ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৮
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীশিক্ষার্থীরা যৌননিপীড়নের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, চক্ষুলজ্জা ও সামাজিক কারণে অনেকে ঘটনা চেপে যাচ্ছেন। অনেকে পড়ালেখা ছেড়ে দিচ্ছেন। তারা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন সহপাঠী বা শিক্ষকদের হাতে।
অভিযোগ করেও ন্যায়বিচার মিলছে না। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ছাত্র-শিক্ষক-প্রক্টর-ডিন সবাই দলীয় কর্মী। তাদের পক্ষে অভিযোগকারী নারীশিক্ষার্থীর নিরাপত্তা বিধান করা অসম্ভব। নেত্রীদের হাতে র্যাগিংয়ের শিকার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলপরীর কথা এখনো আমরা ভুলে যাইনি। দেশব্যাপী প্রতিবাদের মুখে তারা শাস্তি পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো ধর্ষণের ঘটনায় ধিক্কার কুড়িয়েছে অনেক আগে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহত্যা ও ফারজানা মিমের প্রতিবাদের কারণে বিষয়টি সাধারণ নাগরিকের নজরে এসেছে। প্রকাশ পাচ্ছে নির্যাতনের খণ্ডচিত্র। প্রকৃত অবস্থা আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রী কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। নারীদের জন্য আরো বেশি অনিরাপদ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার।
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বেসরকারি আইনি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত ‘যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা : বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় একটি গবেষণার ফলে বলা হয়- আদালতের নির্দেশনার পরও সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি না হওয়া দুঃখজনক। গবেষণায় বলা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৭৬ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিক্যাল কলেজে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৪ শতাংশ ছাত্রী। এ ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ নারীশিক্ষার্থী। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অশালীন, মন্তব্যের মাধ্যমে ৫৭ শতাংশ নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫০ শতাংশের বেশি নারী অনলাইনে সহিংসতার শিকার হন। জরিপ অনুযায়ী, নিজ শ্রেণীর নয়, অন্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ ছাত্রী হয়রানির শিকার হন। আর ছেলে সহপাঠীদের মাধ্যমে ২৫ শতাংশ ছাত্রী হয়রানির শিকার হন। ক্লাস চলাকালীন, ক্লাস না থাকার সময়, করিডোর, খেলার মাঠ প্রভৃতি স্থানে হয়রানির ঘটনা ঘটে। (নয়া দিগন্ত, ২৫ মার্চ, ২০২৪)
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও হেনস্তার ঘটনায় দুই শিক্ষককে বহিষ্কার করার রেশ কাটতে না কাটতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারীশিক্ষার্থীকে কুপ্রস্তাব দেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও একজন শিক্ষকের যৌন হয়রানির কারণে উত্তাল হয়। তদন্ত শেষে ওই শিক্ষককে চাকরি থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়।
অ্যাটেনডেন্ট, ভাইভা, প্রাকটিক্যাল, অ্যাসাইনমেন্ট, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, প্রেজেন্টেশন, থিসিস প্রভৃতি ক্যাটাগরিতে ৫০ থেকে ১০০ নম্বর শিক্ষকের হাতে থাকে। এটি এক শ্রেণীর শিক্ষকের অস্ত্র। এ অস্ত্র প্রয়োগ করে লোভাতুর শিক্ষকরা ছাত্রীদের নিশানা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘যৌন হয়রানির জন্য অভিযুক্ত শিক্ষক যদি সরকারপন্থী হন, তাহলে তাকে কখনো কখনো নানা কৌশলে রেহাই দেয়া হয় বা মৃদু শাস্তি দেয়া হয়। তাদের কেউ সরকারি আনুকূল্যে বড় পদে নিয়োগ পান, এমনকি এই ঘটনাও ঘটে। চাকরিচ্যুতির মতো বড় শাস্তি প্রদান করা হয় কেবল ভিন্নমতের শিক্ষক হলে।
অভিযুক্তজন সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী হলেও অপরাধটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়, এতে নেতার সাথে কখনো সহযোগী হন শিক্ষকও। (প্রথম আলো, ২২ মার্চ-২০২৪)
এ কথার জ্বলন্ত প্রমাণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারজানা মিম। যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষক এবং নির্মাতা আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে এবং তার দুই বছর পরে ২০২১ সালে ফারজানা মিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ দাখিল করেন। লিখিত অভিযোগ গ্রহণের পর তিনি অভিযোগকারীর ক্লাসের কোনো কিছুর সাথে যুক্ত থাকতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়াও মিম ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘যৌন হয়রানির বিচার চাই’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে একাই দাঁড়িয়েছিলেন। ফারজানা মিম বলেন, আবু শাহেদ ইমন আমার বিভাগের লেকচারার। তিনি সিনেমা নির্মাণ করেন। তিনি আমাকে কাজের জন্য অফিসরুমে ডেকে নিয়ে হেনস্তা করেন। এ নিয়ে আমি অনেক দিন ভুগেছি। আমার বাবাকে বলা হয়েছে, আপনার মেয়েকে বহিষ্কার করব। কয়েক দফা রিপোর্ট আসা সত্ত্বেও আবু শাহেদ ইমন এবং তাকে সাহায্যকারী বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনাইদ হালিম তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আসার পরও সুপ্রিম কোর্টে রিট করেছেন।
ফারজানা মিম আরো বলেন, এমন অনেক ঘটনা ঘটে কিন্তু হয়রানির শিকার হয়েও বেশির ভাগ মেয়ে চুপ থাকে। কারণ, তারা দেখেছে অভিযোগ করলে আমার মতো জীবন পাবে। প্রথমে একাডেমিক জীবন বরবাদ, তারপর সহপাঠীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, শিক্ষকরা এক হয়ে আমার বিরুদ্ধে নেমেছিলেন। ইমন আমার গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত গেছে। আমার বাবা-মা অসুস্থ, তাদের চাপ দিয়েছে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে। অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় আমাকে বিভাগের রুমে দরজা আটকে জোরজবরদস্তি করা হয়েছে। আমাকে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করানো হয়। আমি অনার্স শেষ করতে পারিনি।
অভিযোগকারী ফারজানা মিম জানান, অভিযুক্ত শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের নারাজির ভিত্তিতে একাধিকবার তদন্ত কমিটি পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে দীর্ঘ দিনেও তিনি বিচার পাননি; বরং বিভিন্নভাবে তাকে হয়রানি করা হয়েছে। সহপাঠীরাও ভয়ে পাশে নেই তার। মানসিক যন্ত্রণায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন শিক্ষাজীবন থেকেও। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি যৌন হয়রানির প্রমাণ পেয়েছে এবং এর ভিত্তিতে সিন্ডিকেট কী ব্যবস্থা নেবে সেই প্রক্রিয়া চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষক ‘ন্যায়বিচার পাবেন না’ শঙ্কা করে আবেদন করেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, আমি আসার আগের কোনো ঘটনার দায়ভার আমি নেবো না। তবে আমি এখন সেগুলো নিয়ে সোচ্চার হবো। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় এসব বিষয় উত্থাপিত হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। (ইনকিলাব, ২৪ মার্চ-২০২৪; প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১৮ মার্চ-২০২৪)
হয়রানি প্রতিরোধ সেলের তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্ত ছাত্র-শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের ব্যবস্থা করা গেলে যৌন হয়রানি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতে পারে। ১৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে করতে হবে নারীশিক্ষার্থীদের পরিবেশবান্ধব। অন্যথায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও খ্যাতি ধুলোয় মিশে যাবে।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা