শবেমেরাজ : ঘটনা ও বাস্তবতা
- ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:০৩
ইসলামের ইতিহাসে শবেমেরাজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই ঘটনা মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান, ঈমান ও আমল-আখলাক, বিশ্বাস ও ভক্তি এবং জীবন দর্শনে বিরাট স্থান দখল করে রেখেছে। প্রতি বছরই মেরাজ আমাদের নবীকুল শিরোমণি হজরত মোহাম্মদ সা:-এর এই বিস্ময়কর ভ্রমণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু এ ব্যাপারে একটি সম্যক উপলব্ধি না থাকায় আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেরাজের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই এবং এর মাধ্যমে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার ব্যাপারে গাফেল থেকে যাই। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ সা:-এর মেরাজের দিন-তারিখ, স্থান ও ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনায় কিছু ভিন্নতা থাকলেও এর স্পিরিট ও তাৎপর্যের বিষয়ে সবাই একমত। মেরাজের একটি সামগ্রিক চিত্র এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো, যা আমাদের মেরাজের তাৎপর্য অনুধাবনে সহায়ক হতে পারে।
শবেমেরাজ কী : ‘শব’ ফার্সি শব্দ যার অর্থ রাত। আর মেরাজ মানে সিঁড়ি। আমাদের প্রিয় নবী সা: একটি বিশেষ সিঁড়ির মাধ্যমে মহাকাশে আরোহণ করেছিলেন। ওই পবিত্র সিঁড়িই হলো মেরাজ। এক কথায় মেরাজ বলতে নবীজী সা: ৬২১ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে (তারিখ স¤পর্কে মতানৈক্য রয়েছে) মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে জেরুসালেমের মসজিদুল আকসা হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা শেষে পুনরায় মসজিদুল হারামে ফিরে আসার ভ্রমণকে বোঝায়।
মহানবী সা:-এর মহাকাশ ভ্রমণ : ইসরা : মহানবী সা:-এর মহাকাশ ভ্রমণ ‘ইসরা’ এবং ‘মিরাজ’ এই দুই ভাগে বিভক্ত। ‘ইসরা’ হলো মেরাজের রাতে মহানবী সা:-এর ভ্রমণের প্রথমভাগ যা মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। কুরআনে এই ভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয়েছে, যার অর্থ ‘রাতে নিয়ে যাওয়া’। পবিত্র কাবা এবং তৎসংলগ্ন মসজিদকে মসজিদুল হারাম বলা হয়। কাবা হলো পৃথিবীর প্রথম ঘর। হজরত আদম আ: এই ঘর নির্মাণ করেন। আর মসজিদে আকসা বলা হয় বায়তুল মোকাদ্দাসকে। ‘আকসা’ অর্থ হলো দূরবর্তী। তৎকালীন সময়ে দ্রুতগামী যান্ত্রিক যানবাহন না থাকায় মক্কা থেকে জেরুসালেমের দূরত্ব ছিল অনেক। এ জন্যই ওই মসজিদকে মসজিদুল আকসা বলা হতো। হজরত সোলায়মান আ: এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি এই মসজিদ নির্মাণকাজে জিনদেরকে শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করেন। বিভিন্ন বিবরণে জানা যায়, ইসরা শুরুর প্রাক্কালে নবীজী সা: তাঁর চাচাতো বোন উম্মে হানি রা:-এর ঘরে এশার নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। এ সময় হজরত জিবরাইল আ: তাঁকে উঠিয়ে কাবাঘর প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। এখানে তাঁর বক্ষ বিদারণ করে তা জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করা হয়। এরপর বোরাক নামে একটি বাহনে তিনি আরোহণ করেন। বাহনটি ছিল পাখাওয়ালা এবং আকারে গাধার চেয়ে সামান্য ছোট আকারের জন্তু। বোরাক আরবি শব্দ। এর মূল শব্দ ‘বারকুন’ যার অর্থ হলো বিদ্যুৎ। অত্যন্ত দ্রুতগতি স¤পন্ন এই বোরাকে চড়ে প্রথমে নবীজী সা: মদিনা পৌঁছেন। জিবরাইল আ: তাঁকে জানালেন যে, এটি তাঁর হিজরতের স্থান। এখানে নবী সা: দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েন। বোরাকে চড়ে তিনি এরপর মসজিদুল আকসায় পৌঁছেন। এখানে একটি ছিদ্র করা পাথরে বোরাকটি বেঁধে মসজিদে প্রবেশ করেন এবং দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েন। এরপর শুরু হয় তাঁর ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় বা মেরাজ।
মেরাজ : মসজিদে আকসা থেকে মেরাজ বা বিশেষ সিঁড়িতে করে নবীজী সা: জিবরাইল আ:-এর সাথে মহাকাশ ভ্রমণ শুরু করেন। ঊর্ধ্বে আরোহণকালে তিনি মহাকাশের সাতটি স্তরে বিভিন্ন নবীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রথম আকাশে হজরত আদম আ:, দ্বিতীয় আকাশে হজরত ইয়াহিয়া ও ঈসা আ:, তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ আ:, চতুর্থ আকাশে হজরত ইদরিস আ:, পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন আ:, ষষ্ঠ আকাশে হরজত মূসা আ: এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম আ:-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন । নবীজী সা: প্রথমেই সাক্ষাৎ পান মানবজাতির পিতা হজরত আদম আ:-এর এবং শেষে দেখা পান মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর যিনি বায়তুল মামুর নামক মসজিদের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। বায়তুল মামুর হলো মহাকাশের শেষ সীমান্তবর্তী একটি মসজিদ যা পৃথিবীর কাবাঘরের সরাসরি উপরে অবস্থিত। প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা এই মসজিদে এসে ইবাদত করে চলে যান আর কখনো আসেন না। নবীজী সা: বায়তুল মামুর পার হয়ে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেন। ‘সিদরাত’ মানে হলো কুলবৃক্ষ, আর ‘মুনতাহা’ অর্থ হলো সীমান্ত। অর্থাৎ মাহাকাশের শেষ সীমান্তে একটি বিশেষ ধরনের কুলবৃক্ষ রয়েছে। এখানে পৌঁছার পর জিবরাইল আ: আর উপরে অগ্রসর হতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন ‘রফ রফ’ নামে একটি সবুজ বর্ণের সিংহাসনে চড়িয়ে নবীজী সা:-কে সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি স্বচক্ষে বেহেশত ও দোজখ দেখেন এবং মহান রাব্বুল আলামিনের সাথে বিভিন্ন কথাবার্তা শেষে পুনরায় ফিরতি ভ্রমণ শুরু করেন।
ফিরতি ভ্রমণ : পুনরায় নবীজী সা: মসজিদে আকসায় অবতরণ করে দেখেন সব নবী আ:গণ তাঁর জন্য নামাজের অপেক্ষা করছেন। তিনি তাঁদের ইমামতি করে দুই রাকাত নামাজ স¤পন্ন করেন। এর পর রাসূলুল্লাহ সা: মক্কায় মসজিদে হারামে ফিরে আসেন। এ সময় পথিমধ্যে তিনি কয়েকটি কাফেলাকে মক্কায় আসতে দেখেন। বায়তুল্লাহ শরিফে পৌঁছেই তিনি প্রথম উম্মে হানির গৃহে গমন করে সবাইকে ডেকে উঠান এবং ফজরের নামাজ আদায় করেন ।
মেরাজে গমন করে নবীজী সা:-এর ইসলামের বিশ্বাসের বিভিন্ন বিষয়গুলো স্বচক্ষে অবলোকন করে বিস্তর বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আসেন। তিনি সেখানে বেহেশত, দোজখ ও তাদের অধিবাসীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে আসেন।
মহান আল্লাহ পাকের দরবার থেকে যা নিয়ে আসেন : ক. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। অবশ্য প্রথমে নামাজ ৫০ ওয়াক্ত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হজরত মূসা আ:-এর পরামর্শক্রমে তিনি আল্লাহ পাকের কাছে অনুরোধ করে তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করে নিয়ে আসেন। তবে আল্লাহ পাক দয়াপরবশ হয়ে এই পাঁচ ওয়াক্তকেই ৫০ ওয়াক্তের সমমর্যাদা দিয়ে দেয়ার কথা বলেন।
খ. সূরা বাকারার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ শেষ কয়েকটি আয়াত।
গ. মদিনায় নবীজী সা:-এর হিজরত এবং মুসলমানদের নিজস্ব বিশ্বাস ও দর্শনের ভিত্তিতে সমাজ এবং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য পৃথক আবাসভূমি প্রাপ্তির সুসংবাদ।
ঘ. স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী সমাজ পরিচালনার জন্য পৃথক একটি নির্দেশমালা বা সংবিধান।
বাস্তবতার নিরিখে মেরাজ : মেরাজের পর মহানবী সা: মক্কাবাসীকে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেন। এতে মক্কায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সেই যুগের সাধারণ মানুষের কাছে এই ঘটনা একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হয়। মক্কাবাসী এটিকে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল। কেউ কেউ তাঁকে পাগল সাব্যস্ত করল। কিছু কিছু দুর্বল প্রকৃতির নতুন মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করল। জনতা তখন নবীজী সা:-এর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হজরত আবু বকর রা:-এর কাছে গিয়ে এ ঘটনা বলল। আবু বকর রা: বললেন, এ ঘটনা যদি নবীজী সা: নিজে বর্ণনা করে থাকেন তবে এটি অবশ্যই সত্য। সেই থেকে আবু বকর রা:-এর নাম সিদ্দিকী বা বিশ্বাসী বলে বিশেষিত হলো।
কুরআনের সাক্ষ্য : বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সাথে সাথে মহাগ্রন্থ আল কুরআন আজ সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনও শুরুতেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে যে, এটি এমন গ্রন্থ যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। এই চ্যালেঞ্জ আজ পর্যন্ত গত চৌদ্দশত বছরেও কেউ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি। সূরা বনি ইসরাইল ও সূরা আন নজমে এই মেরাজের কথা বলা হয়েছে। কাজেই মেরাজ সত্য বলে কুরআন সাক্ষ্য দিচ্ছে।
বিজ্ঞানের যুক্তি : আজকের বিজ্ঞানও প্রমাণ করে, এক রাতের মধ্যে মক্কা থেকে জেরুসালেম এবং মহাকাশে গিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব। আলোর গতি, মহাকাশের মাধ্যাকর্ষণ বলের আইন বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের টাইম ডিলেশন থিওরি প্রভৃতি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, এক রাতের মধ্যে এত দ্রুত ভ্রমণ সম্পন্ন করা খুবই সহজ। এ ছাড়া নবীজী সা:-এর বাহনটি ছিল ‘বোরাক’ যার মানেই হলো ‘বৈদ্যুতিক’। আর বিদ্যুতের গতি স¤পর্কেও আমাদের সবার জানা রয়েছে। তবে এসবের প্রকৃত রহস্য একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাই জানেন।
চাক্ষুষ প্রমাণ : নবীজী সা:-এর মেরাজের ঘটনা মক্কায় জানাজানি হওয়ার পর কোরাইশরা ধরেই নিলো এটি পাগলের প্রলাপ। এই মওকায় তারা নবীজী সা:-কে অপদস্ত করার মানসে লোকজন সমাগম করে তাঁকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করতে বলল। তিনি ভ্রমণকাহিনী বলার পর অবিশ্বাসীরা তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল। তারা জিজ্ঞেস করল, মসজিদুল আকসার দরজা কয়টি, জানালা কয়টি, বিভিন্ন নবীদের দৈহিক গঠন কিরূপ? ইত্যাদি নানা প্রকার প্রমাণাদি তারা চাচ্ছিল। এসব প্রশ্নে রাসূলুল্লাহ সা: একটু বিচলিত হলেন। তিনি তো আর মসজিদে আকসার দরজা-জানালা গণনা করতে যাননি! এমন সময় মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর সামনে পুরো মসজিদে আকসা তুলে ধরেন। আর রাসূল সা: কাফেরদের সব পুঙ্খানুপুঙ্খ উত্তর দিয়ে দিলেন। এভাবে মহানবী সা: আল্লাহ পাকের রহমতে সবগুলো প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিয়ে ঘটনাটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন। এ ছাড়া তিনি পথিমধ্যে কয়েকটি কাফেলার কথা জানান, যাদের একটির হারিয়ে যাওয়া উট তিনি খুঁজে দিয়েছিলেন; অন্য একটি কাফেলার পানির মশক থেকে পানি পান করেছিলেন। তবুও তিনি বিভিন্ন কাফেলার ধরন ও তাদের বর্তমান সম্ভাব্য অবস্থান ইত্যাদি বলে দেন। পরবর্তীতে এই সবগুলোই সত্য প্রমাণিত হয়।
ইহুদি আলেমের সাক্ষ্য : তৎকালীন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস নবীজী সা: সম্পর্কে জানতে চাইলে দরবারে উপস্থিত কোরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান জানায়, ওই নবী মেরাজের মতো অসম্ভব অভিজ্ঞতার কথা বলে বেড়াচ্ছেন। তখন সভায় উপস্থিত সাম্রাজ্যের প্রধান ইহুদি আলেম এই ঘটনার সত্যতার সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন যে, আমি মসজিদে আকসায় থাকাকালীন সময়ে প্রতিদিন মসজিদের দরজা বন্ধ করে রাতে ঘুমাতে যেতাম। সেই মেরাজের রাতে অভ্যাসমতো আমি মসজিদের দরজা বন্ধ করতে গেলে একটি দরজা কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব হলো না। এমনকি মিস্ত্রি ডেকেও তা বন্ধ করা যায়নি। তখন আমি ভাবলাম হয়তো রাতে আল্লাহর কোনো নেক বান্দা এসে ইবাদত-বন্দেগি করবেন, তাই আল্লাহ পাকের ইশারায় তা বন্ধ হচ্ছে না। কাজেই দরজা খোলা রেখেই চলে যাই এবং পরদিন সকালে এসে দেখি মসজিদের আঙ্গিনায় একটি ছিদ্র করা পাথর যাতে কোনো জন্তু বেঁধে রাখা হয়েছিল। আর দরজাও বন্ধ করা সম্ভব হলো। তার মানে সেই রাতেই এই মহান মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা