২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
দেশ জাতি রাষ্ট্র

জলদস্যু বনাম রাষ্ট্রদস্যু

জলদস্যু বনাম রাষ্ট্রদস্যু - নয়া দিগন্ত

দস্যুতা কোনো ন্যায়সঙ্গত বিষয় নয়, তা জলে, স্থলে অথবা আকাশে যেখানেই হোক। তবে রাষ্ট্র যখন দস্যুতা অবলম্বন করে, তা ন্যায়সঙ্গত বলা হয়। দস্যুতা মানে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অধিকার লঙ্ঘন করা। রাষ্ট্র যখন শক্তি প্রয়োগ করে তখন ন্যায়ের পরিচ্ছদ পরিয়ে দেয়া হয়, এই কারণে যে নাগরিকসাধারণ রাষ্ট্রকে শক্তি প্রয়োগের ন্যায়সঙ্গত অধিকার দিয়েছে। কিন্তু জলদস্যুর মতো রাষ্ট্রদস্যু যখন ন্যায়ের সীমা অতিক্রম করে তা কি করে ন্যায়ের সংজ্ঞা ধারণ করতে পারে?

পৃথিবীতে একসময়ে নীতি ছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’। যখন থেকে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ ও লালন হয়েছে তখন থেকে শক্তি প্রয়োগের সীমারেখা নির্ধারিত হয়েছে। শক্তি প্রয়োগের বদলে ন্যায়নীতি, কূটনীতি এমনকি সমরনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে জেনেভা কনভেনশন-এর মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সমঝোতা দ্বারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ প্রমাণ করছে ‘ন্যায় হলো শক্তিমানের স্বার্থ’। মনীষী প্লেটো সেই কবে হাজার হাজার বছর আগে এ কথা বলে গেছেন। বিস্ময়করভাবে হলেও সত্য যে, সভ্যতার এই পাদপ্রান্তে দাঁড়িয়েও আমরা সেই অন্যায় উক্তির প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।

এসব তত্ত্বকথা মনে এলো সোমালীয় জলদস্যুদের বাংলাদেশী জাহাজ হাইজ্যাকের প্রেক্ষাপটে। সংবাদমাধ্যম এখন জলদস্যুদের ইতিহাস-ভূগোল তরতালাশ করছে। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে জলদস্যুতার উৎসমূল রাষ্ট্রদস্যুতা। আবার একই সময়ে প্রায় একই জায়গায় একক বিশ্বশক্তি হাজার হাজার মাইল দূরত্বে এসে শক্তি প্রয়োগের মদমত্ততা দেখাচ্ছে। ওই একই যুক্তি-জাতীয় নিরাপত্তা, বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সুবিধা, শান্তি সমুদ্রসীমার অধিকার ও নৌপরিবহনের নিশ্চয়তা ইত্যাদি। এসব স্ব-ঘোষিত দায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে গোটা পৃথিবীকে চারণভূমি বানিয়েছে তারা। তারা ন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। অন্যায়কে ন্যায়রূপে প্রতিভাত করে।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুদের দ্বারা হাইজ্যাক হয়েছে। সোমালীয় জলদস্যুরা এই কাণ্ড ঘটায়। ভূগোল সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা নিশ্চয়ই জানেন যে পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত জলপথ বাবেল মান্ডেল প্রণালীর পশ্চিমপ্রান্তে সোমালিয়ার অবস্থান। ইয়েমেন এবং সোমালিয়ার দূরত্ব সর্বশেষ প্রান্তে মাত্র ১৮ মাইল। লোহিত সাগর যেখানে ভারত মহাসাগরে মিশে গেছে, সেখানেই বাবেল মান্ডেল। পৃথিবীর যে দশটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত জলপথের কথা মানুষ জানে, বাবেল মান্ডেল প্রণালী তার অন্যতম। এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইউরোপগামী জাহাজসমূহ এই পথেই অগ্রসর হয়ে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে। এ ধরনের জলপথসমূহ আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা দ্বারা সবার জন্য উন্মুক্ত। ছোট বড় সব রাষ্ট্রের সম-অধিকার আন্তর্জাতিক জলসীমায়। বাবেল মান্ডেল প্রণালীও সেদিক থেকে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর এই অংশের নীল জলসীমা কালো থাবার কবলে পড়েছে। এই কালো থাবার দুটো দিক-একদিকে গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত দারিদ্র্যপীড়িত সোমালীয় জলদস্যুদের উৎপাত, অপরদিকে মার্কিন ও ন্যাটো সমর্থনপুষ্ট বাহিনীর আক্রমণ।

প্রথমেই সোমালীয় প্রেক্ষাপটটি ব্যাখ্যা করা যাক। কিভাবে রাষ্ট্রদস্যু জনগণের একাংশকে জলদস্যুতে পরিণত করেছে- তা দেখা যাক। আফ্রিকার সর্ব পূর্বের ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ বা আফ্রিকার শিং বলে পরিচিত অঞ্চল এটি। পৃথিবীর আর সব সাধারণ রাষ্ট্রের মতো এটিও ছিল সহজ, সরল, স্বাভাবিক। অতীতের সমৃদ্ধ ইতিহাসও রয়েছে সোমালিয়ার কিন্তু নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা করলে আর কোনো উপায় থাকে না। সোমালিয়া ছিল ইতালিয়ানদের দখলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা এর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে। ১৯৬০ সালে দেশটি স্বাধীন হয়। সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এক দশক যেতে না যেতেই সাইদ বারির নেতৃত্বে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৬৯ সালে। সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত হয় ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৬ সাল থেকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন অবশেষে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সোমালিয়া যদি আজকে জলদস্যুর দেশ বলে পরিচিত হয়ে থাকে তাহলে সাইদ বারির মতো রাষ্ট্রদস্যুরা এর জন্য দায়ী নয় কি? গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে শতধাবিভক্ত হয়েছে সোমালীয় জাতি।

উপকূলীয় অঞ্চলের গোত্রগুলো তাদের যুদ্ধব্যয় মেটানোর জন্য সমুদ্রে দস্যুতা শুরু করে। এর আগে ইউরোপীয় জাহাজগুলো দুর্বল সোমালিয়ার সমুদ্র উপকূল থেকে মাছ ধরত। শুধু তাই নয়, তারা সেখানে বর্জ্য ফেলত। একদিকে ইউরোপীয়দের প্রতারণা অপরদিকে যুদ্ধব্যয় মেটানো- এই দুটো কারণে জলদস্যুতা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। প্রাথমিক পর্যায়ে উপকূলবাসী ট্রলার এবং স্পিডবোট ব্যবহার করে ডাকাতি করত। পরবর্তীকালে তারা অস্ত্রশস্ত্রে আধুনিক হয়ে ওঠে। জলদস্যুতা রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করে। এই জলদস্যুদের সাথে সোমালীয় কোস্টগার্ড এবং সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন অংশের সমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হয়। জলদস্যুতা ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়। তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায় ভারত মহাসাগর পর্য়ন্ত। এই দস্যুতা থেকে তারা প্রচুর সম্পদ উপার্জন করে।

জলদস্যুতা যে অপরাধ এই বোধই তাদের একরকম লোপ পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রিত সমুদ্রবন্দরও রয়েছে। ইয়েল নামের প্রাচীন শহরটি এখন জলদস্যুদের রাজধানী বলে পরিচিত। সমগ্র সোমালিয়ার অবস্থা এক নয়। উত্তর অংশ কিছুটা উর্বর ও নিরাপদ। অপরদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি অনেকটা পাথুরে এবং কৃষিকাজের জন্য অনুর্বর। সমুদ্রসীমায় ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মাছ ধরা ও বর্জ্য ফেলার কারণে মাছশূন্য জলপথ এটি। সবকিছু মিলিয়ে জলদস্যুতা যেন এদের স্বাভাবিক পেশা হয়ে উঠেছে।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এই জলপথ হয়ে উঠেছে আরো উত্তপ্ত, মার্কিন ও ন্যাটোর যৌথ আক্রমণের কারণে। সোমালিয়ার অপর পাড়ের দেশটির নাম ইয়েমেন। সেখানেও চলছে গৃহযুদ্ধ। বর্তমান শাসকদের তছনছ করে ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী এডেনসহ পশ্চিম অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। মার্কিনিদের অভিযোগ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান হুতিদের অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ দিয়ে লালন করছে। ইয়েমেন গৃহযুদ্ধে মার্কিন সমর্থিত সৌদি আরব জোট কাহিল হয়ে পড়েছে। গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে হুতিরা ইয়েমেনের স্থলসীমা অতিক্রম করে জলসীমায় আক্রমণ করছে। পাশ্চাত্যের জাহাজগুলো যখন তখন হুতিদের নিক্ষিপ্ত মিসাইল আক্রমণের শিকার হয়েছে। হুতিদের শায়েস্তা করার জন্য মার্কিন ও ন্যাটো জোট আক্রমণ শুরু করেছে। ১২ জানুয়ারি আমেরিকান প্রেস পরিবেশিত খবরে বলা হয় মার্কিন জোট সমুদ্রপথ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে হুতি স্থাপনাসমূহে আঘাত হেনেছে। তারা এসময় যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন থেকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। মার্কিন বোমারু বিমানগুলো বোমা বর্ষণ করে। মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন কমান্ড থেকে দাবি করা হয় এ সময় তারা ৬০ লক্ষ্যবস্তুর ১৬টি স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম হয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আক্রমণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সন্ত্রাসীদের অব্যাহত বেপরোয়া আক্রমণ সহ্য করবে না। তিনি আরো বলেন যে যথাযথ যোগাযোগ ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই এই আক্রমণ চালানো হয়েছে। বাইডেন বলেন, এই আক্রমণ হুতিদের অভূতপূর্ব ও বিরামহীন আক্রমণের উত্তর। উল্লেখ্য, ওইসব হামলায় হুতিরা ধহঃর-ংযরঢ় নধষষরংঃরপ সরংংরষবং ব্যবহার করেছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর আগেই হুতিদের পক্ষ থেকে মিসাইল ব্যবহারের উদাহরণ নেই। হুতিরা অবশ্য সমুদ্রপথে এই হামলাকে গাজার মুসলিমদের বিরুদ্ধে মার্কিন-ইসরাইল আক্রমণের প্রতিষেধক হিসেবে উল্লেখ করেছে। তারা ঘোষণা করেছে সেখানে হামলা বন্ধ হলেই কেবল হুতিরা আক্রমণ বন্ধ করবে। বাইডেনও হুমকি দিয়েছেন যে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চত করার জন্য প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সেখানে লোহিত সাগরে এখনো মার্কিন ও হুতি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

এখন দেখা যাচ্ছে যে জলদস্যুরা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে প্রদর্শিত কোনো যুক্তিতেই তারা আন্তর্জাতিক নৌপথ বিঘিœত করতে পারে না। কোনো মন্দ কাজ দিয়ে ভালো লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। বাবেল মান্ডেল প্রণালীর পূর্ব ও পশ্চিম তীর ঘেঁষে ইয়েমেন ও সোমালীয় জনগণের বসবাস। দুটো রাষ্ট্রই স্বাধীন ও সার্বভৌম। দুর্ভাগ্যের বিষয় দুটো রাষ্ট্রই গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। তারপরও একথা সত্য যে, তাদের ভালো-মন্দের মালিক তারাই। সেখানে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে অন্য রাষ্ট্র্ এবং জলসীমায় আক্রমণ রাষ্ট্রদস্যুতার শামিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ইয়েমেন এবং লোহিত সাগরে আক্রমণ চালানোর অধিকার রাখে না।

ইয়েমেনি জনগণ তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ধারক। উড়ে এসে জুড়ে বসে গায়ের জোরে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর নেই। তারা যদি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলে তাহলে প্রথমেই তাদের ফিলিস্তিন তথা গাজার মানুষের ওপর বর্বর ইসরাইলি হামলা বন্ধ করতে হবে। হুতিরা ইয়েমেনেরই অধিবাসী। ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনি গাজার জনসাধারণের জীবন রক্ষার জন্য তারা যে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তা ন্যায়সঙ্গত। ইসরাইল যখন পৃথিবীর কোনো আবেদনেই সায় দেয় না তখন প্রতি আক্রমণ ন্যায়সঙ্গত হয়ে ওঠে। জলদস্যুদের দস্যুতা যেমন ন্যায়সঙ্গত নয়, তেমনি সোমালিয়া ও ইয়েমেন অঞ্চলে রাষ্ট্রদস্যুতাও নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। যত শিগগির সম্ভব এই হামলা ও প্রতিহামলা বন্ধ হলে পৃথিবী আরো নিরাপদ থাকবে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement