সুখবরের অন্বেষায়
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:৪৫
কবি সুকান্তের একটি মশহুর কবিতার দু’টি চরণ ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ বুভুক্ষু মানুষের এমনই অভিব্যক্তি হতে পারে। আজকে দেশের মানুষ বহু দিন থেকে অনেক কিছুর জন্যই বুভুক্ষু। বিশেষ করে কোনো সুসংবাদ পেতে উন্মুখ উতলা হয়ে তার অন্বেষায় থাকে মানুষ। অনেকটা চাতকের মতো আমরা আকাশের দিকে মুখ তুলে থাকি। এক ফোঁটা বারি বিন্দুর জন্য। বহু দিন থেকে মানুষ ঊর্ধ্বলোক থেকে নিম্নলোকে দৃষ্টি ফেরায় কোথাও কোনো ভালো খবর পাওয়া যায় কি না। বারবার দৃষ্টিশক্তি ক্লান্ত শ্রান্ত হয়। কিন্তু দৃশ্যপটে আনন্দলোকের কোনো প্রতিচ্ছবি নজরে আসে না। যেসব সংবাদ ইদানীং অহরহ দেখি শুনি, সেগুলো কেবলই মানুষের মনকে কাঁদায়, চিন্তাচেতনাকে স্থবির করে দেয়, হতবুদ্ধি হয়ে যায় সমাজ সংসারের অগণিত মানুষ।
সবেধন নীলমণির মতো একটি খবর সম্প্রতি সবাইকে হয়তো পুলকিত করেছে। খবরটি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত। খবরটির শিরোনাম ছিল, ‘বিদেশীরাও যেন এ দেশে (বাংলাদেশে)/ চিকিৎসা নিতে আসে/ সে জন্য কাজ করছে পিএইচএ।’ খবরের ভেতরে রয়েছে ‘আগামীতে বিদেশীরাও যেন এ দেশে চিকিৎসা নিতে আসে। সে জন্য বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষা ও চিকিৎসা উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের সাথে কাজ করছে প্লানেটারি একাডেমিয়া (পিএইচএ)। এই পিএইচএ প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের সদস্যরা উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি ও হাসপাতালে সুনামের সাথে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে সুখ্যাতি ও সম্মান অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষা ও চিকিৎসার উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের সাথে কাজ করছে প্লানেটারি একাডেমিয়া। তাদের উদ্দেশ্য, দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন চিকিৎসক ও তরুণ চিকিৎসকদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া। সে জন্য পিএইচএ ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫টি প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করেছে। সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ জানান, এটি একটি গ্লোবাল সামিট। দেশে প্রথমবারের মতো হতে যাচ্ছে ৯ দিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এতে তরুণ চিকিৎসক ছাড়াও দুই হাজারের বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গবেষকবৃন্দ অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনে তরুণ চিকিৎসকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন পিএইচএ-এর সদস্য ও বিদেশ থেকে আগত খ্যাতিমান প্রবাসী বাংলাদেশী চিকিৎসকরা। বাংলাদেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যে চরম সঙ্কট ও দৈন্য রয়েছে সেটা সর্বজনবিদিত। অথচ এ পর্যন্ত কোনো সরকারই এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মানুষ আশা করে পিএইচএ’র এমন উদ্যোগ দেশে আধুনিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে। মানুষ এও আশা করে পিএইচএ এই মহৎ উদ্যোগ প্রথমবারের মতো হলেও সেটি যেন প্রয়োজন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জারি থাকে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ প্রবাসী বাংলাদেশের এসব মহান সন্তানদের আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমরা জানি প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে। দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে রোগীরা ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে যাচ্ছে। তবে রোগীদের বেশির ভাগের গন্তব্যই হচ্ছে ভারত। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যটক গেছেন বাংলাদেশ থেকে। শুধু ২০২১ সালেই ২৪ লাখ বাংলাদেশী ভারতে গেছেন, যাদের ৭৭ দশমিক ৬ শতাংশ গেছেন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। ২০২২ সালে অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে বিদেশে চিকিৎসার জন্য শূন্য দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশীরা। আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য এটা কমিয়ে আনতে অবশ্যই আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার সব ত্রুটি-বিচ্যুতি দ্রুত দূর করতে হবে। আশা পিএইচএ যে কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, সেটা দেশে চিকিৎসাব্যবস্থার ত্রুটি দূর করতে এবং সর্বাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করতে বিরাট অবদান রাখবে। আমরা এও জানি, কাজটি সহজ নয় এবং কায়েমি স্বার্থবাদীরা এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কোনো সুযোগই হাতছাড়া করবে না। এ জন্য সব মহলকে সজাগ থাকতে হবে এবং ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে।
বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ব্যাপক হারে রোগীদের বিদেশমুখী হওয়ার অন্যতম কারণ দেশী স্বাস্থ্যসেবার প্রতি কিছুটা অনাস্থা। যেমন, রোগ নির্ণয়ে ত্রুটি সময়মতো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা না পাওয়া, চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও সদ্ব্যবহারের ঘাটতি, দেশী চিকিৎসকদের ও সেবা ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা। এসব দূর করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সমন্বিত উদ্যোগের দ্বিতীয় কোনো পছন্দ থাকতে পারে না। এ নিয়ে কেউ হয়তো দ্বিমত করবেন না।
গণমানুষের চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের উদ্যোগের যে শুভ সংবাদ পাওয়া গেছে সেটা এই মুহূর্তে আনন্দের বটে, কিন্তু সেটা এখনো অঙ্কুরিত হওয়ার পথে। তাকে পরিচর্যা, জলসিঞ্চন করে বড় করে তোলার দায়িত্ব শুধু পিএইচএ’র নয়। এই উদ্যোগকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা রাখতে হবে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান পিএইচএ যার সূচনা করেছে, হয়তো ভবিষ্যৎতেও সেটা তারা করবে। তবে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রশিক্ষণের সাথে অবশ্যই কিছু উপায়-উপাত্ত থাকতে হবে, যার মাধ্যমে লব্ধ নতুন জ্ঞান প্রয়োগের সহায়তা হবে। অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে এ জন্য ইতিবাচক থাকতে হবে। সবাই জানেন, দেশে হাজারো সমস্যা রয়েছে। রয়েছে কর্তৃপক্ষের অপরিসীম অবজ্ঞা আর অবহেলা। শোনা গেছে, বহু ক্ষেত্রে নাকি জিরো টলারেন্সের কথা বলা হচ্ছে। সবাই মনে করেন, চিকিৎসার বিষয়টি সব জায়গায়ই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। সেটা বিবেচনায় নেয়া হবে বলে সবাই আশা করতে চায়। যতটুকু পিএইচএ’র মাধ্যমে পাওয়া গেল, তাকে শুধু সঞ্চয় হিসাবে ভাঙিয়ে খেলে খুব দ্রুত সেটা ফুরিয়ে যাবে। এই সঞ্চয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা উচিত।
সব ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া সৎ গুণ। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। যেটি বিবেচনায় নেয়া জরুরি সেটা হলো, এতসব জটিল রোগ সৃষ্টির কারণ কী। সবারই জানা, প্রকৃতপক্ষে দূষিত প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেই জটিল রোগসহ প্রায় সব ধরনের অসুখ সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার সাথে জড়িতরা মনে করেন, পরিবেশের বিষয় নিয়ে অবহেলার শেষ নেই। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কিছুকাল আগের এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ইদানীং সাত বছর কমেছে। এমন ভয়ঙ্কর এবং স্পর্শকাতর খবর শোনার পরও এ নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের এতটুকু মাথাব্যথার কারণ ঘটেছে বলে কেউ লক্ষ করেছেন কি? রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকাশ, ঢাকার বায়ুদূষণ এখন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রায়ই ঢাকার নাম ওঠে আসে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে ঢাকার বাতাস ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই বায়ুদূষণ বহু রোগব্যাধির অন্যতম কারণ। এ দূষণ দূর করা এতটাই কি অসম্ভব? নাকি যথাযথ উদ্যোগ তথা আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে আমাদের কর্মকর্তারা বিশ্বের পরিবেশের উন্নয়ন নিয়ে খুবই উচ্চকণ্ঠ এবং উদ্বিগ্ন। অথচ ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ দূর করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কি প্রশংসা পেতে পারে। প্রশ্ন হলো, কতকাল তারা ঢাকা মহানগরীর মানুষকে এমন গ্যাস চেম্বারে বসবাস করতে বাধ্য করবেন। এ থেকে পরিত্রাণের পথ রচনা করা ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে সম্ভব নয়।
সবাই মনে করেন, দেশের আলোচনা সমালোচনার সর্বোচ্চ ফোরাম হচ্ছে জাতীয় সংসদ। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা নিয়ে কখনো তেমন আলোচনা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কেউ তাদের স্মৃতি হাতরিয়ে এমন কোনো কিছু কি বলতে পারেন, যা একাদশ সংসদের গুরুত্বকে উচ্চকিত করতে পারে বা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতে পারে?
এমন সমীক্ষার খবর পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা গেছে। একাদশ সংসদের ২২টি অধিবেশনের অকার্যকর ভূমিকার কারণে সবমিলিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। দেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল, তার জন্য রাষ্ট্রের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটা নাকি রেকর্ড পরিমাণ। অথচ নির্বাচনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সুখ্যাতি নিয়ে এত যে আলোচনা ইতোমধ্যে হয়েছে, তা নিয়ে আর কিছু বলা পক্ষ-বিপক্ষ সবাইকেই বিরক্ত করতে পারে। সহজভাবে যে কথাটা বলতে চাই, তাহলো ফলেই বৃক্ষের পরিচয়। আমরা বর্তমান সংসদ বৃক্ষের কি ফল পাবো। সেটা দেখতে উন্মুখ। অনেকেই উন্মুখ এই সংসদ যতটা নেতিবাচকতার দিক রেকর্ড করেছে, তার প্রতিবিধানের কোনো সুযোগ কি দ্বাদশ সংসদ সৃষ্টি করতে পারবে। নাকি হবে ‘সকলই গরল ভেল।’ মানুষের ‘হতাশা’ অসুখটি খুব ক্ষতিকর, সেটা দেহ মনকে নির্জীব করে। এই হতাশাকে আশাবাদী করে তোলা এখনো কিন্তু মরীচিকার পেছনে ঘোরার মতো হয়ে আছে।
ndigantababar@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা