বাংলাদেশে রুশ ছায়া
- রিন্টু আনোয়ার
- ২৩ মার্চ ২০২৪, ০৫:০৭
ক্ষমতা-নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে দেশে আর লজ্জাশরমের বালাই অবশিষ্ট নেই। লুকোচুরি কিছু নেই। কারো অভিযোগ বা স্বীকারে এখন আর কিছু যায় আসে না। নির্বাচনে কী হয়েছে কমবেশি সবার জানা। এরপরও কথায় কথায় ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে ফেলেছেন, ভারত পাশে না থাকলে এবারের নির্বাচন তুলে আনা যেত না। বড় বড় দেশগুলো যেভাবে চাপ তৈরি করছিল ভারত থাকাতে রক্ষা। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট-এনডিআই এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট-আইআরআই যৌথ কারিগরি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছে, এ নির্বাচনে কোনো কার্যকর প্রতিযোগিতা ছিল না। যা নির্বাচনের মান ক্ষুণ্ণ করেছে। এনডিআই এবং আইআরআইয়ের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইউ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিশন রিপোর্টে মানবাধিকার ও বিরোধী দলগুলোর প্রতি সরকারি দলের দমন-পীড়নে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সরকারি মহল এ সত্যে পাত্তা দিতে নারাজ। অনেকটা ড্যাম কেয়ার ভাব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এনডিআই-আইআরআই কী বলল তাতে কিছু যায় আসে না। তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সাফ কথা- ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী সংস্থার মতামতটি তাদের নয়, এটি বাংলাদেশের সুশীলসমাজের বক্তব্যের প্রতিফলন। প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, এর আগেও তারা যে রিপোর্ট করেছিল, সেখানে দেখেছি এ ধরনের কথা তারা নিজেরা বলে না। সিভিল সোসাইটির সাথে তাদের যে কথা হয়, তার একটি পরিভাষা ব্যবহার করে। তাদের বক্তব্যের প্রতিফলন হিসেবে এটি নিয়ে আসে। নিজেদের ফাইন্ডিংস হিসেবে তারা এ ধরনের বক্তব্য আনে না।’
নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার মনমর্জি আরো চড়া। নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থার মতামতের সাথে ভীষণ দ্বিমত তার। নির্বাচনের মান ‘কখনোই ক্ষুণ্ণ হয়নি’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি শতভাগ ভোটারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে নির্বাচনটি করতে।’ ভোটাররা নির্বাচনে ভোট দিতে পেরেছে। এটি সব পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। কোথাও দেখিনি কোনো ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেনি। ইসিসহ যারা নির্বাচনের আয়োজনের সাথে জড়িত ছিল সবাই খুবই আন্তরিকভাবে এবং সততা নিয়ে কাজ করেছে।’ তবে অতীতের তুলনায় এবারের নির্বাচনে সহিংসতা কম হয়েছে বলে এনডিআই ও আরআরআইয়ের দেয়া পর্যবেক্ষণ তার খুব মনে ধরেছে। এর কৃতিত্ব ইসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়েছেন বেগম রাশেদা।
অবস্থাদৃষ্টে কী চমৎকার প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ সরকারি মহলের একেক জনের। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও তার কয়েকটি মিত্র দেশ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপর বিরূপ মন্তব্য করেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি সংস্থার প্রতিবেদন নির্বাচনের বিষয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অল্প কথায় রিপোর্ট করেছে তারা। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এনডিআই ও আইআরআই রিপোর্টে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সে সময় মাঠের যেসব অনিয়মের চিত্র প্রকাশিত হয়েছিল সেসবের ‘পুরো চিত্র’ উঠে আসেনি। এরপরও যতটুকু এসেছে, তাই মানতে নারাজ সরকার। প্রতিবেদনে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনে সহিংসতার ঝুঁকি প্রশমন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আইআরআই ও এনডিআইয়ের তুলনামূলক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, সরকারের নির্বাহী ও আইন বিভাগ, রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ এবং অন্যান্য অংশীজনের কাছে সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এনডিআইয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মনপ্রিত সিং আনন্দের আশা প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতে আরো শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে একটি মূল্যবান রোডম্যাপ হিসেবে অবদান রাখবে।
অশান্তি স্বীকার করলে না ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ কিছুর আশা। অরাজকতা স্বীকার করলে না সামনে সুশাসনের অপেক্ষা। এর মধ্যে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর এমন সুষ্ঠু নির্বাচন আর হয়নি।
অতীত তথ্য বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে একটি মডেল দেখেছে জনগণ। ওই নির্বাচনে ২৯৩ আসনে জয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ব্যালটবাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ওই মডেল ভোটের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের যাত্রাকালেই নজির হয়ে থাকে। কিন্তু, সমালোচনা কখনো সহ্য করতে চান না আওয়ামী লীগ নেতারা। এবারো তাই। এনডিআই, আইআরআই- কে কী বলল তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবাই মন-মননে এমন ধারণা পোষণ করেন এবং সাধারণ জনগণকেও তারা সেটি গেলাতে-বোঝাতে হেন চেষ্টা নেই যা করছেন না। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে ‘ভারত আছে, সব আছে’-এ কথা খোলাসা করা হয়েছে আরো আগে। কেবল ভারত কেন বর্তমান নানা রসদে চীনও আছে। রাশিয়া তো আছেই। সেখানেও নির্বাচন আছে, হোমমেইড বিরোধীদলও আছে।
গোটা দুনিয়ার সমালোচনা তুড়ি মেরে ক্ষমতার লালঘোড়া দাবড়ে চলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি তিনি আরো অন্তত ছয় বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেছেন। সমালোচনা গায়ে মাখেন না তিনি। তার এ ছয় বছরের শাসনামল পশ্চিমা অনেক দেশের জন্য উদ্বেগজনক হলেও চীনসহ কয়েকটি দেশের জন্য সুসংবাদ এবং স্বস্তির। বিশ্বের কয়েকটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ আরোপিত ১৬ হাজার নিষেধাজ্ঞাও পুতিনকে কথা শোনাতে পারেনি। আবারো পুতিন তার স্টাইলের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধানোর হুমকি দিয়েছেন। পুতিনের জয় পশ্চিমা দেশগুলোর নেতাদের আরো একবার মনে করিয়ে দিয়েছে রাশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নেতার নিরবচ্ছিন্ন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক গণতান্ত্রিক দেশ নির্বাচনের সমালোচনা করেছে। ইরান, ভারত, উত্তর কোরিয়া, চীনসহ আরো কয়েকটি দেশের নেতা রাশিয়ার নির্বাচনে পুতিনের জয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এসব দেশ পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা মেনে নিতে চায় না। পুতিনের জয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, তার পুনর্নির্বাচন রাশিয়ার জনগণের পূর্ণ সমর্থনের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। শি জিনপিং দুই বছর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের শুরু থেকে পুতিনের পাশে আছেন। তিনি দু’দেশের পূর্বঘোষিত ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে কখনো সরে আসেননি। পুতিনের জয়ে বরং জিনপিং দুই দেশের সম্পর্ক আরো টেকসই ও গভীর করার অঙ্গীকার করেছেন। চীন এবং রাশিয়া যদি একত্রে চলতে থাকে তাহলে একে মোকাবেলা করতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা কী পদক্ষেপ নেয় তা এখন দেখার বিষয়।
এটি এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি অস্ত্র, তহবিল ও সমর্থনে কেঁদে বেড়াচ্ছেন। অপরদিকে, ভ্লাদিমির পুতিন তখন ভবিষ্যতে তার উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। এটি তার গণতন্ত্র। বাংলাদেশেও সম্প্রতি খুব বেশি বেশি বলা হচ্ছে, গণতন্ত্র একটি আপেক্ষিক বিষয়। তা একেক দেশে একেক রকম। মানে ভারত-রাশিয়া, হালের বাংলাদেশ সবখানে নিজস্ব রীতির গণতন্ত্র চলবে। উত্তর কোরিয়া বাদ থাকবে কেন? সেখানেও উৎসবমুখর ভোট আছে। উত্তর কোরিয়ায় অল্প খরচে সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়। হানাহানি হয় না। কারচুপি-জালিয়াতির প্রশ্ন ওঠে না। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিম পরিবারের বংশপরম্পরায় শাসন করা দেশটিতে ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি অবাধে, অংশগ্রহণমূলকভাবে আনুগত্য দেখায়। সেখানকার জনগণ, প্রশাসনসহ সব মহল এতে অভ্যস্ত। পাঁচ বছর পরপর সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সুশৃঙ্খলভাবে তারা ভোট দেয়। ভোরের আলো ফোটার আগে ভোটকেন্দ্রে চলে যায়। দাঁড়িয়ে যায় বিশাল লম্বা লাইনে। ভোট দিয়ে চলে যায় না। কেন্দ্রের সামনে সবাই মিলে আনন্দ করে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে বলে স্লোগান দেয়। ধন্য ধন্য হয়ে বিজয় উৎসবে শরিক হয়। কিম সেভাবে অভ্যস্ত করে তুলতে পেরেছেন তার দেশের মানুষকে।
তিনি শুধু তার ক্ষমতা ধরে রাখতে চান তা-ই না, একই সাথে তার দানবীয় ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাও চালু রাখতে চান। তিনি তার দেশের ২৬ মিলিয়ন লোককে নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন। মানবাধিকার কর্মী ব্র্যড অ্যাডামসের মন্তব্য হচ্ছে, ‘উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতিকে তলাবিহীন গভীর কূপের সাথে তুলনা করা যায়।’
এদিকে একদলীয় শাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশও উত্তর কোরিয়ার পথে হাঁটছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। বাংলাদেশে এখন উত্তর কোরিয়ার মতো একদলীয় শাসন চলছে অভিযোগ করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, এটি একটি একদলীয় দেশ শুধু নয়, নিষ্ঠুর একদলীয় দেশ, এখানে সেই রকম একদলীয় শাসন চলছে। উত্তর কোরিয়ার সাথে বাংলাদেশের এখন আর কোনো পার্থক্য নেই, একাকার হয়ে গেছে।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা