২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব

স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব - নয়া দিগন্ত

যুদ্ধ বিষয়টি মামুলি কোনো ব্যাপার নয়, কিংবা হাতে তৈরি মুড়ির মোয়াও নয়। এটি জীবন-মরণের খেলা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সেনাবাহিনী সদর দফতরের কার্যক্রম ও যুদ্ধপ্রস্তুতি দেখে সামরিক বাহিনীর কমান্ড স্তরের সব বাঙালি অফিসার বুঝতে পারছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি সামরিক ক্র্যাকডাউন অত্যাসন্ন। তা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাসদর থেকে বাঙালি জেনারেল খাজা ওয়াসি উদ্দিন কিছু কিছু সংবেদনশীল তথ্য শেয়ার করছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি সিনিয়র অফিসারদের সাথে।

বিশেষ করে চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার তথা ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের (ইবিআরসি) কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার মাসুদুর রহমান মজুমদার (এম আর মজুমদার) পদাধিকার বলে মার্চ মাসের গোড়ার দিকে সেনাসদরের অপারেশন শাখার একটি ‘অতি গোপনীয়’ চিঠি পেয়ে যান। যাতে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের পরিকল্পনার উল্লেখ ছিল।

আসন্ন এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের নিজ জন্মভূমির প্রতি গভীর মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ফলে তিনি তার বিশ্বস্ত সহকর্মীর সাথে আলাপ করে সীমিত সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানিকে অতি সহজেই বন্দী করে দেশকে স্বাধীন করার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, যার ছদ্মনাম দেন ‘লাল ফিতা উড়িয়ে দাও’।

এ গোপন পরিকল্পনা তিনি কর্নেল ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে শেয়ার করেন। কিন্তু তিনি সে সময় এ অপারেশনে সায় দেননি। কেননা, তিনি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আলোচনাকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের এবং সঙ্কট সুরাহার একমাত্র পথ হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। আর তার এই মনোভাবের বিষয়টি বোঝা যায় সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের উত্তরে তার বক্তব্যের মাধ্যমে। প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির-পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর এক ঘণ্টা ১৫ মিনিটের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনার যদি অগ্রগতি না হতো তাহলে কেন আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি?’ এ বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা জাতীয় পরিষদে যোগ দিতে পারি না।’

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারি বিল্ডআপ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, জুনিয়র কমিশনড অফিসার, নন-কমিশনড অফিসার ও অসংখ্য সৈনিকের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, দেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন এক সময় অত্যাসন্ন। তাই কালবিলম্ব না করে জেনারেল ইশফাকুল মাজিদ ও কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে তারা ঐক্যবদ্ধ হলেন।

২২ মার্চ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে সমবেত হন সাবেক সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সেনারা। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। এখানে তারা স্বাধীনতার পক্ষে প্রয়োজনে যুদ্ধ করে জীবন উৎসর্গ করার শপথ গ্রহণ করেন। তাদের শপথবাক্য পাঠ করান কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী। জেনারেল ইশফাকুল মাজিদ শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ ছিলেন। সভা শেষে বিশাল সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের নিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বর থেকে সামরিক কায়দায় মার্চ পাস্ট করে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং ধানমন্ডিতে গিয়ে পৌঁছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতির কথা জানিয়ে জেনারেল মাজিদ ও কর্নেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে একটি তলোয়ার উপহার দেন।

বায়তুল মোকাররমের অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের বিশাল সমাবেশে সামরিক নেতাদের জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে উপস্থিত সবাই তো বটেই, সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে তীব্র উজ্জীবনী শক্তি ও সাহস সঞ্চারিত হয়। কেননা, যুদ্ধের জন্য সামরিক বাহিনীর বিকল্প নেই।
সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এ সমাবেশের খবর ও দেশমুক্ত করার আহ্বানের সংবাদ জেনে দেশে অবস্থিত চাকরিরত সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), মুজাহিদ, পুলিশ, বিশেষ করে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন ও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সব বাঙালি সদস্য উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হন। মার্চপাস্ট করে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর হাতে যুদ্ধের তরবারি হস্তান্তর করার ফলে বঙ্গবন্ধুও সামরিক বাহিনীর অভূতপূর্ব সাহসী ভূমিকায় ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত হন- এতে কোনো সন্দেহ নেই।

অপরদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীরও পিলে চমকে যায় এ সমাবেশ ও মার্চ পাস্ট দেখে। তারা আগেই জেনারেল ইশফাকুল মাজিদ ও কর্নেল এম এ জি ওসমানীর একরোখা দেশপ্রেম সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। এতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। দেশবাসী ও রাজনীতিবিদরা সামরিক বাহিনীর এ দুঃসাহসী ভূমিকায় বুকে আশা সঞ্চার করেন ও উদ্বেলিত হন।

সুতরাং স্বাধীনতাযুদ্ধ ও এর সাথে সামরিক বাহিনীর অনন্যসাধারণ দুঃসাহসী ভূমিকা সম্পর্কে এবং সামরিক বাহিনীর অবদানের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না, বা জেনেও যারা অস্বীকার করেন, তারা আমার এ লেখার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করি।


আরো সংবাদ



premium cement