০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ফিলাডেলফিতে আতঙ্কে ফিলিস্তিনিরা

ফিলাডেলফিতে আতঙ্কে ফিলিস্তিনিরা - ফাইল ছবি

হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার নেতানিয়াহুর পরিকল্পনায় এবার রয়েছে নিরীহ ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদকৃত অসহায় ফিলিস্তিনিরা। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৭ হাজার মানুষের। হামাসের তীব্র আক্রমণে অনেকটা কোণঠাসা ইসরাইলি বাহিনীকে এবার সামরিক স্থাপনার পরিবর্তে, উদ্বাস্তুদের নির্মূল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ সব ফিলিস্তিনিকে গাজা উপত্যকা ছেড়ে যেতে বলেছেন।

পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, গাজায় প্রচণ্ড ইসরাইলি বোমা বর্ষণের সময় সব ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। মানুষ প্রাণে বাঁচতে উত্তরের বাড়িঘর ছেড়ে দক্ষিণে চলে যেতে থাকে। তাদের লক্ষ্য ছিল ফিলাডেলফি বাফার জোন ও রাফা ক্রসিং। অনেকের আশা ছিল তারা মিসরে যাবে। কিন্তু মিসর সরকার ব্রাদারহুডের ভয়ে তাদের আসতে বারণ করেছে। আরো একটি প্রস্তাব ছিল, সিনাই উপত্যকায় বসবাস করার, সেটিও মিসর নিজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে, ফলে গাজার অধিবাসীরা রাফা ও ফিলাডেলফিতে থেকে যায়। তাদেরকে ইসরাইলের দক্ষিণে নেজেভ মরুভূমিতে স্থানান্তরের একটি প্রস্তাবও রয়েছে, সে বিষয়ে ইসরাইল কোনো মতামত দেয়নি।

ফিলাডেলফি করিডোর, যাকে ফিলাডেলফি রুট বা সালাদিন অক্ষ নামেও ডাকা হয়, গাজা স্ট্রিপ ও মিসরের মধ্যবর্তী সীমান্তজুড়ে অবস্থিত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জমির একটি সঙ্কীর্ণ ভূমি। ইসরাইলিরা এই জমিকে কোড নাম দিয়েছে ‘ফিলাডেলফি’। ১৯৭৯ সালে মিসর-ইসরাইল শান্তি চুক্তিতে এটিকে একটি বাফার জোন হিসেবে ধরা হয়। ফিলাডেলফির ইতিহাসও বেশ ঘোরানো প্যাঁচানো।

২০০৫ সালে গাজা থেকে ইসরাইলের একতরফা সেনা প্রত্যাহারের পর মিসরের সাথে ফিলাডেলফি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ওই চুক্তির আওতায় মিসর সীমান্তে টহল দেয়ার জন্য ৭৫০ জন সীমান্তরক্ষী মোতায়েন করে আসছে। সীমান্তের ফিলিস্তিনি অংশটি প্রাথমিকভাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রিত ছিল, কিন্তু ২০০৭ সালে নিয়ন্ত্রণ হামাসের কাছে চলে যায়।

১৯৭৯ সালের শান্তি চুক্তিতে বলা হয়েছিল, মিসরের সাথে সীমান্ত ম্যান্ডেটরি ফিলিস্তিনের সীমানা অনুসরণ করবে। নতুন সীমানাটি রাফা শহরকে দু’টি অংশে বিভক্ত করেছে, মিসরীয় রাফা ও ফিলিস্তিনি রাফা। রাফা গাজার প্রধান সীমান্ত ক্রসিংয়ে পরিণত হয়।

সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলটি (যা এরিয়া সি নামে পরিচিত) বেসামরিকীকরণ করা হয়েছিল, মিসর সেখানে কেবল পুলিশবাহিনী রাখতে পারত। ২০০৫ সালে গাজা থেকে ইসরাইল সরে গেলে করিডোরে মিসরীয় নিরাপত্তাবাহিনী টহল দেয়া শুরু করে। ফিলাডেলফি করিডোর মিসর-গাজা সীমান্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাফার জোন হিসেবে কাজ করে। এর সুরক্ষা এবং পরিচালনায় ইসরাইল ও মিসর উভয়ই রয়েছে। ফিলাডেলফি গাজার অর্থনীতি ও সমাজকে প্রভাবিত করে। ফলে বাণিজ্য, জীবিকা ও মানব সংযোগ উন্নত হয়। কিন্তু যুদ্ধ ও করিডোরে বিধিনিষেধ প্রয়োগের ফলে বাইরের বিশ্ব থেকে গাজার সামগ্রিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়, মানুষ ও পণ্যের চলাচলে সীমাবদ্ধতা এবং মানবিক পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে পড়ে। এখানে বসবাসরতদের বিধিনিষেধ দেয় ইসরাইল, মিসর ও হামাস- সবাই। বস্তুত ফিলাডেলফি করিডোরটি মিসর এবং গাজা স্ট্রিপের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ অবৈধ উপকরণ এবং মানুষের চলাচল রোধ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ইসরাইল গাজার সমস্ত সমুদ্র ও আকাশপথ নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০১ সালে ইসরাইল গাজা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়। ইসরাইল নৌ অবরোধ দিয়ে রেখেছে, তারা সামুদ্রিক ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ করে এবং অননুমোদিত জাহাজ গাজায় পৌঁছতে দেয় না। এ জন্য গাজাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত জেলখানা বলা হয়। ২০০৭ সালে হামাস ক্ষমতা দখলের পর গাজায় অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল।

রাফা ক্রসিং সরাসরি ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত না হলেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এটি বাইরের বিশ্বের প্রধান লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে। মিসর এই ক্রসিংটি পরিচালনা করে, তবে ইসরাইল তার কেরেম শালোম সামরিক ঘাঁটি ও অন্যান্য নজরদারি পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ গাজার সমস্ত কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে। মিসর ও ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস উভয়ই কৌশলগত তাৎপর্যের কারণে ফিলাডেলফি করিডোরের উপর ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণের তীব্র বিরোধিতা করছে।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার তীব্র বাসনা প্রকাশ করেছেন। নেতানিয়াহু জোর দিয়েছিলেন, অসামরিকীকরণ নিশ্চিত করার জন্য ফিলাডেলফি করিডোর বা গাজার দক্ষিণ স্টপেজ পয়েন্ট অবশ্যই ইসরাইলের হাতে থাকতে হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন ঘটনা মিসর-ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তির লঙ্ঘন। বাফার জোন নিয়ে টানাটানি করা বা সামরিকীকরণ করার আইনগত ভিত্তি নেই।
ইসরাইল ও মিসর ফিলাডেলফি করিডোরের ভবিষ্যৎ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করছে। ইসরাইলের দাবি, মিসর নিয়ন্ত্রিত সঙ্কীর্ণ জমিতে আধুনিক সেন্সর বসাতে হবে। এই সেন্সরগুলো ইসরাইলি কর্মকর্তাদের অবহিত করবে যদি করিডোরটি সীমান্তের সাথে আপস করার জন্য ব্যবহৃত হয়। মিসর মনে করে, করিডোরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ইসরাইলি হুমকি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে এবং দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান শান্তি চুক্তিকে বিপন্ন করেছে। বলতে হচ্ছে, ফিলাডেলফি করিডোরকে নেতানিয়াহু একটি বিতর্কিত অঞ্চলে পরিণত করেছে এবং মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে আঞ্চলিক সুরক্ষা এবং কূটনৈতিক সম্পর্কে আঘাত হেনেছে।

করিডোরটি গাজার ফিলিস্তিনিদের মিসরে প্রবেশের একমাত্র প্রবেশদ্বার। যদি ইসরাইল করিডোরের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে তবে সাধারণের চলাচল মারাত্মকভাবে সীমিত করবে, ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও পারিবারিক সাক্ষাতের মতো বিভিন্ন উদ্দেশে মিসরে যাওয়া বন্ধ করে আরেকটি মৃত্যুফাঁদ ও জাহান্নাম তৈরি করবে। করিডোরে ইসরাইলি বাহিনী ঘন ঘন সামরিক অভিযান চালাবে এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা নস্যাৎসহ বেসামরিক লোকদের জানমালের ক্ষতির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ইসরাইলের বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে তার অন্তরঙ্গ বন্ধুরাষ্ট্র মিসর বেশ উদগ্রীব। মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ইসরাইলের গোপন সহায়তায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে কিছু আরব রাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুতে পরিণত হন। মিসরই মুসলিম বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যেটি ইহুদিদের সাথে শান্তি চুক্তি করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। মিসর ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন আরব কূটনৈতিক বয়কট ভেঙে তার সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রথম আরব দেশ। সেই সিসি এখন ইসরাইলের প্রস্তাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

হেগে গণহত্যার শুনানিতে গাজায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহে বিলম্ব করার জন্য মিসরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে ইসরাইল। এমনকি মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এর প্রতিক্রিয়ায় তেল আবিবে নিযুক্ত মিসরীয় রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের সম্ভাবনার কথাও জানানো হয়েছে। উপরন্তু ইসরাইল অভিযোগ করেছে, মিসর গাজায় অস্ত্র চোরাচালানের অনুমতি দিয়েছে। এই হচ্ছে ‘অকৃত্রিম’ বন্ধুর সাথে ইসরাইলের আচরণ!
বাইডেন ও বোরেলের সতর্কবাণী সত্ত্বেও ১২ ফেব্রুয়ারি সোমবার ভোররাতে রাফা এলাকায় ব্যাপক হামলা চালায় ইসরাইল। ফজরের নামাজের সময় আলহুদা মসজিদ ও আররাহমা মসজিদে বোমা বর্ষণ করে। পুরো এলাকায় ৫০ বার বিমান হামলা চালায়, ফলে শিশু ও নারীসহ শতাধিক নিহত হয়, ডজন ডজন ঘরবাড়ি ছিন্নভিন্ন হয়। মসজিদে নামাজি ছাড়াও সাধারণ লোকজন আশ্রয় নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু ১৫ লাখ ফিলিস্তিনির ওপর চড়াও হন। আইডিএফকে প্রতিহত করার জন্য ফিলিস্তিনি নাগরিকরা অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ করে, হামাসও আক্রমণ চালায়। হামাসের চার ডিভিশন সেনা প্রতিরোধে অংশ নেয়।

অন্য দিকে, মিসর গাজা সীমান্তে ১০০টি ট্যাংক মোতায়েন করেছে। গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফা ঘিরে আইডিএফের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এগুলো মোতায়েন করা হলো। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গাজার সাথে মিসরের সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে ধারাবাহিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সিনাইয়ে প্রায় ৪০টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান পাঠিয়েছে মিসর। ৭৬৫ পদাতিক যুদ্ধযান রাফা সীমান্ত ক্রসিংয়ের মুখের কাছে সেনাবাহিনী যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘রাফায় প্রবেশ না করা মানে যুদ্ধে হেরে যাওয়া’।

ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ও হামাসের রুখে দাঁড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইলের সেনাদের অভিযান থমকে আছে মর্মে শেষ সংবাদ বেরিয়েছে। ইসরাইল আরো সামনে স্থলবাহিনীকে পরিচালনা করতে ভয় পাচ্ছে । দৃশ্যত নেতানিয়াহুর আরেকটি ফ্রন্ট তৈরি করা ভেস্তে গেছে।

হামাসকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য হিজবুল্লাহর পাঁচ দফা আক্রমণে উত্তর ইসরাইলের ৮০ হাজার বসতি স্থাপনকারী বাস্তুভিটা ফেলে আরো ভেতরের দিকে পালাতে শুরু করেছে। তাদের মিসাইলগুলো এবার গোয়েন্দা সরঞ্জাম ও অস্ত্রগুদামে আঘাত হেনেছে। উত্তর ইসরাইলে হিজবুল্লাহ এ যাবৎ মোট এক হাজার ১৩ বার হামলা পরিচালনা করে স্থলবাহিনীকে রুখে দিয়েছে। এখন শুধু ইসরাইলি বিমানবাহিনী মাঝে মধ্যে হামলা করছে। হুতিরাও লোহিত সাগরে হামলা জোরদার করেছে।

হামাস জানিয়েছে, রাফা আক্রান্ত হওয়ায় বন্দিবিনিময় আলোচনার ইতি হয়েছে। কায়রো বলেছে, বারবার সতর্কতা জারির পরও রাফা আক্রান্ত হওয়ায় ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তির অবসান হয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এই খবর প্রচার করে।
করিডোর ইস্যু সমাধানের জন্য দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চলছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে, যা ইসরাইলকে সীমান্তে সেনা উপস্থিতি ছাড়াই প্রযুক্তিগত উপায়ে রুটের ওপর ‘নির্দিষ্ট প্রভাব’ প্রয়োগ করতে দিতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement