অশান্ত সময়ের বিরূপ বসন্তের পাঁচালি
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:৫৭
অন্যান্যবারের মতো এবারো কাকডাকা ভোরে বের হয়েছিলাম। কিন্তু ২০২৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে অতীতের মতো আবেগতাড়িত হতে পারছিলাম না। রাস্তায় প্রতিবার যে ভিড় থাকে এবং ছোট-বড় মিছিলের সারি থাকে তা এ যাত্রায় ছিল না। সরকারি দলের হোন্ডালীগ, সরকারি কর্মচারী এবং অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যে আনুষ্ঠানিকতা করা হলো তা আমাকে আকর্ষিত করল না। আমি হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডি লেকের দিকে গেলাম, তার পর কী মনে করে সকালের নাশতার জন্য স্টার কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। পুরো রেস্টুরেন্ট লোকে লোকারণ্য। এত সকালে এত লোকের সদলবলে নাশতা গ্রহণের দৃশ্যে মনে হলো তারা সরকার-সমর্থক কিংবা সরকারি দলের হোমরা-চোমরা। তারা পেটপুরে খেয়ে তার পর হয়তো শহীদ মিনারে যাবে।
নাশতা সেরে আমি সস্ত্রীক ধানমন্ডির লেকের পাড় দিয়ে হেঁটে সোজা রবীন্দ্র সরণিতে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন সকাল সাড়ে ৬টা। সেখানেও তিল ধারণের জায়গা নেই। রবীন্দ্র সরণিতে চলচ্চিত্রের নায়ক ও মডেল ফেরদৌসের বাহারি পোস্টার এবং সরকারি দলের লোকজনের কোলাহলে মনে হলো, দেশে দুধ-মধুর নহর বইছে। সারি সারি টেবিলে ২৫-৩০ জনের দল নাশতা করছে আর শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির রমরমা অবস্থা ফুটিয়ে তুলছে। আমাদের মতো আমজনতা একটি সিঙ্গারা ও চা-পান করে ফিসফিসিয়ে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট ও দৈন্য নিয়ে কথা বলছে এবং ভয়ে ভয়ে আশপাশের টেবিলে পিটপিটিয়ে তাকাচ্ছে। একজন উৎসাহী ভদ্রলোক আমাকে চা দিয়ে আপ্যায়ন করালেন এবং চা-পানের ফাঁকে নিজের একগাদা দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা শুনিয়ে মনটা খারাপ করে দিলেন।
রবীন্দ্র সরণি থেকে বের হয়ে ধানমন্ডি লেকের ওপর যে সেতু রয়েছে তা পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে রওনা হলাম। পথচারীরা সালাম বিনিময়ের পর আমাকে দাঁড় করিয়ে তাদের মনের কথা বলার চেষ্টা করলেন। আমি যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে সবার সাথে ভাব বিনিময় করলাম। আজকের দিনের অবাক করা বিষয় হলো, বেশির ভাগ লোকের মেদভুঁড়ি কমে গেছে। আমারও খানিকটা কমেছে বটে কিন্তু সকালে নাশতা- তারপর দুধ-চা পান করার কারণে পাকস্থলি স্ফীত হয়ে পড়েছিল এবং হজমজনিত গ্যাসের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে পেট ফুলো ফুলো লাগছিল। সুতরাং মেদভুঁড়িহীন লোকজন আমার মধ্যপ্রদেশের বিষয়ে ভীষণ ঈর্ষাপরায়ণতা দেখাতে শুরু করলেন। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের বিশাল ভুঁড়ির ওপর লোকজনের যে বিরক্তি তা যেন আমারটির ওপর না পড়ে সে জন্য বেকুবের মতো বলতে থাকলাম, সকালে বাইরে নাশতা করার কারণে পেটের মধ্যে অস্বাভাবিক গ্যাস হয়েছে। তাই ফুলে আছে। কিন্তু বাস্তবে ভেতরে তেল চর্বি নেই, একেবারে ফাঁকা।
আমার কথা শুনে পাবলিকের সন্দেহ বেড়ে গেল। আমি সিনেমার নায়কদের মতো হঠাৎ পেট ভেতরে নিয়ে সিনা ফুলিয়ে নিজেকে অতিরিক্ত স্মার্ট হিসেবে প্রদর্শনের চেষ্টা করলাম। আমার স্ত্রী কী বুঝলেন জানি না, তিনি আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি টেনশনে পেট ছেড়ে দিলাম। আমার সাথে আলাপরত লোকজন আমার পেটের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে ভারি আশ্চর্য হয়ে মুখটিপে হাসতে শুরু করলেন। আওয়ামী লীগের একজন সাবেক কর্মী হিসেবে আমার মধ্যে এখনো অনেক আওয়ামী অভ্যাস রয়ে গেছে। সুতরাং পাবলিকের হাসিতামাশা গায়ে না মেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম এবং পুনরায় পাবলিকের মুখোমুখি হওয়া এড়ানোর জন্য রিকশায় চেপে বাসায় ফিরলাম।
অন্যান্য কর্মদিবসের মতো আজো অফিসে এলাম। পত্রিকায় চোখ রাখতেই মন ভার হয়ে যায়। দেশের অর্থ পাচার নিয়ে প্রথম আলো ব্যানার হেডলাইন দিয়ে বিশাল এক খবর ছেপেছে। এস আলম গ্রুপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাভেদকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য ও তাদের টাকা পাচার নিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ খবর ছেপেছে। টেকনাফের ওপারে আরো সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে শিরোনামে নয়া দিগন্ত যে প্রতিবেদন ছেপেছে তা ঠিকমতো অনুভব করতে পারলে আওয়ামী লীগের বসন্ত উদযাপন এবং মেদভুঁড়ি এলোমেলো হয়ে যাবে। কারণ ভারত ও আমেরিকা চাচ্ছে আরো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করুক। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আরাকান আর্মির সাথে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত শুরু হয়েছে তা যদি ঠেকানো না যায় তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও মিয়ানমারের মতো হয়ে পড়বে।
অর্থ পাচার নিয়ে নয়া দিগন্তও প্রথম আলোর মতো করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, যুগান্তরও দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়ে দুটো লিড নিউজ করেছে। দেশের আলোচিত ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিনের প্রধান শিরোনাম- ‘কামাই করে একবেলার খরচও হয় না।’ মানিকগঞ্জের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সরেজমিন তদন্ত করে মানবজমিনের একজন প্রতিবেদক অভাবী মানুষের দৈনিক আয়-রোজগার এবং খাবারদাবার নিয়ে যে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন সেখানে দেখা যায়, গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন বড়জোর একবেলা পেটপুরে খাবার খেতে পারে। অর্থাৎ একজনের আয় দিয়ে তিনবেলা খানা খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে তেল-পানি-সাবান-সোডা এবং কাপড়চোপড় কেনা বাবদ কোনো অর্থ খরচ করা এই মুহূর্তে প্রান্তিক জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। আর রোগ-শোক-বিয়েশাদি আমোদ আহ্লাদের কথা তো গরিব মানুষ চিন্তাই করতে পারে না। তারা বড়জোর বড় বড় হোটেলে গিয়ে অর্থ লুটেরাদের ভুঁড়িভোজ অবলোকন করতে পারে এবং মনের যন্ত্রণা মেটাতে আপন মনে খিস্তি-খেউড় শুরু করতে পারে।
নিজের দেশ রেখে যদি পাশের দেশ ভারতের কথা ভাবি তবে মনের মধ্যে গোস্বা চলে আসে। প্রকৃতিতে বিরাজমান বসন্তকে বর্ষাকাল মনে হয়। ভারতের দাদাগিরি ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য তাদের শল্যচিকিৎসার কারণে বাংলাদেশের ভোটারদের কিডনি, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং মনের ওপর দিয়ে যে কিয়ামত বয়ে গেছে তা এখনো শেষ হয়নি; বরং ভারতীয় ভুল চিকিৎসায় কিয়ামতের যন্ত্রণা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে এবং ভাইরাসের মতো একজনের অন্তর থেকে অন্যের অন্তরে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরাইলির বর্বরতা ও ফিলিস্তিনি জনগণের অসহায়ত্বের কথা মনে পড়লে বসন্তের বাতাস লু হাওয়াতে পরিণত হয়।
বিগত নির্বাচন নিয়ে ডোনাল্ড লুয়ের লম্ফঝম্পে যারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রতারিত হয়েছেন তাদের কালে শুরু হয়েছে নতুন ঝনঝনানি। লু বাংলাদেশ নিয়ে অনেক চিন্তিত। পাশের দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বিপদে আছে। আরাকান আর্মির তাড়া খেয়ে জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী যেভাবে পালিয়েছে এবং যেভাবে ভারতের স্বার্থে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে তাতে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশের বিপদ আন্দাজ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। তিনি বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ মালদ্বীপ উড়ে এসেছেন এবং সেই দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন যে, আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ ও সৈন্যরা মালদ্বীপ রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রটির চারপাশে টহল দিতে চায়। লুয়ের কথা শুনে আমাদের মনে সেন্টমার্টিনে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের অলীক কল্পনা অথবা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য টেকনাফ সীমান্তে মার্কিন সেনাদের টহলের দুঃস্বপ্ন কেন তাড়া করছে তা ভেবে পাচ্ছি না।
মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের যুদ্ধবিরতির চেষ্টা, ইউক্রেনের যুদ্ধের দাবানল ও মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর মার্কিন বিমান হামলার আগুন আমাদের দেশের সব কিছুই তছনছ করে দিচ্ছে। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা দিবসে আমরা অনেকেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বাংলা ভাষার চিৎকার-চেঁচামেচি বাদ-প্রতিবাদ আন্দোলন এবং লড়াই সংগ্রামের সব সে্লাগান একত্র হয়ে এখন যেভাবে জয় বাংলার মধ্যে বিলীন হতে চলেছে তাতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বাকপটু বাঙালি বলতে পারে না। বাঙালির শান্ত হয়ে যাওয়ার হালনাগাদ হালহকিকত ও মুখের ভাষা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখার অসম্ভব ক্ষমতা অর্জনের দক্ষতার সাথে সাথে বাঙালি কান্না করার অভ্যাসটি পরিত্যাগ করতে চলেছে। বাঙালির সৌন্দর্য এখন চুপ থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে চলেছে এবং অনাগত দিনে তাদের বাকশক্তি শ্রবণশক্তি ও মানবিক অনুভূতি এমন স্তরে নেমে আসবে যেখান থেকে হাসি-কান্না শীত-গ্রীষ্ম অথবা বর্ষা-বসন্তের পার্থক্য নিরসন কঠিন হয়ে যাবে।
আজকের দিনে বাংলায় বসন্তের যে কান্নাভেজা রূপ প্রকৃতিতে ফুটে উঠেছে সেখানে পলাশ শিমুলের পাগল করা সৌন্দর্য পালিয়ে কোথায় যে চলে গেছে তা আমরা না জানলেও বসন্তের কোকিলরা কিন্তু খুব ভালো করে জানে। ফলে প্রকৃতিতে কোকিলের কূজনের পরিবর্তে কাকের কা কা রব দিনকে দিন মানুষের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় বাঙালির বসন্তকাল অনাগত দিনগুলোতে প্রকৃতি ও পরিবেশে কী বিবর্তন নিয়ে আসে তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা