২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যুক্তরাষ্ট্র প্রাসঙ্গিক সবখানেই, রাশিয়াও

যুক্তরাষ্ট্র প্রাসঙ্গিক সবখানেই, রাশিয়াও - ফাইল ছবি

চলতি বছর অনেক দেশেই নির্বাচন হচ্ছে। শুরুটা হয়েছে ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ দিয়ে। এর এক মাস পর ৮ ফেব্রুয়ারি হলো পাকিস্তানে। ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে গেল বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপরাষ্ট্র ও মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচন। ভারতেও নির্বাচনের ঘণ্টা বাজছে। গোটা বিশ্বে নির্বাচনের ভালো-মন্দ মূল্যায়নের মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনও এ বছরই। মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় হবে জাতীয় নির্বাচন। ১৯৯৪ সালে বর্ণবৈষম্যের অবসানের পর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে দেখা হচ্ছে এটিকে। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মধ্যে আলজেরিয়া, বতসোয়ানা, চাদ, কোমোরোস, ঘানা, মৌরিতানিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, রুয়ান্ডা, সেনেগাল, সোমালিল্যান্ড, দক্ষিণ সুদান, তিউনিসিয়া ও টোগোতে হবে জাতীয় নির্বাচন।

কিছু দেশে নির্বাচন নিছক আনুষ্ঠানিকতা। তবে অনেক দেশের নির্বাচন গোটা বিশ্বের জন্যই ঘটনা। যেমন, বাংলাদেশের দিকে চোখ ছিল অনেক দেশের। তীক্ষè নজর ছিল ভারত-যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কিছু দেশের। পাকিস্তানের দিকেও ছিল ব্যাপক উৎসুক চোখ।

যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এ বছরের শেষ দিকে ৫ নভেম্বর। এ নির্বাচনে জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে মেয়াদপূর্তিতে তার বয়স দাঁড়াবে ৮৬ বছর। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ফিরে আসতে পারেন? নির্বাচনী রেকর্ডের এ বছরে আরেক সুপার পাওয়ার রাশিয়াতেও ভোট। দু’বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকা ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রপতি পদে আছেন ২৪ বছর ধরে। আগামী মাসের নির্বাচনে জয়ের বিষয়েও আত্মবিশ্বাসী তিনি। সংবিধান সংশোধন করে ২০৩৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পথ সুগম করেই রেখেছেন পুতিন। এবার নির্বাচিত হলে জোসেফ স্তালিনের শাসনকালের মেয়াদ ছাড়িয়ে যাবে পুতিন-রাজত্ব। বাস্তবে পুতিনের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তার মূল ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালেক্সেই নাভালনি ১৯ বছরের কারাদণ্ডাদেশ নিয়ে কারাগারে সম্প্রতি মারা গেছেন। অনেকে বলছেন, তাকে গোপনে খুন করিয়েছেন পুতিন।
জুনে আছে আরেকটি বড় ও উল্লেখযোগ্য নির্বাচন। সেটি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের। বিভিন্ন ইস্যুতে চ্যালেঞ্জের মুখে এই জোটের নির্বাচনের দিকে বিশ্বের নজর। ভোটার ইউরোপের ৪০ কোটি মানুষ। এই ভোট কট্টর ডানপন্থী ‘পপুলিস্ট’ নেতাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। বছরের শেষ দিকে নভেম্বরে রয়েছে ডাচ-নির্বাচন। এতে গ্রিট ওয়াইল্ডারের ইসলামবিরোধী ও ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী পিভিভি ফ্রিডম পার্টি ও গত বছর ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনির কট্টর ডানপন্থী ব্রাদার্স অব ইতালির বিজয় ডানপন্থীদের পালে হাওয়া দিলেও, এই নির্বাচনেই তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই হবে।

জুনে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন দুই নারী। যার ফলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোয় আসতে যাচ্ছে বড় পরিবর্তন। এক দিকে আছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস মানুয়েল লোপেজ ওবরাদরের মোরেনা পার্টির প্রার্থী ক্লদিয়া শেইনবম। তিনি রাজধানী মেক্সিকো সিটির সাবেক মেয়র। অন্যদিকে আছেন দেশটির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি জোচিল গালভেজ। ব্যবসায়ী গালভেজ বিরোধীদলীয় জোট ‘ব্রড ফ্রন্ট ফর মেক্সিকোর’ পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেবেন। তাইওয়ান ও ভুটানে নির্বাচন হওয়ার কথা বছরের মাঝামাঝিতে।

দ্য ইকোনমিস্টের মতে, ব্রাজিল ও তুরস্কের মতো কিছু জায়গায় সাধারণ নির্বাচন হবে না তবে স্থানীয় বা পৌরসভা নির্বাচন হবে যেখানে পুরো দেশ অংশ নেবে। যে দেশগুলো নির্বাচনে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকে জি-২০ ও জি-৭ এর মতো শক্তিশালী জোটের সদস্য। এ কারণে এসব নির্বাচনে ভূরাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও আসতে পারে পরিবর্তন। ভূরাজনীতির উত্তেজনা আগে থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে জেঁকে বসে আছে। এর সাথে যোগ হবে দেশে দেশে নির্বাচনের প্রভাব। ভারত, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ২৭ সদস্যের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন গোটা বিশ্বে না হলেও কোনো কোনো দেশের রাজনীতির বাঁক বদলে দিতে পারে।

এ অঞ্চলে বাংলাদেশের তীক্ষ্ণ চোখ ভারতের নির্বাচনের দিকে। দেশটির রাজনীতি, নির্বাচন, ক্ষমতার ওপর বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের অনেক কিছু নির্ভর করে। এপ্রিল-মে মাসে হতে যাওয়া নির্বাচনের আগেই কারচুপির প্রস্তুতির অভিযোগ উঠেছে ভারতে। বিপুল জয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের দৃঢ় আশা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। সরকারের মেয়াদ পূর্তি ও লোকসভা নির্বাচনের আগে বাজেট অধিবেশনে পার্লামেন্টে শেষ ভাষণে এ আশাবাদের কথা জানান তিনি। সেইসাথে বিরোধী দল কংগ্রেসে পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করেন তিনি।

আত্মবিশ্বাসী মোদির দাবি, লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৪০০টিতে জিতবে তার ক্ষমতাসীন জোট এনডিএ। এতে শুধু বিজেপির পক্ষেই যাবে ৩৭০টি আসন। মোদির এই আত্মবিশ্বাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন কংগ্রেস নেতা অধির। তিনি বলেন, ইভিএমে কারসাজির প্রস্তুতি না থাকলে এত আসনে জয়ের বিষয়ে এতটা নিশ্চিত থাকা অসম্ভব। মোদির ভাষণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওয়াহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনার কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন রাহুল গান্ধীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা। সোস্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে ‘হ্যাশট্যাগ বাই বাই মোদি’ আন্দোলন।

এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। ‘ভারতকে যা দিয়েছি তা তাদের আজীবন মনে রাখতে হবে’- এমন কথা বলেছিলেন স্বয়ং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো। ভারতের দিক থেকে এমন শব্দ বা হালকা কথা বলা না হলেও মাঝে মধ্যে যা বলা হয় সেগুলোর মর্মার্থ কাছাকাছিই। বাংলাদেশের দিক থেকে ক্ষমতাসীনরা সেই বিশ্বস্ততার প্রমাণ রেখে চলছে ভারতের কাছে। এর বেনিফিটও পাচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে ভূমিকা নিয়ে চলছে তাতে বেজায় সন্তুষ্ট ভারত।

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তার উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে সড়ক ও নদীপথে পরিবহনের সুবিধাও তাদের এক বিশাল প্রাপ্তি। কিন্তু, ভারতের মাত্র কয়েক কিলোমিটার ভূমি ব্যবহার করে ল্যান্ডলকড কান্ট্রি নেপাল এবং ভুটানের সাথে বাণিজ্য করতে পারছে না বাংলাদেশ। ভারতে ২০১৪ সালে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বৃদ্ধির অভিযোগ বিজেপি সরকার আমলে নিতে নারাজ। ভারতীয় রাজনীতিবিদরাও তাদের দেশে ‘বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসীদের কথিত অনুপ্রবেশের অভিযোগ তোলেন। দেশটির আসন্ন নির্বাচন বা ক্ষমতার দিকে বাংলাদেশের মহল বিশেষের নজর তাই আরেকটু বেশি।

ভোটের আগে বিতর্কিত সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) নিয়ে ফের আলোচনা তুঙ্গে। ২০১৯ সালে আইনে পরিণত হয়েছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ। এই আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধসহ ছয়টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তবে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদের মুখে সিএএ কার্যকর হয়নি। লোকসভা নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই ফের তুঙ্গে সিএএ আলোচনা। এটি বেশি পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের শঙ্কা বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রোষানলে পড়বেন তারা। হতে পারে রোহিঙ্গাদের মতো করুণ পরিণতি। উত্তেজনা আছে আসামেও। জের পড়েছে বাংলাদেশে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও দেখাদেখির পারদ চড়ছে দু’দেশেই।

সবমিলে এ বছরে নির্বাচন হওয়ার কথা মোট ৮০টি দেশে, যাতে ভোট দেয়ার কথা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষেরই। ২০২৪ সালকে তাই ভোটের বছর বলাই যায়। দেশে দেশে ভোট, আরেক দিকে যুদ্ধ, এই রসায়ন বিশ্বকে কোথায় নেবে উদ্বেগ আছে অনেকের। যার নমুনা কোরীয় উপদ্বীপ, পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান বনাম যুক্তরাষ্ট্র, ইয়েমেন, মিসর, ইসরাইল, লেবানন, আফগানিস্তানসহ আরো নানা দেশ ও অঞ্চলে। বিশ্বে এখন সচরাচর কারো ভূমি বা মানচিত্র কেউ নিয়ে যায় না। অর্থনীতি কব্জায় নেয়। মোড়লিপনার হাব বানায়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রাসঙ্গিক সবখানেই । পেছন পেছন রাশিয়াও।

যে দেশের নির্বাচনে যারা জিতবেন, তারা ঠিক করবেন তাদের দেশের অর্থনৈতিক নীতি কী হবে। সব দেশের জন্যই এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement