২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
শবেমেরাজের কথা

যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য

যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য - ফাইল ছবি

(শেষ পর্ব )

যুক্তির আলোকে মেরাজ : নবীজি সা:-এর পক্ষে এ ধরনের মেরাজে গমন যে সম্ভব এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তদুপরি নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করলে এর বাস্তবতা আরো পরিষ্কার হবে বলে আমার বিশ্বাস :
ক. মহান আল্লাহ তায়ালা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তিনি শুধু বলেন ‘হও’ ওমনি তা হয়ে যায়। সেই মহান স্রষ্টা নিজেই বলেছেন তিনি তাঁর রাসূলকে মেরাজে নিয়ে গিয়েছিলেন।

খ. একটি ঘড়িতে রাত ১০টা বাজার সাথে সাথেই বন্ধ করে দিয়ে পরে এক বছর পরও যদি ঘড়িটি পুনরায় চালু করা হয় তখন ঘড়িটি ঠিক রাত ১০টা থেকেই তার পরবর্তী যাত্রা শুরু করবে। একই রকমভাবে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বা নিজ কক্ষপথের চারদিকে ঘূর্ণায়নকে বন্ধ করে দিয়ে হাজার বছর পরও পুনরায় চালু করলে পৃথিবী ঠিক ওই স্থান থেকেই যাত্রা শুরু করবে। এ ধরনের একটি অবস্থা ঘটানো আল্লাহ পাকের পক্ষে সহজেই সম্ভব। অবশ্য এর আসল রহস্য আল্লাহ পাকই ভালো জানেন।

গ. নবীজি সা: সত্যবাদিতার জন্য ছোটবেলা থেকেই ‘আল আমিন’ বা বিশ্বাসী উপাধি লাভ করেছিলেন। নবুওয়ত পেয়ে ইসলামের দাওয়াত শুরুর পর মক্কাবাসী তাঁর বিরোধিতা করলেও তাঁর প্রতি তাদের পরিপূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস অটুট ছিল। এমনকি তিনি হিজরত করে মক্কা ছেড়ে মদিনায় যাওয়ার সময়ও মক্কার অনেকের মালামাল তাঁর কাছে গচ্ছিত ছিল যা তিনি ফেরতদানের জন্য হজরত আলী রা:-কে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলন। এমন বিশ্বাসী নবী জীবনে কখনো মিথ্যা বলেননি।
তিনি এই একটি ব্যাপারে কেনইবা মিথ্যা বলতে যাবেন? যিনি মেরাজের ঘটনার আগেও কোনো মিথ্যা বলেননি এবং এর পরও কখনো মিথ্যা বলেননি বলে বিশ্ববাসী ভালোভাবেই জানে।

ঘ. ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই নবীজি সা: বিরোধিতার সম্মুখীন হন। পর্যায়ক্রমে মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমান ছাড়া পুরো মক্কা নগরী তথা আরব বিশ্ব তাঁর বিরোধিতা শুরু করল। এমন একটি সম্পূর্ণ বিরোধী পরিবেশে তিনি কেনইবা এমন অলীক গল্পের অবতারণা করতে যাবেন? এটি বিরোধিতার মৌচাকে ঢিল ছোড়া নয় কি?
ঙ. কাফেরদের বিরোধিতাও মেরাজের বাস্তবতা প্রমাণ করে। তিনি যদি বলতেন এটি স্বপ্নের ঘটনা তাহলে কোরাইশরা সবাই তা মেনে নিত। কারণ, স্বপ্নযোগে আরো দূরেও ভ্রমণ করা সম্ভব। কাজেই তিনি সত্যিকারার্থেই মেরাজে গিয়েছিলেন বলেই অজ্ঞ ও মূর্খ অবিশ্বাসীরা কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারেনি।

মেরাজের তাৎপর্য
রাসূলুল্লাহ সা:-এর মনোবল বৃদ্ধিকরণ : নবীজি সা: দীর্ঘ প্রায় ১২টি বছর ধরে মক্কার মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু অল্প কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করলেও অধিকাংশ লোকজন তাঁর বিরোধিতা করতে থাকল এবং তাঁকে অত্যাচার-নির্যাতনে জর্জরিত করে তুলল। এমনকি তারা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করতে লাগল। এমতাবস্থায় মক্কায় আর কোনো নতুন লোকের ইসলাম গ্রহণের সম্ভাবনা ক্ষীণ মনে হচ্ছিল। ফলে তিনি পার্শ্ববর্তী নগরী তায়েফে গমন করলেন। কিন্তু তায়েফবাসীও তাঁকে উল্টো আহত করে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়। এদিকে মক্কার সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং তাঁর নিরাপদ আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালেব মৃত্যুবরণ করেন। সেই সাথে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী এবং সব সুখ-দুঃখের ভাগীদার হজরত খাদিজা রা:-ও তাঁকে ছেড়ে চিরবিদায় নেন। এমতাবস্থায় নবীজি সা: একেবারে আশ্রয়হীন অবস্থায় দুঃখের দরিয়ায় পড়ে যান। এ ধরনের একটি পটভূমিতে মহান আল্লাহ পাক তাঁকে মেরাজে নিয়ে যান যেন তাঁর প্রচারের সব বিষয়াদি স্বচক্ষে দেখে তাঁর মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং গভীর শোকের কিছুটা লাঘব হয়।

রাসূল সা:-কে সর্বজনীন নেতৃত্বে অধিষ্ঠিতকরণ : মেরাজে আমাদের প্রিয় নবীজি সা:-এর এই ধরার ধূলি থেকে এক রাতের মধ্যে ঊর্ধ্ব জগতে আরোহণ করে আল্লাহ পাকের দরবার পর্যন্ত পৌঁছা এক মহা সম্মান ও স্বীকৃতির ব্যাপার। এই সম্মান তাঁকে পুরো বিশ্ব মানবতার নেতৃত্বে সমাসীন করার নিদর্শন বা ইঙ্গিত। তা ছাড়া সব নবীদের জামাতে তাঁর ইমামতি করাও একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এতে তাঁকে সব যুগ ও জাতির নেতৃত্ব দিয়ে তাঁর নেতৃত্বের সর্বজনীনতাও প্রমাণিত হয়েছে।

হিজরতের প্রস্তুতি : মেরাজের প্রায় এক থেকে দেড় বছর পরই নবীজি সা:-এর হিজরত সংঘটিত হয়। হিজরত করে মদিনায় পৌঁছার সাথে সাথেই তাঁর আন্দোলন নতুন দিগন্তে মোড় নেয়। ইসলামী বিপ্লবের পালে হাওয়া লেগে বিপ্লব পায় নতুন মাত্রা ও গতিবেগ। দ্রুত মক্কার কোরাইশরাসহ পুরো আরব বিশ্ব মুসলমানদের বিরোধী শিবিরে ঐক্যবদ্ধ হয়। এমনকি তৎকালীন দুই পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যও বিরোধিতার ঐক্যে শরিক হয়। এসব বিরোধী শক্তি একযোগে মোকাবেলায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যে ধরনের হিম্মত, মনোবল, সাহস ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন ছিল তা অর্জিত হয়েছে এই মেরাজের মাধ্যমে।

মুসলমানদের যাচাইকরণ : হিজরতের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যে ধরনের শক্ত ঈমানদার মুসলমানের দরকার তাদেরকে আগেই বাছাই করা প্রয়োজন ছিল। কারণ দুর্বল ঈমানের লোকজন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে পুরো মুসলমান সমাজকে বিপদে ঠেলে দিতে পারত। কাজেই এই মেরাজের পর দুর্বল ঈমানের কিছু কিছু মুসলমান এটিকে অবিশ্বাস করে ইসলাম পরিত্যাগ করার মাধ্যমে এই বাছাইয়ের কাজটি সহজে স¤পন্ন করে দেয়।

ইসলামী সমাজগঠনের পূর্বপ্রস্তুতি : সর্বোপরি রাসূলুল্লাহ সা:-এর মেরাজ ছিল একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম ইসলামী সমাজ এবং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তুতিমূলক অভিযান। পৃথিবীতে যেমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান তার কোনো রাজ্যে নতুন গভর্নর বা শাসক বা প্রতিনিধি প্রেরণের আগে তাকে রাজদরবারে ডেকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনি এই পৃথিবীর মালিক তাঁর প্রিয় রাসূলকে মদিনায় হিজরত করে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি গঠনের আগে তাঁকে ডেকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্রিফিং দিয়েছেন। যে ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হতে যাচ্ছে তার সংবিধান, আচরণবিধি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, পারিবারিক নীতি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, নিরাপত্তা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি কিভাবে চলবে তা আল্লাহ পাক নবীজি সা:-কে জানিয়ে দেন। যা মেরাজ থেকে ফিরেই মহানবী সা: সূরা বনি ইসরাইলের ২২ থেকে ৩৫ নং আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। সেগুলো নিয়ে বর্ণনা করা হলো :

১. তিনি (আল্লাহ) ভিন্ন আর কারো দাসত্ব করা যাবে না।
২. পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ কথাটি পর্যন্ত বলা যাবে না। ধমক দেয়া যাবে না। তাদের উভয়ের সাথে অত্যন্ত সম্মানসূচক এবং বিনম্রভাবে কথা বলতে হবে।
৩. আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দিতে হবে।
৪. কোনো অবস্থাতেই অপব্যয় করা যাবে না।
৫. সাহায্যপ্রার্থীদের সাথে বিনম্র আচরণ করতে হবে।
৬. অর্থনীতির ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। কৃপণ হওয়া যাবে না আবার অপচয়কারীও হওয়া যাবে না।
৭. অভাবের ভয়ে সন্তান-সন্ততিকে হত্যা করা যাবে না।
৮. ব্যভিচারের ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না, এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট আচরণ।
৯. অন্যায়ভাবে কোনো জীবনকে হত্যা করা যাবে না।
১০. এতিমের ধন-স¤পদ আত্মসাৎ করা যাবে না।
১১. প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে।
১২. পরিমাপ এবং ওজন পূর্ণ করে দিতে হবে।
১৩. যে বিষয় জানা নেই, আন্দাজ অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তার পেছনে লেগে যাওয়া যাবে না।
১৪. আল্লাহর জমিনে কখনো দম্ভভরে চলা যাবে না। কেননা, কেউ জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না, আর উচ্চতায়ও কখনো পর্বতের সমান হতে পারবে না।

উপসংহার
মক্কাবাসীদের বিরোধিতার তীব্রতা বৃদ্ধি, তায়েফবাসীদের নির্যাতন, নিরাপদ আশ্রয় চাচা আবু তালেব ও প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজা রা:-এর ইন্তেকাল ইত্যাদি কারণে নবীজি সা:-এর জন্য মক্কার জমিন সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছিল। ইত্যবসরে মদিনায় ইসলামের উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে শুরু করে। এমনি এক সন্ধিক্ষণে মহান রাব্বুল আলামিন নবীজি সা:-কে বিশেষ বাহনের মাধ্যমে মক্কা থেকে মদিনা এবং মসজিদে আকসা হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যান। তিনি সেখানে পূর্বতন নবী-রাসূলদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, বেহেশত-দোজখ স্বচক্ষে অবলোকন করেন এবং আল্লাহ পাকের কাছ থেকে মুসলিম তথা বিশ্ববাসীর জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা গ্রহণ করেন। এই পুরো বিষয়টিই একসাথে মেরাজ নামে পরিচিত। রাসূল সা: সশরীরে এক রাতের মধ্যে ওই ভ্রমণ স¤পন্ন করেন তা নিঃসন্দেহ। এই ভ্রমণের মাধ্যমে নবীজি সা:-কে বিশ্ববাসীর সর্বজনীন নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করানো হয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ পাকের কাছ থেকে প্রাপ্ত সওগাতসমূহ আমাদেরকে হৃদয় দিয়ে বরণ করে নিতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথভাবে আদায়, নবীজি সা:-এর আদর্শকে চলার পথ হিসেবে গ্রহণ এবং সমাজগঠনের যে আদেশ-নিষেধগুলো তিনি মেরাজের পর বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেছেন সেই আলোকে সমাজ গঠন করতে পারলেই পরকালে জান্নাতে যাওয়া তো সম্ভব হবেই, তদুপরি এই পৃথিবীতেই বেহেশতি সুখের অবতারণা ঘটবে ইনশাআল্লাহ। আমিন।

তথ্যসূত্র :
১. তাফসির ইবনে কাসির, ত্রয়োদশ খণ্ড, তাফসির পাবলিকেশন কমিটি, ঢাকা-১৯৯৮।
২. তফসিরে নূরুল কুরআন, পঞ্চদশ খণ্ড, আল-বালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা-১৯৯২।
৩. তাফসির ফি সিলালিল কুরআন, ১৩তম খণ্ড, আল কুরআন একাডেমি লন্ডন-১৯৯৮।
৪. Safi-ur-Rahman al-Mubarakpuri, AR-RAHEEQ AL-MAKHTUM Dur-us-Salam Publications, Kingdom of Saudi Arabia, 1996.
৫. আকরাম ফারুক, সিরাত ইবনে হিশাম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা।
৬. তাফহিমুল কুরআন, সপ্তম খণ্ড, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা-১৯৯৭।
৭. পবিত্র কুরআনুল কারিম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির), খাদেমুল-হারামাইন শরিফাইন বাদশা ফাহদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদিনা মুনাওয়ারা, ১৪১৩ হি:।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement