সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব কাদের হাতে
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ২৪ মার্চ ২০২৪, ০৪:৫৯
দেশে অনেক প্রবাদ প্রবচনের প্রচলন অনেক কাল থেকেই আছে। সেসব প্রবাদ কেউ হাস্যরস সৃষ্টির জন্য বলেন, কেউ আবার বিদ্যমান বাস্তবতার উপমা সাদৃশ্য হিসাবে ব্যবহার করেন। এসবের মধ্যে অনেক বার্তাও খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন শিয়ালের কাছে মুরগি বাগী দেয়া (অর্থাৎ মুরগির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শিয়ালের কাছে অর্পণ করা), আবার এমন কথা আছে কুমিরের কাছে শেয়াল ছানার দেখভালের দায়িত্ব দেয়া। এসবের পরিণতি কী সেটা সহজেই বোঝা যায়। এমন সব হাস্যরসাত্মক বাক্য বচনের মধ্যে বহু ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নেপথ্য থেকে প্রকাশ্যে আসে। যেমন খলনায়ক, দুরাচারী ব্যক্তির চরিত্র উঠে আসে উপমার আবরণে। সমাজের অনেক অবক্ষয়ের ইঙ্গিতও এতে পাওয়া যায়। এমনই উপমার একটা সাজুয্য পাঠক বক্ষ্যমান নিবন্ধটি নিয়ে আরো একটু অগ্রসর হলেই সেটা খুঁজে পেতে পারেন। আর আকলমন্দের জন্য ইশারাই কাফি।
সব অবিভাবকই সন্তানের নিরাপদ ও সুষ্ঠু শিক্ষালাভের জন্য আগে তাদের গুরুগৃহে পাঠাতেন, অধুনা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য তাদের প্রচুর ব্যয় ও দায় কাঁধে নিতে হয়। অভিভাবকদের আশা বিশ্বাস থাকে তাদের সন্তান-সন্ততি বিদ্যাভ্যাস শেষে সুশীল, সুশিক্ষিত, পুতচারিত্র নিয়ে ঘরে ফিরবে। সেখানে শুধু প্রচলিত শিক্ষাই নয় সদগুণ পুতচরিত্র, সৌজন্য, সহমর্মিতা এবং মহৎ সব গুণাবলির অধিকারী হয়ে হাজারে একজন হয়ে উঠবে। সব শিক্ষক না হোক অধিকাংশ শিক্ষকের কাছ থেকে ওই সব গুণাবলি শিক্ষার্থীরা অর্জন করবে এটাই ধরে নেয়া হয়। অনেকেই আবার বলেন চাঁদেও কলঙ্ক আছে, মানুষ কোন ছার। কিন্তু সবাই মনে করেন, শিক্ষকরা হবেন ব্যতিক্রম। কিন্তু বাস্তবে কি তাই! আজকাল ছিটেফোঁটা নয়, নিয়তই এমন বহু খবর আসছে যে, কিছু শিক্ষক দুরাচার দুষ্কর্মের সাথে জড়িত। এসব খবর সমাজকে স্তম্ভিত করছে বার বার। এসব খবর পড়ে চক্ষু কুঞ্চিত হয়, কানে গুঁজতে হয় তুলা। অথচ এটাই অভিভাবকগণ নিশ্চয়ই ভেবে থাকেন নিচ থেকে সর্বোচ্চ পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নির্বিশেষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য অভয়ারণ্যেরই মতো। সেখানে ভয় ডরহীন এক অনাবিল পরিবেশে বিদ্যার্থীদের সুশিক্ষা লাভের সুযোগ থাকবে। সেখানে পিতৃ-মাতৃস্নেহে শিক্ষকমণ্ডলী তাদের সর্বক্ষণ অভয় আশ্রয় দেবেন। এমন বিশ্বাস আস্থার স্থানটা বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যাওয়ার পথে নয় কি! অবিভাবকগণ এখন যদি অভয়ারণ্যের পরিবর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনিরাপদ ও বিপন্ন অঞ্চল বলে মনে করতে শুরু করেন তবে সেটা কি খুব ভুল ভাবনা হবে? রক্ষক তো এখন ভক্ষকের রূপ ধারণ করেছে।
মাত্র ক’দিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ও ছাত্রের যোগসাজশে এক নিরীহ ছাত্রী বাধ্য হয়েছে আত্মহননের পথ বেছে নিতে। সেই হতভাগিনী মৃত্যুর পথ বেছে নেয়ার আগে লিখে গেছে যে, তাকে আত্মহননের পথ ধরতে বাধ্য করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তার এক সহপাঠী। আর সেই ‘কুসন্তানের’ আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা ছিলেন সেই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের জনৈক ‘শিক্ষক’। ছাত্রীটি গভীর অনুতাপ প্রকাশ করে লিপিবদ্ধ করে গেছে তার গভীর শোক ও ক্ষোভের কথা। সেই সহপাঠী তাকে নিয়তই যৌন হয়রানি করে তার জীবন বিষিয়ে তুলেছিল। জীবনের প্রতি তার সব আকর্ষণ মমতা নিঃশেষ করে দিয়েছিল ক্ষমতাধর ওই সহপাঠী। এমন জ্বালা যন্ত্রণার অবসান করতেই অপরিসীম বেদনা বুকে নিয়ে জীবন দিয়ে গেল ছাত্রীটি। এই অভিমানী কন্যার পাশে দাঁড়ানোর কেউ তখন ছিল না। আর তারই বর্ণনা ছিল জগতের প্রতি তার শেষ চিঠিতে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত ছাত্রের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছে আরো অনেক অবলা শিক্ষার্থী।
এরপর ময়মনসিংহের কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অভিন্ন এক কাহিনী রচিত হয়েছে। এখানে খলনায়ক হচ্ছেন শিক্ষকের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা বিকৃত এক যৌনাচারী। বিকৃত যৌনাচারী তথাকথিত সেই ‘শিক্ষক’-এর বিরুদ্ধে একজন নয়, প্রায় ত্রিশজন ছাত্রী একই অভিযোগ তুলেছেন। তারা সবাই জানিয়েছেন তাদের কাছে সেই বিকৃত যৌনাচারী তার লালসার কথা শুধু তাদের কাছে প্রকাশ করেনি। তাদের ওপর মানসিক চাপ আর অশান্তি সৃষ্টি করেছে হরদম। তথাকথিত সেই শিক্ষকের ঊর্ধ্বতনদের কাছে প্রতিকার চাইলেও কোনো আশ্বাস অভয় তাদের দেয়া হয়নি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয়। আরো খবর হয়েছে সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজের আরো এক শিক্ষক, যাকে শিক্ষক নয় বরং মাস্তান বলে সম্বোধন করাই শ্রেয় হবে। সেই শিক্ষকরূপী মাস্তান পিস্তল নিয়ে ছাত্রদের তাড়িয়ে বেড়াতেন। তিনি ছাত্রকে গুলি পর্যন্ত করেছেন। দুর্ভাগ্য জাতির, আজ বহু শিক্ষক তাদের পদ-পদবি নিয়ে দুরাচার দুষ্কর্মে লিপ্ত। ক্ষমতার উষ্ণ পরশের ছোঁয়া পেয়েই তারা এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। দুঃখ হয়, সেই সব শিক্ষকের জন্য যারা সত্যিই জ্ঞান সাধনায় নিমগ্ন, যারা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে নিবেদিতপ্রাণ। তাদের পরশে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে বিদগ্ধ পুতপবিত্র। সেইসব বরণীয় শিক্ষকরা এখন সমাজে কেমন করে মুখ দেখাবেন, কথা বলবেন! কেননা তাদের আশপাশেই রয়েছে ওই সব তথাকথিত পদবিধারী দুরাচারী ‘শিক্ষক’। সাধারণরা কী করে জানবেন কে জ্ঞান তাপস, কার জ্ঞানচ্ছটায় আলোকিত হচ্ছে বহু শিক্ষার্থী! অন্যদিকে রয়েছেন শিক্ষক নামধারী কুশিক্ষার ধারকবাহক। জ্ঞানীজন আর পদ-পদবিধারী অজ্ঞানীদের কি এক পাল্লায় তোলার কোনো অবকাশ আছে? বিবেচনাবোধ তা বলে না। কিন্তু আজকের বিচার হয় অন্যভাবে। কারা আমাদের আপনজন, কারা নয়।
আমরা বহু কিছুই করতে পারিনি। সব চেয়ে বড় একটা বিষয় নিয়ে কিছু করা দূরের কথা। আমরা ভাবারও সময় পাইনি। জ্ঞান নীতি নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অনুশীলন করার সময় আমাদের হয়নি। অথচ শুদ্ধাচারের অন্যতম বিষয় ওই সব। সুস্থ সমাজ গঠনের এসব হচ্ছে মৌলিক পাঠ। আর শুদ্ধাচারের ভিত্তি যে সমাজে থাকে না তার উদাহরণ হচ্ছে- ভরা গাঙ্গে ঢেউয়ের তোড়ে দিগি¦দিকশূন্য হয়ে হালভাঙ্গা তরির মতো কেবল ঘুরপাক খাওয়া। স্রোত তাকে যে দিকে নিয়ে যায় সে দিকেই ভেসে যায় হালভাঙ্গা তরী। তার কোনো লক্ষ্য থাকে না। আজ আমাদের সমাজের অবস্থাটা ঠিক সেই হালভাঙ্গা তরীর মতো।
মূল্যবোধের ধারণা থেকে যারা দূরে অবস্থান করেন, তাদের চিন্তাচেতনাকে অবশ্যই ভিন্ন কিছু আচ্ছন্ন করে রাখে। তারা প্রকৃত অর্থে একটা বদ্ধকূপের নিছক ব্যঙ্গাচি। তারা নিজেদের কখনো বদলানোর কথা ভাবেন না। সে কারণে আর কাউকে বদলানোর তাগিদও দেন না। প্রথাগত পথেই তারা চলতে অভ্যস্ত। তাই যারাই এ নিয়ে ভিন্ন কথা বা আত্মশুদ্ধি এবং দেশ দশের প্রয়োজনে বদলে যাওয়ার কথা বলেন তাদেরকে ‘নীতিভ্রষ্ট’ বলে গালাগাল দেয়। কোনো যুক্তিতর্কের পথ অনুসরণ নয় বা ন্যায় অন্যায়ের বিবেচনা বোধও নয়, নিছক পেশিশক্তিই তাদের বড় বল। আর সবাই হীনবল, অপাঙ্তেয়।
এবার দেখা যেতে পারে শিক্ষাঙ্গনের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের প্রতি যেভাবে যৌন হেনস্তা করা হচ্ছে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থা কতটা কী এবং তার কাজ কিভাবে চলছে। একটি জাতীয় দৈনিকে সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন অতিসম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘জাবির (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) মতো বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযুক্তরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগও করেন ভুক্তভোগীদের মধ্যে হয়তো দুয়েকজন মাত্র। দলীয় রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। তবে কখনো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদার হলেই কেবল ঘুম ভাঙে প্রশাসনের। নড়েচড়ে বসেন ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী’ নানা কমিটি।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত ছাত্রীদের সুরক্ষায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নারীকে প্রধান করে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। দেড় দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন নিপীড়ন ও নারী নির্যাতন ‘প্রতিরোধ সেল’ থাকলেও শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা মিলছে না। আরো জানা গেছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নবিরোধী সেল নিষ্ক্রিয়। যদিও ৪৫টি পাবলিক ও ৯৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অভিযোগ শোনার জন্য কমিটি রয়েছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের অনেকে জানেনই না যে এমন কমিটি রয়েছে। এর কারণ তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। জানা গেছে, গত দুই বছরে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জমা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, এর সংখ্যা ১৪টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা পড়েছে ৬টি। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নির্যাতনের বহু ঘটনা ঘটে চলেছে। বহু ছাত্রী লোক নিন্দা, লজ্জাসহ নানাবিধ কারণে কোনো অভিযোগ করেন না। তাদের সংখ্যা কিন্তু অগণন। অবশ্যই এ কথা কোনোভাবেই ভোলা চলবে না এসব নষ্টচরিত্রের তথাকথিত শিক্ষকের ক্ষমতার উৎস কিন্তু অনেক গভীরে এবং খুব পরিকল্পিতভাবেই এরা এসব অপকর্ম করে চলেছে। সময় এসেছে সব কিছু বোঝার এবং প্রতিকারে উদ্যোগী হবার। চোখ খুলতে হবে কান উঁচিয়ে রাখতে হবে।
আর দু’টি কথা, আজ পণ্ডিত জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবীরা কোন গুহায়! যারা পান থেকে চুন খসলেই বিবৃতির বন্যা বইয়ে দেন। এখন তাদের টুঁ শব্দটি নেই কেন। দ্বিতীয় কথা, এসব অপকর্মের দায় কার! যারা এসব অপকর্মের হোতা তারা নাকি ক্ষমতাধর। সেই ক্ষমতাধরদের নেপথ্যে থাকা কোন সে মদদগার।
ndigantababar@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা