২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ব্যাংকিং সেক্টর রক্ষায় সংস্কার কর্মসূচি

ব্যাংকিং সেক্টর রক্ষায় সংস্কার কর্মসূচি - নয়া দিগন্ত

সমস্যায় জর্জরিত দেশের অর্থনীতি। স্বাধীনতার পর একসাথে এত চ্যালেঞ্জে পড়েনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। অর্থনীতির সব সূচক স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। শেয়ারবাজার অনেক আগে থেকেই ঝুঁকিতে। ব্যাংকিং খাত দুর্বল হতে হতে প্রায় শয্যাশায়ী। ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারছে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) প্রতিবেদনে মাত্র ২৪টি ঘটনায় প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির ও ভয়াবহ লুটপাটের চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের মতে, লুটপাটের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত এখন জিম্মি দশায়। এ খাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব কমে গেছে। বাস্তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার কর্তৃত্ব স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারছে না।

ব্যাংকিং খাতের অর্থ তছরুপ ও বিদেশে পাচারকারীরা রাজনৈতিক প্রভাবেই তা করে থাকে। ২০০৯ সাল থেকে দেশে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় চতুর্থ প্রজন্মের ১৩টি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের এই দুর্নীতি রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। সরকারের অনেক পদক্ষেপ ঋণখেলাপিদের পক্ষে গেছে। একটার পর একটা ছাড় পেয়েছে খেলাপিরা। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। কাগজ-কলমে ক্ষমতা, নিয়ম-নীতি থাকলেও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের তা প্রয়োগের অভাব রয়েছে। প্রভাবশালী বা ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ায় সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব, ভ্রান্তনীতি গ্রহণ, নীতির সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, সর্বোপরি লাগামহীন দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ সঙ্কট থেকে বের হতে পারছে না।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসির অনুপাত ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ভারতের ১৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাউন্ডনেসে ১৪১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম, যা সাউথ এশিয়ান অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। অন্যদিকে, গ্লোবাল ইকোনমির গবেষণা মতে, বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ১৩৬ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম, যা ২০০৯ সালের তুলনায় ২২ ধাপ পিছিয়েছে। বিগ থ্রি হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে বা নেতিবাচক সঙ্কেত দিয়েছে, তাতে অর্থনীতি ‘রেড ফ্ল্যাগস’ এ উঠে এসেছে। বিদেশী ঋণ প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছেন না। ব্যাংকিং খাত নজিরবিহীন তারল্য সঙ্কটের কারণে দেশের অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। এ সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে এবং আস্থার সঙ্কটের কারণে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকে। অনাদায়ী ঋণ, খেলাপি এই ঋণের ফলে তারল্য সঙ্কটের কারণে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে লোন দেয়া সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, আদালত ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও সামগ্রিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আনু মুহাম্মদ বলেন, অর্থনীতিতে স্বচ্ছতার সমস্যা, জবাবদিহির সমস্যা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার সমস্যা এখন প্রকট। দেশে একেকটা সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নীতিমালা তৈরি হচ্ছে, কে তৈরি করছেন, কীভাবে তৈরি হচ্ছে, কার স্বার্থে হচ্ছে- এসব বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। ব্যাংক থেকে একটি গ্রুপের বিপুল অর্থ পাচার নিয়ে একটি পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে অথচ সরকারের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই।

ব্যাংক খাতের বেহাল অবস্থা তুলে ধরে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেছেন, এখন সময় এসেছে ঘোষণা না দিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার। দেশের ১০-১৫টি ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় পৌঁছে গেছে। দেশের এসব দুর্বল ব্যাংককে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ শুরু করতে হবে। সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া বন্ধ করলেও ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংককে ঠিকই টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে। আবার এসব ব্যাংকের কোনো জবাবদিহিও নেই। আহসান মনসুর বলেন, এক হাতে টাকা ছাপানো বন্ধ করে আরেক হাতে টাকা ছাপছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা দেয়া হচ্ছে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংককে টিকিয়ে রাখার জন্য। একদিকে কঠোর হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যাংক বন্ধ হবে না বলেও ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। এ জন্য পুরো খাতে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এখন বলা উচিত, দুর্বল ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে।

অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুরের মতে, বলা হচ্ছে, গভর্নরকে দেয়া ক্ষমতায় ইসলামী ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়া হচ্ছে। জনগণের টাকা এভাবে কোনো ব্যাংককে দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এভাবে টাকা দেয়ার জবাবদিহি থাকতে হবে। কেন দু-তিন বছরে ব্যাংকগুলো এত খারাপ হয়ে পড়ল, এর কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো টাকা ছাপিয়ে ব্যাংককে দেয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে, নইলে ব্যাংকিং সেক্টরই বিপদে পড়ে যাবে।

দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেছেন, বেসরকারি খাতের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্য সময় বেঁধে দিতে হবে। নইলে সেগুলোকে অন্যান্য ব্যাংকের সাথে একীভূত করে দেয়া যেতে পারে। আর সরকারি ব্যাংকগুলো পরিচালনায় স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিতে হবে। যেখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তিনি বলেন, সরকারি খাতে কেবল একটি ব্যাংক রেখে বাকিগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। আবার একটি রেখে অন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে ন্যাড়ো ব্যাংকেও পরিণত করা যেতে পারে। এসব ব্যাংক আমানত নিলেও শুধু ট্রেজারি বিলে তা বিনিয়োগ করতে পারবে। কোনো ঋণ দিতে পারবে না। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এর কোনোটিই সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারি ব্যাংকে তদারকির পুরো দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

ব্যাংকিং কার্যক্রমে নৈতিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ব্যাংকিং গভর্ন্যান্স। ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া সংস্কার কর্মসূচির আগে, ব্যাংক খাতে প্রশাসন খুবই দুর্বল ছিল। ১৯৯৮-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারগুলো মূলত এই খাত সুশাসন ও নৈতিকতার পুনরুদ্ধার করেছিল। এ সময় ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন আইনকানুন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়।

বর্তমানে অবস্থা ভিন্ন। কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ কমানো বা শক্তিশালী ঋণখেলাপিদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া উচিত নয়। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা উচিত, যাতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো ভয় বা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে না পড়তে হয়। এখন সময় এসেছে বাস্তবে ব্যাংকগুলোর সমস্যার সমাধান করা, যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তা করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ব্যাংকিংয়ে নৈতিকতার চর্চায় পরিচালনা পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ভূমিকা পুরো ব্যাংকের অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সেটিকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আন্তর্জাতিক মানের চর্চার আলোকে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আলাদা করে দেয়া হয়েছে, যাতে ব্যাংক খাতে করপোরেট সুশাসনের চর্চা করা সম্ভব হয়।

পরিশেষে বলতে হয়, সরকার গর্ব করে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা যাই থাকুন না কেন, আজো কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি। কিন্তু অনেকগুলো দুর্বল ব্যাংককে তার মালিকরা, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অর্থ তছরুপের অভয়ারণ্য বানিয়েছে। আর সরকারের জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে প্রতি বছর দলীয় লোকদের মালিকানার বেসরকারি ব্যাংককে উদ্ধারের নামে টিকিয়ে রাখার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব বা গর্ব তো নেই; বরং রয়েছে ব্যর্থতা; দেখা দিচ্ছে ব্যাংক সম্পর্কে জনগণের আস্থার সঙ্কট এবং নেতিবাচক ধারণা। দেশের সবচেয়ে সফল, টেকসই এবং বৃহত্তর ইসলামী ব্যাংকটির সাথে, তার বর্তমান মালিক আরো পাঁচটি দুর্বল ইসলামী ব্যাংককে জুড়ে দিয়ে স্বনামধন্য ইসলামী ব্যাংকটিকে মারাত্মক ঝুঁঁকিতে ফেলেছে। দশক ধরে লোকসান বহনকারী ব্যাংককে বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে কেন টিকিয়ে রাখতে হবে বিষয়টি দেশের সাধারণের বোধগম্য নয়। সরকারি কয়েকটি ব্যাংকে তো একদিকে ব্যাংকের টাকা তছরুপ করে প্রতি বছর সরকার থেকে পুঁজি সহায়তা নিয়েই টিকে আছে। সুতরাং এখন সময় এসেছে দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সমমনা ও সমধারার ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ করে ব্যাংকিং সেক্টর তথা দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়ার।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement