আত্মহত্যা প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩০
পৃথিবীতে মৃত্যুর চতুর্থ কারণ আত্মহত্যা। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩২ জন আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের জীবন শেষ করে দেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস ও ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক- যথাক্রমে জান্নাতুল ফেরদৌস এবং এ এস এম মাহবুবুল আলমের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তেমনটি উঠে এসেছে। আত্মহত্যাকারীদের বেশির ভাগের বয়স চল্লিশের নিচে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা যায়, ২০২৩ সালে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার ভেতর ৬০ শতাংশ নারী। কিছু দিন আগে আঁচল নামে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা একটি আশঙ্কাজনক তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটির দেয়া তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর ভেতর বেশির ভাগ (৩০৯ জন) নারী শিক্ষার্থী। ৫১৩ জনের ভেতর ২২৭ স্কুলশিক্ষার্থী; যা সামগ্রিক সংখ্যার ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ। কলেজশিক্ষার্থী ১৪০ জন, যা সামগ্রিকভাবে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ার সংখ্যা ৯৮ জন, যা সামগ্রিক হিসাবের ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। মাদরাসাপড়–য়াদের সংখ্যা ৪৮ জন, অর্থাৎ ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অভিমান। যা বিভিন্ন সময়ে খবরে উঠে এসেছে।
ঈদে নিজের পছন্দমাফিক পোশাক পায়নি বলে, পরীক্ষায় ফল ভালো না হওয়ায়, মা-বাবার বকুনি খেয়ে অভিমানে আত্মহত্যার খবর প্রায় শোনা যায়। আবার যৌননির্যাতনের কথা কাউকে বলতে না পারার লজ্জায় আত্মহত্যার ঘটনাও কম নয়। আঁচল প্রদত্ত তথ্যে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে তা হলো- স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে; যা রীতিমতো ভয়াবহ। আর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মাদরাসাপড়–য়াদের ভেতর এ হার অনেক কম। কারণ ইসলামী জীবনাচার। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের মধ্যে যেসব পরিবারে ধর্মীয় রীতি মেনে চলার নিয়ম রয়েছে তাদের ভেতরেও আত্মহত্যার প্রবণতা কম। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসন আত্মহননের চিন্তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনেও আত্মহত্যার কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- অভিমান, প্রেমঘটিত কারণ, অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ, সহকারী, বন্ধু-বান্ধব, সমবয়সীদের দ্বারা অপমানিত হওয়া, পরিবারের-অশান্তি, মাদকে অভ্যস্ত হওয়া, পড়াশোনায় ভালো ফল করতে না পারার গঞ্জনা- সর্বোপরি সামাজিক অস্থিরতা ও সমাজবিচ্ছিন্ন একক পরিবার আত্মহতার মনোভাব সৃষ্টিতে সাহায্য করছে। বাড়িতে বাবা-মা দু’জন চাকরিজীবী হওয়ার সুবাদে ঘরে নীরব একাকিত্বের যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেক শিশু-কিশোর আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহননের পথে পা বাড়ায়। যৌথপরিবারে এ প্রবণতা একক ছোট পরিবারের তুলনায় অনেকাংশে কম। অপরদিকে, যে সব পরিবারে ধর্মীয় আচার-আচরণের রীতি চালু আছে, সে সব পরিবারেও এ প্রবণতা কম দেখা যায়। বস্তুত আত্মহত্যা একটি বিধ্বংসী প্রবণতা- যা একটি পরিবার ও সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আত্মহত্যা করার সাথে সাথে আত্মহত্যাকারীর পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে এক ধরনের মানসিক বিষণ্নতা দেখা যায়।
প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা সমাজকে একটি বার্তা দিয়ে যায়; আর তা হচ্ছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অনাচার, দুনীতি- সব কিছুর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার ব্যর্থতা। পারিবারিক সম্পর্কের শিথিলতা, শঠতা, শিশুর প্রতি উদাসীনতা- শিশুদের বিতৃষ্ণ করে তোলে। তাদের ভেতর দানা বাঁধে বিষণ্নতা এবং একাকিত্বের দহন। যার পরিণতি আত্মহত্যা। উঠতি বয়সী শিশু-কিশোর-কিশোরীরা স্বভাবত আবেগী হয়ে থাকে, অভিমানী হয়। তারা নিজেকে সামান্য অবহেলিত কিংবা অপাঙক্তেয় মনে করলে আগাগোড়া না ভেবে জীবন শেষ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে বাবা-মা, ভাইবোন এবং পরিবারের সবাইকে সহনশীল আচরণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া, তাদের দুঃখ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়াগুলো বোঝা এবং বোঝানো; যেন তারা নিজেকে অবহেলিত, অপাঙক্তেয় মনে না করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে; যা রীতিমতো উদ্বেগের কারণ। আত্মহত্যার দায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। আত্মহত্যার কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। পরিবার পর্যায়ে আরো সতর্ক ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সমাজ ভেঙে যাওয়া, প্রিয়জন হারিয়ে মানসিক অস্থিরতা মানুষকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। মারাত্মক রোগ বা শারীরিক সমস্যার কারণেও মনে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে! যেকোনো কারণে হোক না কেন, হতাশা মারাত্মক পর্যায়ে গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি করে, যা একসময় আত্মহত্যায় রূপ নেয়। জরুরি ভিত্তিতে এ প্রবণতাকে ঠেকানো দরকার।
এ ক্ষেত্রে পরিবারের যেমন ভূমিকা আছে তেমনিভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায় আছে। ভূমিকা আছে বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও সহযোগীদের। অর্থাৎ এটি একটি সামষ্টিক কর্মযোগ। বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্তে জানা যায়, আত্মহত্যাকারীরা বেশির ভাগ কোনো না কোনো ধরনের মানসিক যন্ত্রণা ও বিষণœতায় ভোগেন- নির্জন একাকিত্বে ভোগেন। ফলে তাদের ভেতরে এক ধরনের আত্মহননের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে এ প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক- অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে দুশ্চিন্তা এবং ব্যর্থতা ক্রমে বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়; যার চূড়ান্ত পরিণতি আত্মহনন। ক্রমবর্ধমান এ প্রবণতা ঠেকাতে সামগ্রিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। পরিবারগুলো তাদের সন্তান-সন্ততি, উঠতি বয়সী স্কুলপড়–য়াদের মানসিক চিন্তা-চেতনা নিবিড়ভাবে খেয়াল রাখা দরকার। প্রয়োজন তাদের সময় দেয়া, মান-অভিমান সম্পর্কে সজাগ সতর্ক থাকা। তাদের চাহিদা, বয়োসন্ধিক্ষণের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা। স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে বয়সজনিত মানসিক চিন্তা-চেতনা সম্পর্কিত পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত করা। বিশেষ করে স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ে বছরে অন্তত একবার শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার বাড়ানো এবং বাস্তবতার নিরিখে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা