২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বইমেলা ও বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প

বইমেলা ও বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প - ফাইল ছবি

বাংলা একাডেমির বহুল আলোচিত একুশের বইমেলা প্রায় মধ্যগগনে। করোনার গজেন্দ্রগামিতায় দু’টি বছর, পরের দু’টি বছর ‘কী জানি কী হয়’ পরিস্থিতির পর এবারের বইমেলার আয়োজন অনুষ্ঠান বেশ জমে উঠেছে। এ সুবাদে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা ব্যবস্থায় চোখ বুলানোর কিছুটা অবকাশ মেলে। এটা অবশ্য বলার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি যে, বাংলাদেশের প্রকাশনা এখনো শিল্প হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির হিসাব মতে, বাংলাদেশে বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রকাশক-ব্যবসায়ী। তবে এসব প্রকাশকের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে কী পরিমাণ বই বের হয় তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না।

দেশে কয়েক হাজার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থাকলেও বই বিক্রি ও প্রকাশের সংখ্যা বিবেচনায় হাতেগোনা কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম শোনা যায়। তবে এসব প্রকাশকের অভিমত প্রকাশনাটা এখন শুধু মধ্যম আয়ের একটা ব্যবসা হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫ শতাংশ মধ্যপর্যায়ের প্রকাশনা শিল্প পরিবার (যেমন ইউপিএল, মুক্তধারা, মওলা ব্রাদার্স, আগামী, অন্যপ্রকাশ ইত্যাদি) ৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান (যেমন বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ইত্যাদি) ভিত্তিক, ৫ শতাংশ গ্রুপ (যেমন প্রথমা, পাঠক সমাবেশ ইত্যাদি) ভিত্তিক বাকি সব শৌখিন, মৌসুমি, ক্ষুদ্রপর্যায়ের প্রকাশক কিংবা বিক্রেতা। বইয়ের ক্রেতারাও বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত- বেশির ভাগ ক্রেতা সরকারি-বেসরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠান (৬০ শতাংশ), সাধারণ গ্রন্থাগার (৮ শতাংশ), শৌখিন পাঠক (৭ শতাংশ), হুজুগে পাঠক (১৫ শতাংশ), লেখকরা নিজে (১০ শতাংশ)। লেখকদের শ্রেণীবিন্যাস এরকম সারবান সাহিত্য রচয়িতা (১৫ শতাংশ), একাডেমিক, গবেষক ও বিশ্লেষক (১০ শতাংশ), সাময়িক উদ্দীপ্তকারী পাঠরোচক ফিকশন রচয়িতা (৩৫ শতাংশ), শৌখিন (১৫ শতাংশ), প্রচারসর্বস্ব-আহ্লাদি ও ভবঘুরে লেখক বা কবি (২৫ শতাংশ)।

বিগত এক দশকে বাংলা একাডেমির বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত, পরিবেশিত ও বিক্রীত বইয়ের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, সরকারি প্রণোদনায় উপলক্ষধর্মী প্রকাশনা ও বিক্রয়, পাঠকপ্রিয় ফিকশন প্রকাশ ও বিক্রয়কে সঙ্কুচিত করে চলেছে, একই সাথে সারবান ও সৃজনশীল রচনার প্রকাশ ও বিপণন, ক্রেতা বাজেটে চলছে মরাকাটাল। গোটা প্রকাশনা শিল্পকে উত্তর দক্ষিণ মেরুতে বিভক্ত করেছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের প্রকাশকদের মধ্যে বেড়েছে ব্যবধান, প্রাসাদ-প্রযত্নপ্রাপ্ত ডানপন্থী লেখকদের অগ্রগামিতায় সৃজনশীল অন্যান্য লেখকরা প্রকাশনায়, প্রকাশকের সৌজন্য লাভে এবং বিপণন পর্যায়ে কঠিন খট-খইট্যা আচরণের শিকার হয়েছেন। পাঠ্যপুস্তক রচনা, সম্পাদনা, প্রকাশনা এবং বিপণন একচেটিয়া কারবারে পরিণত হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক ও বিকাশমুখী আবহ উধাও হয়েছে প্রকাশনা শিল্পজগৎ থেকে। প্রকাশনার অন্যতম কাঁচামাল কাগজ আমদানি এবং প্রকরণ মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্ট কারিগর সবাই মৌসুমি ব্যস্ততার শিকার, দ্রব্যমূল্যেও অব্যাহত অগ্রগামিতায় মধ্যবিত্ত পাঠকের পকেট যেমন ফাঁকা মাঠে পরিণত হয়েছে, ক্ষুদ্র প্রকাশকদের করেছে আরো রিক্ত। সরকারি আনুকূল্য আর প্রণোদনা পকেটস্থ করেছেন সুযোগ সন্ধানীরা। এ বেদনা বঞ্চনার ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।

এটা তাই ঠিক যে, বই প্রকাশনার কয়েক দশকের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকার পরেও বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প ঠিক ততটা শক্তিশালী হতে পারেনি। কারণ এখানে এখনো বড় পুঁজির সমস্যা রয়েছে। অন্যান্য ব্যবসাতে ব্যাংকগুলো যেমন বিনিয়োগ করে প্রকাশনার ক্ষেত্রে তেমন বিনিয়োগের নজির নেই বললে চলে। ফলে এ ব্যবসা তোষামোদ, আনুগত্য ও প্রণোদনা-প্রত্যাশী হয়ে উঠছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব পাবলিকেশন্স হাউজ না থাকা, যথাযথ প্রচারণা না থাকা, বইয়ের জন্য কাগজ এখনো আমদানিনির্ভর হওয়াও কারণ হিসেবে উল্লিখিত হয়। প্রকাশকরা তাদের মুনাফার মূল অংশটা তুলে আনেন আদর্শিক প্রকাশনায় সরকারের বাজেটের বদান্যতায় এবং জনপ্রিয় লেখকের বই থেকে। অনেক সময় ওইসব লেখকের পুরোনো বইয়ের সংস্করণ এমনকি দেশের বাইরের কিছু জনপ্রিয় লেখকের বই প্রকাশ করে তাদের ঝুঁকিমুক্ত থাকতে হয়।
বর্তমান এ পরিস্থিতিতে অনেক ঐতিহ্যবাহী, মধ্যবয়সী ও নবীন-প্রকাশনীও তাদের ব্যবসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছেন না। ঠিক এ সময় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ থাবায় মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পে ঘটে গেছে এমন এক অনাকাক্সিক্ষত বিপর্যয়, যা পুরো একটি প্রজন্মের চেয়েও বেশি নিচে নামিয়ে দিয়েছে একে। উদ্যোক্তাদের ভাষ্যমতে, ইতোমধ্যে এ খাতে হয়ে যাওয়া ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রিন্টিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (পিআইএবি) ক্ষতির পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির ক্ষতি হয়েছে ৭৫০০-৮০০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ক্ষতি হয়েছে ২০০ কোটিরও বেশি।

মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প চলে মূলত বই, গার্মেন্টসের আনুষঙ্গিক, ওষুধ এবং খাদ্য আনুষঙ্গিক উপকরণ ও অন্যান্য ব্যবসায়িক দ্রব্যাদি দিয়ে। এর মধ্যে বইয়ের জন্য প্রিন্টিং প্রেস আছে দুুই হাজার, গার্মেন্টস আনুষঙ্গিকের জন্য দুই হাজার, খাদ্য সার্ভিসের জন্য ৫০০ এবং বাকিগুলো নানা ছোট-বড় ব্যবসায়িক কাজে নিয়োজিত। বাজেটে প্রকাশনা খাতের জন্য নেই বরাদ্দ। অনেকের প্রকাশিত কোনো সৃজনশীল বই বিক্রি হয় না। সরকার আদর্শিক রচনার পাশাপাশি সৃজনশীল অন্য বইগুলো বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিনে নেয়ার বরাদ্দ না দিলে এক পর্যায়ে অন্যান্য সৃজনশীল প্রকাশনার সম্ভাবনা ও বিকাশ মাঠে মারা যাবে। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

ঢাকায় প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত ও বই প্রকাশ শুরু হয় সিপাহি বিদ্রোহের সময়। ১৮৬০ সালে হরিশচন্দ্র মিত্র ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম সাহিত্যপত্র প্রকাশ করেন। যুদ্ধের পরেও এ বাংলার প্রকাশনা শিল্প গৌরবোজ্জ্বল ধারাতে পরিচালিত হয়ে আসছিল। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে পাঠক শ্রেণী তৈরি ও বাংলা বই প্রকাশনা বিকাশের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যাত্রা শুরু করে বাঙালির প্রাণের বইমেলা উৎসব। ষাটের দশক থেকে ঢাকার প্রকাশনা জগৎ খুব সাবলীল হয় উঠছিল। বহু প্রেসে স্থাপন করা হয় আধুনিক লাইনো ও মনোমেশিন। ছাপার মান হয় উন্নত। ধীরে ধীরে সৃজনশীল বই প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে দেড় শ’ বছরে পা রাখলেও কাক্সিক্ষত সাফল্য পায়নি বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ। তৈরি হয়নি উল্লেখযোগ্য পাঠক শ্রেণী। দিন দিন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি প্রকাশনার মান ও পাঠক। তাই দেশের প্রকাশনা শিল্পের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় বিনিয়োগ করছেন। প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়সী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খোশরোজ কিতাব মহল একসময় সাহিত্য, উপন্যাস, আইন, ইতিহাস ও গল্পের বিভিন্ন বই প্রকাশ করত, পাঠকের চাহিদাও ছিল অনেক। কিন্তু এখন আর তেমন চাহিদা নেই, তারা এখন বাংলা একাডেমি মেলাভিত্তিক কিছু বইসহ গল্প-উপন্যাসেরও অল্পসংখ্যক কিছু বই প্রকাশ করেন।

এটা ঠিক ‘ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় অনেকে ই-বুকের প্রতি নির্ভর হওয়ায় সনাতন প্রকাশনা শিল্পের অনেকটা ক্ষতি হচ্ছে, পাঠকও দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে সৃজনশীল বই প্রকাশ বাদ দিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বই, ফাইল, বুকলেট, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি ছাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে কমে যাচ্ছে বই প্রকাশ, হারিয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাঠক। দেশে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উপন্যাস ও শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বেশি এবং বিক্রিও হয় বেশি। কিন্তু সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পাঠকশ্রেণী গড়ে উঠছে না। প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের মধ্যে জনপ্রিয় লেখকের বই ছাড়া অন্যদের বই তেমন বিক্রি হয় না।

বাংলাদেশের প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তেমন বৈচিত্র্য আসেনি। যে কারণে পাঠকের অবস্থান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া ভালো বইয়ের পাঠক বৃদ্ধিতে শুরুতে যে প্রচার দরকার তা অনেক প্রকাশক করেন না। পাঠক বই সম্পর্কে আগাম তথ্য পান না, ফলে বইও আশানুরূপ বিক্রি হয় না। প্রকাশকদের মতে, ‘আমাদের দেশ ক্রমান্বয়ে অনেক গুণী লেখক হারাচ্ছে, কিন্তু ওই হারে নতুন লেখক তেমন সৃষ্টি হচ্ছে না, তাই বইয়ের পাঠকও বাড়ছে না। যেমন হুমায়ূন আহমেদ থাকতে তার বই দেড় থেকে দুই লাখ কপি অনেক প্রকাশক বিক্রি করতেন। পাঠকও ছিল অনেক। এছাড়া আগে যেমন তরুণ ছেলেমেয়েদের কাছে বই একটা বিনোদনের মাধ্যম ছিল, এখন কিন্তু কম্পিউটারই বিনোদনের মূল মাধ্যম হয়ে গেছে। কাম্পিউটারে ইন্টারনেটে সময় দিচ্ছে সবাই। তরুণ পাঠকের অনেকে বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।’ মেধাবী তরুণ পাঠকদেরও অভিমত ও পরামর্শ হলো, ‘বর্তমান অবস্থাতে পাঠকশ্রেণীকে বইয়ের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে হলে প্রকাশকদের বিকল্প ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। আর বর্তমান যেহেতু প্রযুক্তির যুগ তাদের কিছুটা প্রযুক্তিনির্ভরও হতে হবে। যেমন প্রকাশকরা যদি ই-বুক চালু করে তাহলে ইন্টারনেটে যারা সময় ব্যয় করছেন তাদের একটা অংশও আবার পাঠক হয়ে উঠতে পারে। প্রকাশকরাও ই-বুক বিক্রি করে অনেক লাভবান হতে পারেন।’

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement