চাতুরী রাজনীতিতে চলে, অর্থনীতিতে না
- রিন্টু আনোয়ার
- ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:০৮
বিদ্যুৎ নিয়ে বড়াই ছিল আকাশছোঁয়া। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের গগনকাঁপানো প্রচারণা চালিয়ে বলা হয়েছিল, লোডশেডিং জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ লাগবে-বিদ্যুৎ লাগবে আবৃত্তি করে শোনানো হয়েছিল, ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ ফেরি করার কথা। ফেরি করা সেই বিদ্যুৎ গেল কোথায়? জাদুঘরের লোডশেডিং আবার উঁকি দিচ্ছে কোত্থেকে? গ্যাস নিয়েও বড়াই কম হয়নি। বাস্তবতা আড়াল করা হচ্ছে এখনো।
চলমান গ্যাসসঙ্কটের প্রভাব বিদ্যুৎ খাতেও পড়তে শুরু করেছে। এটাই স্বাভাবিক।
আসন্ন গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদার বাড়বাড়ন্ত সময়ে গ্যাস সঙ্কট কী রূপ নিতে পারে? শীতকালে চাহিদা ও ব্যবহার তুলনামূলক কম থাকার পরও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটছে। গরমের সময় পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তা ভেবে সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ক’দিন আগে গ্যাস সরবরাহে দেখা দেওয়া আকস্মিক গোলযোগ এখনো পুরো সারানো যায়নি। এর সমাধান না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কোন পর্যায়ে যাবে- এ নিয়ে নানা শঙ্কা চারদিকে। বাসাবাড়ির পাশাপাশি শিল্পকারখানার উৎপাদনে এরই মধ্যে বেশ ধাক্কা পড়েছে। বাংলাদেশে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানি করা এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের পর পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দু’টি ভাসমান টার্মিনাল রাখা হয়েছে, যেগুলো ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ নামে পরিচিত। একটিতে সংস্কারজনিত আরেকটিতে কারিগরি ত্রুটির কারণে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। তা মোটামুটি সারানো হলেও ধাক্কার জের চলছে এখনো।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, বর্তমানে দৈনিক গড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট। গ্রীষ্মে ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো চাহিদা দেখা গেলেও এবার সেটি সাড়ে ১৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হতে পারে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। বিপুল পরিমাণ এই বিদ্যুতের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদার বিপরীতে এখন গ্যাসের সরবরাহ হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো। এই মুহূর্তে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক উত্তোলন হচ্ছে কমবেশি দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস। আর পাঁচশ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা অনুযায়ী দৈনিক সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি সম্ভব। এখনকার চাহিদা পূরণে আমদানি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
পেট্রোবাংলার হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদাই হবে এবার দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। তবে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক চাহিদা ২২৪০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ হচ্ছে সাড়ে সাতশ-আটশ এমএমসিএফডি গ্যাস। অর্থাৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ৪০ শতাংশের মতো। গ্যাসের চলমান সঙ্কট অব্যাহত থাকলে গরমকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চরমে পৌঁছার আশঙ্কা এ কারণেই।
ডলার সঙ্কটের কারণে গ্যাসসহ আরো অনেক কিছু আমদানির ক্ষেত্রে চলছে বড় ধরনের স্থবিরতা। এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধানও নেই। এ অবস্থায় জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলা এবং আমদানি করে চাহিদা পূরণ করাই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় এবার কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর দিকে সরকারের নজর বেশি। বাংলাদেশে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়। কয়লার বড় অংশ আসে বিদেশ থেকে। ডলার এবং আমদানি সেখানেও প্রাসঙ্গিক। ডলার সঙ্কটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারায় গত বছর রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশ কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। নিজেদের কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি মিলিয়ে সরকার এর সমাধান আশা করছে। আবার নিজস্ব গ্যাস থেকে কিছু রেশনিংয়ের কথাও ভাবছে সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে দেশে যেখানে বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় চরম গ্যাসসঙ্কট চলছে, সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত গ্যাসের ব্যবহার সঙ্কট নিরসন না আরো তীব্র করবে এ প্রশ্ন গুরুতর।
যেখানে রান্নার চুলায়ই গ্যাস সরবরাহে গোলমাল, সেখানে এত বারোয়ারি পরিকল্পনা অনেকের কাছে হাস্যকর। রান্নার গ্যাস ছাড়াও সিএনজি, শিল্পকারখানা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে দেশে গ্যাসসঙ্কটের তীব্রতা ঢাকা দেয়ার কোনো উপায় নেই। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অর্থনীতির জন্য পাঁচটি ঝুঁকির মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে জ্বালানি স্বল্পতার উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবতা কতক্ষণই বা লুকানো যায়। সঙ্কটটি তো প্রকাশ্য। ধারণা বা অনুমাননির্ভর নয়। আবার গ্যাসের চুলা না জ্বললেও বাজারের দাউ দাউ আগুন প্রকাশ্য। এর উত্তাপ সবার গায়ে লাগছে। একে স্বাভাবিক বা তেমন কিছু নয় প্রমাণ করতে কত যে অজুহাত। বৈশ্বিক দোহাই। মানুষের মাথাপিছু আয়-ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রমজান, ঈদ-চাঁদ। যুদ্ধ, শীত, মহামারী, ডলার সঙ্কট, রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো কত কী? মুনাফা শিকারি বা সরকারের ব্যর্থতার কথা বলা যাবে না। পাকিস্তানিরা যা পারেনি, তা করে ছাড়ছে কতেক স্বদেশি। বঙ্গ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরো জোরদার হবার প্রেক্ষিত তৈরি করতে পেরেছে তারা। এতে দেশের কী সর্বনাশ হচ্ছে, সরকার কোন দুর্গতিতে পড়ছে তা তাদের দেখার বিষয় নয়। তারা সওয়ারি মাত্র। সওয়ার হয়েছে সরকারের ওপর। পরিস্থিতি উতরাতে গিয়ে এদিক টানলে ওদিক ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থা। বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট কাটাতে ১৮ কোটি মানুষের মোট চাহিদার বিপরীতে আমদানি কড়াকড়ি করেছে সরকার। বিগত এক-দেড় বছরে সব পণ্যের (চাহিদার ১০০ শতাংশ - আমদানির স্থলে) ২০ শতাংশ কমে গিয়ে ৮০ শতাংশ আমদানি হয়েছে। চলতি তিন মাসে আমদানি আরো ৩০ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ ১০০ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৬৭ শতাংশ দিয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষ বিগত দিনগুলোতে তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েছে। তা করেছে নির্ধারিত আয়ের বাইরে বিকল্প পথে বা ধারদেনা করে। অথবা ক্রয়ক্ষমতা হারানোর ফলে ব্যক্তির বা পরিবারের মাত্রাতিরিক্ত কৃচ্ছ্রসাধনে।
হিসাবের এ ফাঁকফোকর ও অর্থসঙ্কটের সুযোগটাই নিচ্ছে বন্ধুরূপী বিদেশীরা। চীন আরো আরো দেবে বলে জানান দিচ্ছে। ডলারসঙ্কটে পাশে দাঁড়াবে বলে আগ বাড়িয়ে ভরসা দিচ্ছে। আমরা এগুলোকে পজিটিভ সংবাদ হিসেবে প্রচার করছি। আমাদের যখন সঙ্কটই নেই, তখন চীন বা অন্য কোনো দেশ সহায়তার আশ্বাস দেয় কেন? এই সাহস কই পায় তারা? আমাদের ফাঁক বা লুকোচুরির সুযোগে? রিজার্ভ কমে বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে যাওয়ার তথ্য কতক্ষণ লুকানো যায়? এ সঙ্কট উত্তরণে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ছে না বা বাড়ানো যাচ্ছে না। আমদানির চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন রিজার্ভের খুব খারাপ বার্তা দিচ্ছে। তাদের হিসাব মতে, ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভ কমে ঠেকেছে দুই হাজার ৫৩৩ কোটি (২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন) ডলারে। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী বিপিএম-৬ মেথডের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ৫২১ কোটি (৫.২১ বিলিয়ন) ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ এখন দুই হাজার দুুই কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। ২১ দিনে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৭৭ কোটি ডলার (১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) এবং বিপিএম-৬ অনুযায়ী কমেছে ১৭২ কোটি ডলার (১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন)। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৯.৭৩ বিলিয়ন ডলার আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২৩ দশমকি ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়, প্রকাশ করা হয় না।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা অহরহ বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতে গতি আনতে যেসব সংস্কার দরকার, তার অনেক কিছুই করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সংস্কার কিভাবে হবে? সাধারণ মানুষের ওপর তার প্রভাব কেমন হবে? কর আদায় বাড়াতে গিয়ে যদি নি¤œআয়ের মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়, জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দরে যদি মূল্যস্ফীতি আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে সেই সংস্কারে চলমান বৈষম্য আরো বাড়াবে। তথ্যের লুকোচুরি ভালো কাজ নয়। হিসাব প্রকাশ-অপ্রকাশ, প্রদর্শন-অপ্রদর্শনের এ কানাগলিতে যা হওয়ার হয়ে চলছে। তথ্যের লুকোচুরি বিপদ ডেকে আনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ধার করে ঘি খাওয়ার ফুটানির পরিণতিও ভালো হয় না। রাজনীতির মাঠে ছলচাতুরী চলে। তাতে অনেক সাফল্য দেখানো যায়। কিন্তু অর্থনীতিতে তা অচল।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা