২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য - নয়া দিগন্ত

বুড়ো বয়সে তরুণী বধূ মানবজীবনে কত্তোসব বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে তা আধুনিককালের শারীরবিদ্যা, মনোবিদ্যা থেকে শুরু করে অর্থ-রাজনীতি-মান-সম্মান-মর্যাদা ইত্যাদি তাবৎ বিদ্যার বই-পুস্তকে মোটামুটিভাবে নিখুঁত উপায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দুই হাজার ৪০০ বছর আগে মহামতি চানক্য যেভাবে উল্লিখিত শিরোনামে নারী-পুরুষের অসম সম্পর্কের বিষয়ে বর্ণনা দিয়ে গেছেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। তিনি যে সা¤্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সেখানে পতিতাবৃত্তি সম্মানজনক পেশা ছিল। পতিতাদের প্রতিনিধি রাজদরবারে থাকত এবং পতিতাবৃত্তি-সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভালের জন্য একটি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ছিল যার প্রধানের উপাধি ছিল গণিকাধ্যক্ষ।

চানক্যের সরকারি নাম ছিল কৌটিল্য আর বংশীয় নাম ছিল বিষ্ণুগুপ্ত। তার লিখিত অর্থশাস্ত্র মহাকালের ইতিহাসের প্রধানতম প্রামাণ্য গ্রন্থ। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের ভারতবর্ষের রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজব্যবস্থার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার আইন-কানুনগুলো তিনি তার গ্রন্থে এতটা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন যার দ্বিতীয় নজির সারা দুনিয়ায় নেই। চানক্যকে নিয়ে সব সময়ই আলোচনা হয়েছে এবং আগামীতেও হবে। কারণ তিনি কোনো হাবিজাবি-ডামি-মামির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। আর তার রাষ্ট্রটি যেনতেন প্রকৃতির কোনো বড় ভাই-দাদা বা স্বামীর করুণার ধন ছিল না। তার শিক্ষা-দীক্ষার মান ছিল তৎকালীন দুনিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তার বীরত্ব, প্রজ্ঞা, মেধা ও কর্মে সফলতার জন্য তিনি এবং তার বন্ধু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যুগপৎভাবে পৃথিবীর ইাতহাসে অমর ও অক্ষয় হয়ে আছেন।

ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য যা কি না ১৩৮ বছর স্থায়ী হয়েছিল এবং এই বংশের তিনজন সম্রাট যথা- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুসার ও অশোক কেবল ভারতবর্ষ নয়; তার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম সম্রাটদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। এই সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার যা কি না বর্তমান ভারতের আয়তনের প্রায় পৌনে দুইগুণ (ভারতের আয়তন ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ২৬৩ বর্গকিলোমিটার)। সুতরাং মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে আপনি কি চা-বিক্রেতা হিসেবে ঠাট্টা করবেন নাকি বিনাভোটের অটোপাস প্রধানমন্ত্রী বলবেন, নাকি চা-ওয়ালার দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রধানমন্ত্রী বলবেন তা নিয়ে মুখ খোলার আগে নিম্নের সংক্ষিপ্ত ঘটনাগুলো জেনে নিন-
ভারতে তখন প্রভাবশালী নন্দ বংশের রাজত্ব চলছিল। আর সেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো এতটা শক্তিশালী ছিল যে, বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার পর্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নন্দ রাষ্ট্র আক্রমণ না করে ফিরে গিয়েছিলেন। নন্দ রাজার পুত্র ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত এবং বলা হয়ে থাকে যে, তিনি তার মায়ের বংশ পরিচয়ের জন্য রাজ উপাধি থেকে বঞ্চিত হন এবং প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হয়ে তক্ষশিলায় চলে যান। তক্ষশিলা ছিল বর্তমান পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির কাছে অবস্থিত একটি শহর যেখানে তৎকালীন দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশিলার আচার্য হিসেবে চানক্য কর্মরত ছিলেন।

কথিত আছে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তক্ষশিলা গিয়েছিলেন আলেকজান্ডারের সাথে দেখা করার জন্য, কারণ ভারতের যে অংশে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন সেটি ছিল তক্ষশিলার খুব কাছে। চন্দ্রগুপ্তের সাথে আলেকজান্ডারের সাক্ষাতের আগেই চানক্যের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায় এবং অল্প সময়ে তাদের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়। চানক্য যদিও প্রশাসনিকভাবে তক্ষশিলা বিশ্ববিদালয়ের প্রধান ছিলেন কিন্তু তার পরিচয় ছিল অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রূপে। তিনি চন্দ্রগুপ্তের দুঃখের কথা এবং সেই দুঃখ থেকে পরিত্রাণের জন্য আলেকজান্ডারের সাথে সাক্ষাতের মনোবাসনা জানার পর নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত নিতে চন্দ্রগুপ্তকে প্রভাবিত করেন।

চানক্য কোনো বিদেশী শক্তির সাহায্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে বিপজ্জনক ও অসম্মানজনক বলে আখ্যায়িত করে চন্দ্রগুপ্তকে আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নন্দ বংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য কতগুলো মনোহারী পরামর্শ দেন। চন্দ্রগুপ্ত চানক্যের পরামর্শে জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন এবং দুই বন্ধুর সম্মিলিতি প্রচেষ্টায় ৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নন্দ রাজবংশকে উচ্ছেদ করে যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন তাই ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্যরূপে অমর হয়ে আছে। সুতরাং এই সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী যেদিন বললেন বুড়ো বয়সে কেউ যদি তরুণী বয়সের মেয়েকে বিয়ে করে তবে তার জীবন বিষময় হয়ে পড়ে এবং সেটি যে কতটা বিষময় এবং সেই বিষের বীজ বা আকর বিষের বাঁশির সুর যে কতটা বিধ্বংসী তা ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

আজকের নিবন্ধে আমরা চলমান সময়ের কোনো বিশেষ ঘটনা বা কোনো পথভ্রষ্ট বৃদ্ধ অথবা তার তরুণী বধূর কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছুই বলব না; বরং মহামতি চানক্য কেন বৃদ্ধের তরুণী বধূকে বিষতুল্য বললেন তা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার চেষ্টা চালাব। বুড়ো বয়সে তরুণীকে বিয়ে করলে বুড়ো মানুষটির শরীরে, মনে ও মস্তিষ্কে কি কি বিষক্রিয়া দেখা দেয় তা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অসম বিয়েশাদির সামাজিক বিষক্রিয়া নিয়েও আলোচনা করব। তবে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে বিয়েশাদির মাধ্যমে দৈহিক সম্পর্ক ও বিয়েশাদি বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক।

নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক অনাদিকালের। কিন্তু মানুষ যখনই সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে ঠিক তখন থেকেই বিয়েশাদির মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক, সন্তান উৎপাদন এবং উত্তরাধিকার মনোনয়নের রূপরেখা তৈরি করে নিয়েছে। যুগভেদে ছোটখাটো পরিবর্তন বাদ দিলে বিয়েশাদির আদি ইতিহাস আজ অবধি চলমান। মহাভারতের যুগে কিংবা ফেরাউন জমানায় অথবা গ্রিক হেলেনীয় সভ্যতা ছাড়াও চীন-আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতায় বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক আজকের মতোই নিন্দনীয় ছিল। আর বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ সন্তান কখনোই কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসতে পারেনি। আমাদের দেশে জারজ যেমন একটি অপবিত্র শব্দ, তেমনি হাজার বছরের ইতিহাসের কোথাও শব্দটি এক মুহূর্তের জন্য মানব মনে ইতিবাচক সাড়া ফেলতে পারেনি।

বিয়েশাদির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বয়স-বংশ, আর্থিক অবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষা, পদ-পদবি ইত্যাদি সব সমাজেই গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে কোনোটির অমিল বা ঘাটতি থাকলেই সম্পর্কটি হয়ে যায় অসম- আর প্রত্যেকটি অসম সম্পর্কই নারী-পুরুষের জীবন তছনছ করে দেয়। একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষা ও চিন্তার মিল না থাকলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে জাহান্নামের অশান্তি নেমে আসে। অভ্যাস ও চরিত্রগত অমিলে দৈনন্দিন ঝগড়াঝাঁটি অনিবার্য। শিক্ষা-দীক্ষা বংশ সমপর্যায়ের না হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রভু-ভৃত্য অথবা মনিব-ক্রীতদাসের সম্পর্কের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। তবে সব অসম সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বৃদ্ধ বয়সে তরুণীর সাথে বিয়েশাদির বিষয়টি। হাল আমলে বৃদ্ধ বলতে সাধারণত ৬০ বছরের চেয়ে বেশি এবং তরুণী বলতে ২০ বছরের চেয়ে কম বয়সী মানব-মানবীকে বোঝায়, যারা দাম্পত্য সম্পর্কে জড়ালে কেমন বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে তা নিম্নে আলোচনার চেষ্টা করব-
বুড়ো বয়সে তরুণীকে বিয়ে করলে বুড়োর ভাঙাচোরা-বিষব্যথার শরীরের হাড়ের সংযোগগুলোতে যে পিচ্ছিলকারক পদার্থ থাকে তা তরুণীর শরীরের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে। বুড়োর মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের হরমোন তৈরি হয়, যা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য তার শরীরে পাশবিক উন্মাদনা পয়দা করে। ফলে তরুণীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে বুড়ো প্রথম প্রথম কয়েক দিন বেশ চাঙ্গাভাব অনুভব করে। কিন্তু অল্প দিন বাদে তার শরীর অবশ হয়ে পড়ে এবং মস্তিষ্কে নানা রকম নেতিবাচক হরমোন তৈরি হতে থাকে। ফলে বুড়োর আয়ু কমে যায়।
বিয়ের প্রথম ধাপে বুড়ো বেপরোয়া থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে সমাজ-সংসার দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে তরুণীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ক্ষেত্রবিশেষে ভ্রষ্টতা বুড়োকে দ্রুত মরণের পথে নিয়ে যায়। এই সময় বুড়ো ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। তার বিবেক মরে যায়। বিচার ও বিবেচনাশক্তি রহিত হয়ে যায়। তার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় এবং চলতে ফিরতে তার আচরণ মাতালের মতো হয়ে যায়। তার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায় এবং সহজাত মানবিক মূল্যবোধ ও লজ্জা-শরম-হায়া হারিয়ে ফেলে। বুড়ো সমাজ সংসারের কাছে আবর্জনা। আপনজনদের কাছে বোঝা এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ভাইরাসের মতো রোগ-জীবাণুতে পরিণত হয়।

বুড়ো তার তরুণী বধূর আবদার রাখতে গিয়ে অধিক ভোজন, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও ক্ষেত্রবিশেষে সমাজ-সংসারের সাথে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ-মারামারি থেকে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে, যা বুড়োকে নিঃশেষ করে দেয়। বুড়ো যদি ধনবান ও রাজপুরুষ হন তবে তরুণী বধূর জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন-খারাবি ও রাজ্য হারানোর মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। কাম-ক্রোধ লোভ-লালসা নিয়ন্ত্রণের জন্য শরীরে যে সার্কিট ব্রেকার থাকে তা বুড়ো বয়সে অনেকটা অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে বুড়োদের আহার-বিহার-বর্জ্য ত্যাগে সে অসামঞ্জস্য দেখা দেয় তা তরুণী বধূর কবলে পড়লে মারাত্মক আকার ধারণ করে। তরুণী বধূর বৃদ্ধ ভাতারের (ভাতার নিখাদ বাংলা শব্দ যার অর্থ অন্নের সংস্থানকারী) অন্ন গ্রহণ ও বৃদ্ধ শরীরে শক্তি অর্জনের প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। ফলে বৃদ্ধ দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কবরের পানে ধেয়ে যেতে থাকে।

তরুণী বধূর কবলে পড়ে বৃদ্ধ নানা রকম অসামাজিক কর্মকাণ্ড-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাবিত হয়, যা দেখে তরুণ-তরুণীরা মারাত্মকভাবে বিপথগামী হয়ে পড়ে। নারী-পুরুষের সহজাত সম্পর্কের বিষয়ে অনেকে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও আস্থার জায়গাগুলোতে ফাটল ধরে। বৃদ্ধের তরুণী ভার্যার রসায়নে বৃদ্ধমহলে লোভের সঞ্চার হয়- যুবকদের মধ্যে ঈর্ষা ও হতাশা দেখা দেয় এবং সুখী দম্পতিদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা বাসা বাঁধে। ধনবান বৃদ্ধের ধনসম্পত্তি নিয়ে তরুণী বধূ এবং তার বিবেকহীন লোভী আত্মীয়-স্বজন এবং বৃদ্ধের রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দের মধ্যে যে বিভেদ তৈরি হয় তাতে অর্থনীতির চাকা উল্টো পথে ঘুরতে থাকে। ফলে অনেকে রাজা থেকে ভিখারিতে পরিণত হয়, ঈমানহারা হয়ে আল্লাহকে দায়ী করে বলতে থাকে, ‘বিয়েশাদি তো আল্লাহর হুকুমেই হয়ে থাকে।’

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement