২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রয়োজন পূর্বাহ্নিক সতর্কতা

প্রয়োজন পূর্বাহ্নিক সতর্কতা - নয়া দিগন্ত

২৯ ফেব্রুয়ারি লিপইয়ার গণনায় ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়তি একটি দিন। বাড়তি দিন, বাড়তি আনন্দের টানে নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ভোজনরসিক মানুষ সেদিন হাজির হয়েছিলেন বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজের ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টে। এ রেস্টুরেন্টে ভিড় জমানোর কারণ ছিল, বিশেষ মূল্যছাড়ের প্রলোভন। উপস্থিত সবাই যখন মূল্যছাড়ের সুযোগ নিতে ব্যস্ত। তখন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো আগুন কেড়ে নিলো বহু প্রাণ। ভবনটিতে ফায়ার অ্যালার্ম না থাকায় আগুন লাগার কথা বেশির ভাগ মানুষ জানতে পারেনি। ফলে উপস্থিত সবাই আগুনের ঘেরাটোপে বন্দী। তবে কেউ লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছেন, কেউ ভবনের ছাদে উঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জীবন বাঁচাতে পারেননি। বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। বরাবরের মতো এবারো মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় বেশ হইচই শুরু হয়েছে। পত্রিকার পাতায় এ দুর্ঘটনা লিড নিউজ হয়েছে। টেলিভিশন টকশোতে এ নিয়ে কথার ফুলঝুরি। কিন্তু তাতে কি স্বজনহারাদের দুঃখ-বেদনা লাঘব হবে? ঘটনার পর এর আগের অগ্নিকাণ্ডগুলোর আদলে শুরু হয়েছে দায় এড়িয়ে দায় চাপানোর ইঁদুর-বিড়াল খেলা।

রাউজক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সরকারি বিভাগ যাদের ওপর এসব তদারকির দায়িত্ব ছিল; তারা সবাই এখন একে অপরের কাঁধে দোষ চাপাতে চাইছে। ২০১০ সালের নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে সর্বশেষ বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ধারাবাহিকতা একই। বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কাউকে দায়িত্বে অবহেলায় শাস্তি দেয়া হয়েছে, তার নজির স্থাপিত হয়নি; বরং দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। দু-একটি ঘটনা ছাড়া মামলা পর্যন্ত হয়নি। ২০১১ সালে বেইলি রোডের ভবনটি আবাসিক-ব্যবসায়িক অনুমোদন পায়। কিন্তু রেস্টুরেন্ট চালানোর কোনো অনুমতি ছিল না। তবু এক অদৃশ্য শক্তিবলে পুরো ভবনটি রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়। অনুমোদনহীনভাবে রেস্তোরাঁ উপযোগী পরিবর্তন না করে তা করা হয়। রেস্তোরাঁ করতে ফায়ার এক্সিট, জরুরি নির্গমন পথ, এসবের তোয়াক্কা না করে ভবনটি রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়- দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার নাকের ডগায়।

গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায়, একটি মাত্র সরু সিঁড়িপথ! তাও বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের স্টোর হাউজ রূপে ব্যবহৃত হওয়ায় চলাচলের অযোগ্য ছিল। তা ছাড়া সিঁড়িটিতে ছিল গ্যাস সিলিন্ডারের স্তূপ। কিভাবে এটি রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তরিত হলো তা উন্মোচন করা প্রয়োজন। কারা অনুমোদন দিয়েছিলেন তাও খুঁজে বের করা দরকার। নজরদারি কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলা শ্রেয়। এ অবস্থা যে শুধু এখানে, তা কিন্তু নয়! খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রাজধানীজুড়ে অধিকাংশ রেস্তোরাঁ ভবনের একই অবস্থা। সবগুলো চলছে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে! কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় দায় এড়ানোর চেষ্টা। অথচ এসব অগ্নিকাণ্ডের গোড়ায় যে ভবন নির্মাণ নীতিমালার উল্লঙ্ঘন তা এড়িয়ে যাওয়া হয়; বিভিন্ন কাজের উপযোগী ভবন নির্মাণ নীতিমালা লঙ্ঘিত হয় কূটকৌশলে।

রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলো রাতারাতি বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত করার ফসল এ দুর্ঘটনা। যদিও এসবের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট মহল তা মানতে নারাজ। কিন্তু দুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮, ২০০৬ সালে অনুপযোগী ভবন ঘোষণার নির্দেশনার কোনো বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় না। পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকায় জলাধার ভরাট করে বহুতল ভবন এবং বিপণিবিতান নির্মাণের পরিণতি কত ভয়াবহ তা বাংলাবাজার অগ্নিকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কৃর্তপক্ষের হুঁশ ফিরেনি। তারপরও ঢাকার জলাশয় ও খাল ভরাট বন্ধ হয়নি; কোথাও আগুন লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে অগ্নিনির্বাপণে প্রশিক্ষিত কাউকে হাতের কাছে পাওয়া যায় না। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ততক্ষণে যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়ে যায়।

দেশব্যাপী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, তদারকি সংস্থাগুলোর অবহেলা-সর্বোপরি জনগণের অসচেতনতা সব মিলিয়ে দেশের প্রতিটি শহর যেন টাইম বোমা। পারস্পরিক দোষারোপ না করে এ ব্যাপারে সমন্বিত কেন্দ্রীয় নীতিমালার আলোকে কার্যকরী একটি টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার। যা ক্রমান্বয়ে সব শহর নগরের ঝুঁকিবহুল ভবন চিহ্নিত করবে।

পাশাপাশি এগুলো সংস্কার অথবা ভেঙে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। যারা ভবন নির্মাণ আইনের ব্যত্যয় ঘটাবেন তাদের চিহ্নিত করে প্রচলিত আইনের আওতায় শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৭৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক পরিমাণ প্রায় ৭৯৩ কোটি টাকা। প্রাণহানির হিসাব, যারা কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন তাদের মূল্যায়ন ছাড়াই। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। ভবিষ্যতের আরো একটি দুর্ঘটনা ঘটার আগে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement