২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ব্যাংক মার্জারে রাজনীতিকরণ নয়

ব্যাংক মার্জারে রাজনীতিকরণ নয় - ফাইল ছবি

ছোট অর্থনীতির দেশ হিসাবে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। দেশে ৬১টি ব্যাংক আছে যার ৫২টির প্রোডাক্ট ও সেবা অভিন্ন। অর্থনীতির নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সৃষ্ট অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরিচয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। ফলে নাজুক অবস্থায় পড়েছে গোটা ব্যাংক খাত।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাউন্ডনেসে ১৪১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম। অন্য দিকে, গ্লোবাল ইকোনমির গবেষণা মতে, বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ১৩৬ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম, যা ২০০৯ সালের তুলনায় ২২ ধাপ পিছিয়েছে। প্রভাবশালী তিনটি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে বা নেতিবাচক সঙ্কেত দিয়েছে।
পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেছেন, দেশের ১০-১৫টি ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এসব দুর্বল ব্যাংকের একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ হতে পারে উত্তম সমাধান।

দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার যুক্তি
বিবি’র মুখপাত্র বলেন, কোনো ব্যাংক পিসিএ’র পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে না পারলে মার্জারের মতো অপশনও বিবি’র থাকে। পিসিএ হলো ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্ক যা ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার, যেখানে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সঙ্কট কাটিয়ে তোলার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এটি তৈরি করা হয়। ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মধ্যেও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। দেরিতে সংরক্ষণ বা ডেফারেল সুবিধা নিয়েও মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি থেকে বেরোতে পারেনি অনেক ব্যাংক। নিট লোকসান গুনছে কিছু ব্যাংক। দেশের ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করেছে বিবি। ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে পিসিএ বাস্তবায়ন করতে না পারলে যেসব ব্যাংকের অবস্থা একেবারেই দুর্বল তাদের ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহ থেকে শুরু করে কার্যক্রমের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এর পরই দুর্বল এ ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত করার উদ্যোগ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকাররাও মনে করেন, একটা ভালো ব্যাংক খারাপ ব্যাংকের সাথে যুক্ত হলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাতে দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন আসতে পারে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এভাবে চলতে পারে না। এটা সিস্টেমের ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। দিন শেষে ব্যাংক হলো ইকোনমির হার্ট। সেটা রান না করলে দেশ চলবে না। খারাপ ব্যাংকের হয়তো ওভারঅল সিস্টেম ভালো নয়। সেখানে একটা ভালো ব্যাংক গিয়ে ওর দুর্বল জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে সার্বিক পারফরম্যান্স ইম্প্রুভ করতে পারে। বিশিষ্ট ব্যাংকার আনিস এ খান বলেন, দেশে ৬০টি ব্যাংকের জন্য ৬০ জন ভালো সিইও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে ব্যাংক তো দুর্বল হবেই। দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত হলে সেটি আরো বড় ও শক্তিশালী হয়। কারণ ভালো ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক থেকে তার মূলধন পাবে; আউটরিচ পাবে। অপারেটিং কস্ট কমবে। তবে প্রাপ্তির পাশাপাশি খারাপ ব্যাংকের ডিপোজিট, ঋণ, ব্রাঞ্চ, শাখাও ভালো ব্যাংকের অধীনে যাবে। বিশ্বের অনেক দেশে মার্জার একুইজিশন হয়েছে। খারাপ ও ভালো ব্যাংক একীভূত করলে ডিপোজিটর অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়ে কোনো ভোগান্তি হওয়ার কথা নয়।

প্রশ্ন আছে, মার্জারের জন্য বিবি জোর করতে পারে কি না। বিবি’র মুখপাত্রের মতে বিবি করতে পারে। আবার কোনো ব্যাংক চাইলে নিজেও করতে পারে। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো ব্যাংক ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩’ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সে ক্ষেত্রে, একীভূত করার নিয়মও সবার জন্য প্রযোজ্য। বিবি দেশের ব্যাংকগুলোকে সুযোগ দিয়ে ধারাবাহিকতা মেনে মার্জ করতে পারে। মার্জ না করতে চাইলে ইমিডিয়েট অপশন হলো, বিবি’র পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের মতো আরেকটা এনে তাদেরকে ব্যালেন্স শিট ঠিক করতে বলা। সেটা না হলে বিদ্যমান ম্যানেজমেন্ট ঠিক করতে হবে। কাজ না হলে বোর্ডও বদলানোর কথা ভাবতে হবে। সেটাও কাজ না করলে মার্জ। এ ক্ষেত্রে মার্জে আগ্রহী না হলে শেষমেশ ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু কোনো ব্যাংক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে তা দেশের জন্য ভালো উদাহরণ তৈরি করে না। বিশ্বের অনেক দেশের ব্যাংকিং খাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে ‘ব্যাংক মার্জার’ কনসেপ্ট।

মার্জারের অনেক সুবিধা থাকলেও সমস্যা হলো এতে অনেক স্টাফ চাকরি হারাবে। কারণ, কোনো ভালো ব্যাংক যখন খারাপ ব্যাংকের দায়িত্ব নেবে, তখন তারা স্বভাবতই কর্মী নিয়োগে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, যারা নিচ্ছে, তারা এক্সিস্টিং স্টাফদের রাখা নাকি ব্যাংককে রিঅর্গানাইজ করার শর্তে গ্রহণ করছে। তবে সাধারণত পুরনো কর্মীদের রাখার শর্তে একীভূত হতে রাজি হয় না কোনো ব্যাংক। কারণ, একটি ব্যাংক এ ধরনের বিপদের মধ্যে পড়ে কর্মীদের গাফিলতির জন্যই। তবে এটি মানবিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে।

মার্জারে চাকরি যাবে অনেকের। তার পরেও শুধু প্রাইভেট ব্যাংক না, সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ। এর আগে শিল্প ঋণ সংস্থা এবং শিল্প ব্যাংক মিলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হয়েছে। সেটা ভালোভাবে চলছে এখন। সোনালী, জনতা, রূপালী ব্যাংক এগুলোকেও এক সাথে করে দেয়া যেতে পারে। তাহলে এটি অনেক শক্তিশালী এবং বড় ব্যাংক হবে। একত্র করার সময় যাদের চাকরি যাবে, তাদের চলে যাওয়ার সময় টাকা-পয়সা দিয়ে দেবে। জাপানের ব্যাংক অব টোকিও-মিটসুবিশি ইউএফজি নামেও পরিচিত ব্যাংকটি তিনটি ব্যাংককে একীভূত করার পর এখন জাপানের সবচেয়ে বড় ব্যাংক।

একীভূত হলে গ্রাহকদের কী হবে সে প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খারাপ ও ভালো ব্যাংক একীভূত করা হলে ডিপোজিটর অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়ে কোনো ভোগান্তি হওয়ার কথা না। প্রাপ্তির পাশাপাশি খারাপ ব্যাংকের ডিপোজিট, ঋণ, ব্রাঞ্চ, শাখাও ভালো ব্যাংকের অধীনে চলে যাবে। মার্জ মানে খারাপ ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট আর ভালো ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট এক হবে। তখন ভালো ব্যাংককে ডিপোজিটরদের দায়িত্বও নিতে হবে। যে ব্যাংক দায়িত্ব নিচ্ছে, তারা যদি শক্তিশালী হয় এবং তাদের যদি ভালো গভর্নিং বডি থাকে, তাহলে গ্রাহক পর্যায়ে কোনো সমস্যা হবে না।

রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একীভূতকরণ
সাহসী সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকের মার্জারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিবি। বলছে, খেলাপিদের ধরতে কোনো বাছবিচার হবে না, দেখা হবে না কোনো রাজনৈতিক পদ-পরিচয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে ডলার লেনদেনের নতুন পদ্ধতি ক্রলিং পেগ বাস্তবায়ন, কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ধার দেয়া, পিসিএ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে প্রস্তুতি নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মামলায় আটকে থাকা বিপুল অঙ্কের খেলাপির টাকা আদায়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে কীভাবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা নির্ণয় করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা দেয়া আছে।

খারাপ ব্যাংকের তালিকায় রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংক বাছবিচার ছাড়াই বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। গ্রাহকের আমানতের টাকা নির্বিচারে ঋণ দেয়ায় ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট চরমে। অনেক ক্ষেত্রে অন্য ব্যাংকের সাথে সমন্বয় করে তারল্য সহায়তা নিতে হচ্ছে। সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম চলছে। কিছু ব্যাংক বিপর্যয়ের মধ্যে। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়েছে। এসব সংস্কারে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে ব্যাংক খাতে দ্রুত সুশাসন ফেরাতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুশাসন ফেরাতে গভর্নর কাউকে ছাড় না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। এর জন্য দরকারি সব পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ব্যাংকের সুশাসন ফেরাতে বিবি একটি কমিটি গঠন করেছে। তারা একটি অ্যাকশন প্ল্যান ঠিক করে সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছে। খেলাপিদের ধরতে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না বলেছে। মামলায় আটকে থাকা অর্থ আদায়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী ব্যাংকিং পরিচালনা হবে। অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপিদের রাজনৈতিক ছাড় না দিলে খেলাপি কমবে। তখন তারল্য বাড়বে। তবে দেরি হয়ে গেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক ধরে আগাতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পরিশেষে বলতে হয়, দেশের অর্থনীতির সব সেক্টরে বেহাল দশা। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি এতটা সঙ্কটে পড়েনি। এই সঙ্কটের বিভিন্ন কারণ থাকলেও মূল কারণ দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতি হয়েছে দেশের সব কার্যক্রমে রাজনীতিকরণের ফলে, অর্থাৎ সুশাসনের অভাবে। এই সত্যিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বীকার করেই বলেছে, ব্যাংকিং সেক্টর রক্ষায় ব্যাংক একীভূতকরণ করা হবে রাজনীতিমুক্তভাবেই। সত্যিই যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা সরকার রাজনীতিমুক্তভাবে দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণ করতে পারে তাহলে দেশের অর্থনীতি রক্ষা পাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে দুর্বল ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দুর্বল হলেও ক্ষমতায় দুর্বল নয়। বরং এরা ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যাংকিং লাইসেন্স পেয়ে, দুর্নীতি করে অর্থ পাচার করে দুর্বল হয়েছে। এই ক্ষমতাবান ব্যাংক মালিকরা যেন সবল ব্যাংকের সাথে মার্জ হয়ে সবল ব্যাংকগুলোকে আবার দুর্বল না করে ফেলে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
কুয়েত সফরে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে ভূষিত মোদি তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী চুরিতে মৃত্যুকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে প্রচার পিটিআইয়ের অনুসন্ধান শুরু দুদকের রাস্তা অবরোধে দুর্ভোগে রোগীরা রাজধানীতে পুলিশে শৃঙ্খলা ফেরেনি, বেপরোয়া দুর্বৃত্তরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার তদন্ত ৩ মাসের মধ্যে শেষ হবে সাধারণ মানুষ সংস্কার বোঝে না, তারা ভোট দিতে চায় : ফখরুল সরকারের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক দল চায় না বিএনপি আরাকান আর্মির সাথে সরকার আলোচনা করতে পারে না : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সিলেটে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সভায় ডা: শফিক

সকল