ড চ্যানেলে আনার লক্ষ্যে এ দিন পুরো দেশটিকে চারটির স্থলে ছয়টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন দু’টি সামরিক অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে। বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নাজমুল হককে। ছয়টি অঞ্চলের কমান্ডারদেরকে তাদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদেরকে একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমম্বিত অ্যাকশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।
সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিরা জানান, এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করেছে। এদের জন্য ইতোমধ্যেই অস্থায়ীভাবে বেশ কিছু ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে। শরণার্থীদের জন্যও ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিএসএফের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের বিষয়টিও ওই দিনের আলোচনায় ছিল। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে অনুষ্ঠিত সেই সভা দু’টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে কেবল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রথম সমন্বয় সভাই নয়; বরং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ভিত রচনা করে।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছাড়া ইন্ডিয়ার পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা এত সহজসাধ্য কখনো হতো না। দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে একসময় ধৈর্যহারা হয়ে যেকোনো পক্ষ রণেভঙ্গ হয়ে পিছপা হতো এবং জাতি হিসেবে আমরা কোন অবস্থায় থাকতাম তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানবেন।
তাই হে আমাদের অগ্রজ দুঃসাহসী, নির্ভীক, নিখাঁদ দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তারা! অজস্র শ্রদ্ধা, সম্মান, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তোমাদের প্রতি। তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত দূরদর্শী ও দ্রুত সিদ্ধান্ত দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লেখক : সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা